লিওনার্দ বুমফিল্ড তাঁকে বলেন ‘মনুমেন্ট অফ হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স’। ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুরের ইনি ছিলেন গুরু। ভারতীয়রা তাঁকে চেনে সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত ও সংস্কারক হিসেবে। তিনি বৈয়াকরণিক পাণিনি। তাঁর দেশ সলাতুর। মা দাক্ষী। বাবার গোত্রের নাম পাণিনি। তিনি লিখে ফেললেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পুরোনো ব্যাকরণ ‘অষ্টাধায়ী’। সময়টা খ্রিস্টের জন্মেরও চারশো বছর আগে। বৈদিক যুগের একেবারে শেষ পর্বে পাণিনির আবির্ভাব। পাণিনি দেখলেন তাঁর জন্মের দেড় হাজার বছর আগে যে বৈদিক সাহিত্য লেখা শুরু হয়েছিল তা সাধারণ মানুষের কাছে ছিল দুর্বোধ্য। শ্রুতি-নির্ভর বৈদিক সাহিত্যই ছিল আর্য সংস্কৃতির ভিত্তি। তাই তাকে ধারণ করাটাই ধর্ম বলে পরিচিত হত। শ্রুতি-নির্ভর বেদকে সংরক্ষণ করতে হলে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির। আর বেদাঙ্গগুলিই ছিল তার সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
আরও পড়ুন-সরছে নিম্নচাপ, বিদায় বৃষ্টির
সংস্কৃত দিবস— বিশ্বজনীন
আজকের যুগের ভাষাতাত্ত্বিকদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে পাণিনির ব্যাকরণের নির্মাণকৌশল। কম্পিউটার যে-কোনও ভাষা শেখার জন্যেই সব থেকে বেশি গ্রহণীয় পাণিনির কৌশল, তাঁর ভাষা-বিশ্লেষণের পদ্ধতি। প্রাচীন ভারতে পাণিনির ব্যাকরণ ভাষাচর্চার একটা ধারা তৈরি করেছিল, যার ফলে পরবর্তী কালে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাত্যায়ন পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণকে আরও সম্পূর্ণতা দিতে তৈরি করলেন ‘বার্ত্তিক’, এবং তাঁরও প্রায় দেড়শো বছর পরে পতঞ্জলি লিখলেন ‘মহাভাষ্য’। সম্মিলিতভাবে তিন বৈয়াকরণের গ্রন্থ ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণ’ নামে রয়ে গেল বাঙালির কাছে।
ভারতের সংস্কৃতিকে বহন করে নিয়ে চলেছে এই সংস্কৃত ভাষা। অনেকে একে দেবতাদের ভাষা বলেও পরিচয় দিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে সংস্কৃত ভাষা এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পাণিনির অবদানকে সম্মান জানাতে ৩১ অগাস্ট দিনটিকে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পাণিনিদের কাজকে সমর্থন করার জন্যে বিশ্বব্যাপী সংস্কৃত পণ্ডিত ও উৎসাহীদের জন্য এই দিনটি স্মরণ করা হয়।
সংস্কৃত দিবসের উদযাপনের পরম্পরা
ভারতীয় শিক্ষা মন্ত্রকের নির্দেশে ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে প্রথম সংস্কৃত দিবস পালন করা হয়। এটি সংস্কৃত, ছাত্র, কবি এবং লেখকদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভাষার প্রতি ভালবাসা দেখানোর একটি মঞ্চ হয়ে ওঠে। বিশ্ব সংস্কৃত দিবস সাধারণত হিন্দু ক্যালেন্ডারের শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিনে পালন করা হয়। যা সাধারণত গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডারের অগাস্ট মাসের সঙ্গে মিলে যায়। সংস্কৃত বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেকে মনে করে এটি সমস্ত ইন্দো-আর্য ভাষার জননী। এটি একটি অত্যন্ত সংক্রামিত ভাষাও বটে, যেখানে ব্যাকরণ ও রূপবিদ্যার একটি জটিল ইতিহাস রয়েছে।
বিশ্ব সংস্কৃত দিবস পালনের একটা পরম্পরা রয়েছে। রয়েছে ইতিহাস। ১৯৬৯ সালে এর উদযাপন শুরু হলেও সংস্কৃত ভাষা এবং পাণিনিদের কাজকে সমর্থন করার জন্য বিশ্ব সংস্কৃত দিবস পালন করা হয়। সংস্কৃত ভাষাকে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে তুলে ধরার জন্যে নানান প্রয়াস চলছে। সংস্কৃত যে শুধুমাত্র পুরোনো ইন্দো-আর্য ভাষা তা নয়। এখানে প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরনো নথিভুক্ত ইতিহাস রয়েছে। অনেকে একে হিন্দু সংস্কৃতির প্রাথমিক লিটারোজকাল ভাষাও বলে। উত্তরাখণ্ডের মানুষ সংস্কৃত ভাষাকে সরকারি ভাষার মান্যতা দিয়েছে।
বৈদিক এবং শাস্ত্রীয় সংস্কৃত
সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করা হয়। মনে করানো হয় সংস্কৃত ভাষার গুরুত্বকে। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, সংস্কৃত প্রধানত দুটি যুগে বিভক্ত, একটি হল বৈদিক, অন্যটি শাস্ত্রীয়। বৈদিক সংস্কৃত মূলত ঋগ্বেদ, উপনিষদ এবং পুরাণের একটি অংশ। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৫০০ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল বেদ। বর্তমান যুগেও হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও অনুশীলনে সংস্কৃত ভাষার একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে।
ভালবাসায় সংস্কৃত ভাষা
সংস্কৃত শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় ভাষা নয়। ভারতবর্ষের বাইরে স্বল্প ব্যবহৃত হলেও এ-ভাষার ব্যাপ্তি সর্বজনীন। অনেকে পেশার খাতিরে এই ভাষাকে ভালবাসেন, অনেকে আবার ধ্রুপদী সংস্কৃতি দেখানোর জন্যে সংস্কৃত ভাষা ভালবাসেন। ভারতের জনজীবনে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে রয়েছে সংস্কৃতের ব্যবহার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক— সবদিকেই সংস্কৃতের অবাধ বিচরণ। ভারতের সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের এমব্লেম বা প্রতীকে উজ্জ্বল হয়ে আছে সংস্কৃত ভাষা। এই প্রতীকের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোঝাতে এগুলি ব্যাবহার করা হয়। ভারত এবং নেপালের রাষ্ট্রীয় প্রতীকেও সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। এই দেশগুলির বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও সংস্কৃত মন্ত্র, সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলিকে উদযাপিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
সত্যমেব জয়তে— জয়তে সংস্কৃত
ভারতের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় স্তুতি ‘জনগণমন’ এবং ‘বন্দে মাতরম্’-এর উপরে সংস্কৃতের প্রভাব রয়েছে।
এ-সংগীত দুটি নামে বাংলা হলেও প্রায় সংস্কৃতই বলা চলে। আবার অন্যদিকে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মাথার উপরে মহাভারতের ভীষ্মপর্ব থেকে নেওয়া, ‘যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’— এ অসাধারণ সংস্কৃত বাক্যটি খোদিত আছে। যার সরল অর্থ হল যেখানেই ধর্ম, সেখানেই জয়। মহাভারতের প্রধান শিক্ষাই হল যথা ধর্ম, তথা জয়। তাই আমাদের সবারই উচিত সদা সত্যরূপ ধর্মের শরণে থাকা। ভারতের কেন্দ্রীয় লোকসভা এবং পশ্চিমবাংলার বিধানসভা ভবনের দ্বারদেশে আছে মহাভারতের আরও একটি বিখ্যাত শ্লোক—
‘ন সা সভা যত্র ন সন্তি বৃদ্ধাঃ
ন তে বৃদ্ধা যে ন বদন্তি ধর্মম্।
নাসৌ ধর্মো যত্র ন সত্যমস্তি ন
তৎ সত্যং যচ্ছলেনানুবিদ্ধম।।’
(মহাভারত : উদ্যোগপর্ব, ৩৫.৬১) ‘যেখানে জ্ঞানবৃদ্ধগণ থাকেন না, তা সভাই নয়। তাঁরা জ্ঞানবৃদ্ধ নন, যাঁরা ধর্ম বলেন না। যা ধর্মই নয়, যার মধ্যে সত্য থাকে না। তা সত্যই নয়, যা ছল প্রবঞ্চনায় যুক্ত।’ অথর্ববেদের শৌনকীয় শাখার অন্তর্গত মুণ্ডক উপনিষদ (০৩.০১.০৬) থেকে নেওয়া ভারত প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই বাক্যটি— ‘সত্যমেব জয়তে’। একমাত্র সত্যই জয়লাভ করে, মিথ্যা নয়।
আরও পড়ুন-দ্রুত বিচার চাই সিবিআই, সিজিও ঘেরাও ডাক্তারদের
সংস্কৃত— বহুজনসুখায় বহুজনহিতায়
আকাশবাণীর আদর্শ গৃহীত হয়েছে, ‘বহুজনসুখায় বহুজনহিতায়’-এ অনন্য সর্বজনীন সংস্কৃত বাক্যটি। শিবস্তোত্র থেকে নেওয়া দূরদর্শনের-এর মূল মন্ত্র বা আদর্শ হল— ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্।’
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে নেওয়া ভারতীয় জীবনবিমা বা এলআইসি-র আদর্শ হল— ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।’ যে অনন্য চিত্তে আমার স্মরণ নেয়, তার সে যা পেতে চায় এবং কে পেয়েছে, তার সংরক্ষণ আমি নিজে স্বয়ং বহন করি। শ্রীমদ্ভগবদগীতার নবম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল— ‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে। তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।’ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা : ৯.২২)। ‘যে সকল ভক্তগণ অনন্যচিত্ত হয়ে সর্বদা আমাকে উপাসনা করে; আমাতে নিত্য অনন্যচিত্ত সে-সমস্ত ভক্তের যোগ (প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান) এবং ক্ষেম (লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ) আমিই বহন করে থাকি।’ ভারতীয় নৌসেনার আদর্শ হল কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় উপনিষদ থেকে নেওয়া মোটো ‘শং নো বরুণঃ’। হে জলের অধীশ্বর ভগবান বরুণ আমাদের শান্তি দিন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায় বিশ্বরূপদর্শন যোগের চব্বিশতম শ্লোক থেকে নেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স-এর আদর্শ ‘নভঃ স্পৃশং দীপ্তম্’। হে ভগবান, আকাশস্পর্শী তেজোময় আপনার রূপ। মহাভারত থেকে নেওয়া হয়েছে— রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালয়সিং-এর আদর্শ ‘ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ’। একমাত্র ধর্মকে রক্ষা করলেই রক্ষা পাওয়া যাবে, নচেৎ নয়। ধর্ম যথাযথভাবে পালন করলে সত্যরূপ ধর্মই সর্বদা রক্ষা করে, আর ধর্মহীন উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির বিনাশ সাধন করে। মহাভারতের বনপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ধর্মকে উদ্দেশ্য করে বলেন। সম্পূর্ণ শ্লোকটি হল, ‘ধর্ম এব হতো হন্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ। তস্মাদ্ধর্মং ন ত্যজামি মা নো ধর্মো হতো বধীৎ।। (মহাভারত : বনপর্ব, ২৬৭.৯২)’ যে ব্যক্তি ধর্ম নষ্ট করে, ধর্মই তাকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। পক্ষান্তরে যিনি ধর্মকে রক্ষা করেন, ধর্মই তাকে সর্বদা রক্ষা করেন। তাই আমি (ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির) ধর্মকে কখনও পরিত্যাগ করি না। কেননা, ধর্ম যদি আমার দ্বারা বিনষ্ট হয়, তবে সে ধর্মই আমাকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেবে।
ভুবন জুড়ে সংস্কৃত ভাষা
ভারতের বিভিন্ন সরকারি বিভাগ এবং সরকার পোষিত সংস্থার মূল মন্ত্র বেঁধে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যে দিয়ে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে এই সংস্কৃত ভাষার মান্যতা রয়েছে। ভারতীয় ডাক বিভাগের আদর্শ স্থির করা হয়েছে অসাধারণ এক সর্বজনীন বাক্য দিয়ে— ‘অহর্নিশং সেবামহে’। দিবারাত্রি সেবা দিয়ে যাব নিরন্তর। ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর আদর্শ হল— ‘জাগৃতং অহর্নিশং’। দিবারাত্রি সদা জাগ্রত। ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ড-এর মোটো বা আদর্শ হল— ‘বয়ং রক্ষামঃ’। আমরা রক্ষা করব। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভোলোপেন্ট অর্গানাইজেশন-এর আদর্শ হল— ‘বলস্য মূলং বিজ্ঞানম্। সকল বলের উৎস বিজ্ঞান। নেপাল রাষ্ট্রেরও জাতীয় প্রতীকে আছে রামায়ণের স্বদেশপ্রেমের একটি বিখ্যাত শ্লোক। সেই বিখ্যাত শ্লোকটি রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে নেওয়া : ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। অর্থাৎ, জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। এ-পৃথিবীখ্যাত হিরণ্ময় শ্লোকটি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মুখে রামায়ণে উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য শ্লোকটি রামায়ণের সকল সংস্করণে পাওয়া যায় না। শুধু ভারত-নেপালের ন্যায় হিন্দু-অধ্যুষিত দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নয়, সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীর লোগোতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা : ‘স্বঃ ভূবন পক্ষঃ’ অর্থাৎ মাতৃভূমির ডানা। ইন্দোনেশিয়ার নেভির লোগোতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা আছে : ‘জলেশ্বর জয়মহে’; অর্থাৎ সাগরে অপরাজেয়। শুধু বিমানবাহিনী বা নেভি নয়, ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর লোগোতেও সংস্কৃত ভাষায় লেখা রয়েছে: ‘কার্তিকা এক পক্ষী’।
আরও পড়ুন-আজ তিন পয়েন্ট চাই মহামেডানের
সংস্কৃত থেকে ইংরেজির ঋণ
ভারত এবং বিশ্বে নিজেকে প্রকাশ করার ভাষা হিসেবে সংস্কৃত নিজের জায়গা দৃঢ় করেছে। ব্যাকরণগত দিক থেকে সংস্কৃত ভাষা গঠনমূলক। স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ এখানে সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে। এর সবচেয়ে বাড়তি সুবিধা সংস্কৃতে কোনও কথা বললে তা একটি শব্দে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় অন্য কোনও ভাষায় তা বেশ কঠিন। তাই ইংরেজি ভাষাও সংস্কৃত থেকে শব্দ ঋণ করেছে। মশকা থেকে mosquito, শর্করা থেকে sugar, কার্পুরা থেকে camphor— সংস্কৃত থেকে অনেক ইংরেজি শব্দের জন্ম হয়েছে। সংস্কৃত মন্ত্র শব্দটি ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়েছে অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষার গুরু শব্দটিও জায়গা করে নিয়েছে ইংরেজি অভিধানে। চরম জ্ঞানলাভকে সংস্কৃত নির্বাণ লাভ বলে। সেখানে থেকেই এসেছে ইংরেজির এই Nirvana শব্দটি। আজকের দিনে সংস্কৃতের অবতার শব্দটি ইংরেজিতে Avatar হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। সংস্কৃতর ‘পণ্ডিত’ এবং ‘যোগা’ শব্দ দুটো বহু আগে থেকেই ইংরেজিতে মান্যতা পেয়েছে। চক্র এবং কর্ম সংস্কৃতের এই শব্দ দুটি ইংরেজিতে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমাদের ভুল ভেঙে দিয়েছে ‘Bungalow’ বাড়ি শব্দটি। সংস্কৃতের এই বাংলো সবার অজান্তেই ইংরেজদের আপন শব্দ হয়ে উঠেছে। ইংরেজের ১৭৮৬-তে স্যার উইলিয়াম জোন্স তাঁর একটি বইয়ে এই শব্দগুলির উল্লেখ করেন। এমনকী পার্শিয়ান বেশ কিছু শব্দও সংস্কৃত থেকেই এসেছে। আসলে ইন্দো-ইউরোপিয়ান যে কোনও ভাষার মূল হল সংস্কৃত।
কর্নাটকের মুখের ভাষা
একথা শুনলে এখনও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে। সংশয় প্রকাশ করে তার সত্যতা নিয়ে। কারণ ভাষা এবং ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে কর্নাটকের মানুষরা এখনও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বিক্রেতা— সবাই সংস্কৃতকে রপ্ত করে ফেলেছেন আপন করে ফেলেছেন। উত্তরাখণ্ডের রাজ্য-ভাষা সংস্কৃত ওই রাজ্যের মানুষকে সংস্কৃতপ্রেমী হতে শিখিয়েছে। তাঁরা মনে করেন সংস্কৃতের সঙ্গে সারা বিশ্বের যোগাযোগ রয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তি এবং রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃত যোগ বিষয়ে সে-রাজ্যের শিশুদের পাঠ দেওয়া হচ্ছে। পড়ানো হচ্ছে বেদও।
সুধুরামা— সংস্কৃত সংবাদপত্র
সংস্কৃত ভাষায় ভারতবর্ষের একমাত্র সংবাদপত্র ‘সুধারামা’। ১৯৭০ সালে কালালে নাদাদুর ভারাদারাজার-র হাত ধরে মইসুরে এই পত্রিকা নিজের পথচলা শুরু করে। এখন তার ব্যাপ্তি সারা বিশ্বে। ইন্টারনেটেও এই সংস্কৃত পত্রিকার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত পত্রিকা সুধারামার নিউজ প্রিন্টের গন্ধ নাকে নিতে হলে আগে থেকে আবেদন করতে হয় তাদের অফিসে। তারাই পাঠিয়ে দেয় পাঠকের বাড়িতে।
হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল এবং পপেও সংস্কৃত
সংস্কৃতর সঙ্গে যোগ রয়েছে হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল এবং পপের। এই মুহূর্তে যত শব্দ ব্যবহার করা হয় তার ৭৮ কোটি শব্দ হল সংস্কৃত শব্দ। সামবেদ থেকেই উৎস শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তাই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কীর্তন এবং ভজনে সংস্কৃত ব্যবহার করা হয়। চিনের গায়িকা, সা দিংদিং, সংস্কৃত ভাষায় পপ সং লেখার জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কৃতের ব্যবহার কম্পিউটারের জন্যে। সংস্কৃত ভাষা কম্পিউটারের ভাষা এবং কোড তৈরিতে সাহায্য করছে। নাসার বিজ্ঞানীরা সংস্কৃতকে কম্পিউটারের বন্ধু ভাষা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। ছয় এবং সাত জেনারেশনের কম্পিউটার তৈরিতে সংস্কৃতকে নানাভাবে ব্যবহার করছে।
আরও পড়ুন-বিজেপির উসকানিতে খুন বাংলার শ্রমিক, উত্তাল দেশ
জার্মানি থেকে আয়ারল্যান্ড— সংস্কৃতের ভুবনায়ন
বিশ্ব জুড়ে সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব বাড়ছে। জার্মানির প্রায় ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়ানো হয়। সেখানে স্পিচ থেরাপি হিসেবেও সংস্কৃত ব্যবহার করা হয়। শিশুদের বিজ্ঞান এবং অঙ্কে দৃঢ় করতেও সংস্কৃত ব্যবহার হয়। আয়ারল্যান্ডের বেশকিছু স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয় বাধ্যতামূলকভাবে। শুধু আমরা নই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং পরম্পরাকে তুলে ধরা হয় সংস্কৃত ভাষার মধ্যে দিয়ে। তাই দেবভাষা এখনও সর্বজনীন। বিশ্ব সংস্কৃত দিবসে আরও একবার পরিক্রমায় উঠে এল সংস্কৃত ভাষার মাহাত্ম্য।