সরস্বতী বিদ্যেবতী

কাল সরস্বতী পুজো। পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে নীল আকাশে উড়বে ভালবাসার ঘুড়ি। হলুদ বসনে সেজে উঠবে কৈশোর। গুণবতী রূপবতী, বিদ্যেধরী মা দু-হাত ভরে দেবেন আশীর্বাদ। ছোটবেলার সরস্বতী পুজোর আনন্দ, মজা, কুলচুরি আর প্রেমের স্মৃতির রোমন্থন হবে আরও একবার। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বিদ্যেবতীর (saraswati) আজ একফোঁটা সময় নেই। পুঁচকেগুলোর সব হাতেখড়ি হবে আজ। ওদের বিদ্যের প্রথম সোপান, তাই তাঁর দায়িত্ব যে অনেক। সেই পথে এগিয়ে চলার আশীর্বাদ দেবেন তিনি। এত আশীর্বাদ দিতে দিতে প্রতিবছর দিনের শেষে তাঁর হাতটা একটু টনটন করে ঠিকই কিন্তু আগামীতে যাঁরা পা রাখবে তাঁদের জন্য এ আর এমন কী কষ্ট! মায়ের আশীর্বাদ, জ্ঞান, বিদ্যেবুদ্ধির ভাণ্ডার তো শুধু তাঁর সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ। আবার কুল খাওয়ার অনুমতি চাই কচিকাঁচাদের। অনেক ব্যস্ততা। সকাল থেকে চলবে স্কুলে স্কুলে জ্যান্ত সরস্বতীদের প্যারেড। পুষ্পাঞ্জলি, খিচুড়ি-লাবড়া, চাটনি, নাচ-গানের মেলা জমবে। আর তিনি বীণা হাতে বসে এনজয় করবেন ফুরফুরে আনন্দ।

হাতেখড়ি
শুক্লা পঞ্চমী খুব শুভদিন। এই শুভদিনটির একটা গুরুত্ব আছে সাফল্যের দিক থেকে। এটাই বিশ্বাস যে এইদিন মা সরস্বতীর পুজো করে, তাঁকে সাক্ষী রেখে সন্তানের হাতেখড়ি দিলে তাঁর বিদ্যালাভের পথটি প্রশস্ত হয়। তাই হাতেখড়ি বিদ্যার্জনের প্রথম সোপান এবং সরস্বতী পুজোর প্রধান অঙ্গ। পুরোহিত মহাশয় স্লেট ও খড়িকে পবিত্র করে কচিকাঁচাদের নতুন জামা পরে মায়ের সামনে বসিয়ে প্রথম লেখাটি শেখান।

সাজ বাসন্তী
পলাশপ্রিয়ার বাসন্তী রংটি ভারি পছন্দের। তাই তাঁর পুজোর ড্রেসকোডে ওই রং-এর শাড়ি আর পাঞ্জাবি মাস্ট। যখন কেউ ড্রেসকোড বুঝত না তখন থেকেই তাঁর পুজোয় এই ড্রেসকোড চালু করেছিলেন। যদিও বাসন্তী রঙের কড়াকড়ি এখন অত নেই হালকা হলুদ, কাঁচাহলুদ, সবজে-হলুদ সব চলে। এই বাসন্তী রঙের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বসন্ত ঋতুর। কারণ সরস্বতী পুজো হয় বসন্ত পঞ্চমীতে। শীতের কড়া ঠান্ডা, মিঠেল রোদ পেরিয়ে ফুরফুরে বসন্তের আমেজ। এই সময় একটু একটু করে বদলাচ্ছে ঋতু। এই সময় যেসব ফুল ফোটে তা বেশিরভাগ হলুদ বা কমলা। আর বসন্ত মানেই হলুদে মাখা প্রেম। তাই এই বাসন্তীসাজ।

কুলের কৌলীন্য
কুল খেলেই নাকী মা সরস্বতী বেদম চটে যান। তারপর আর কী! পরীক্ষায় ডাহা ফেল। তাই তার পুজোর আগে কুল নৈব নৈব চ। কথিত আছে, একবার দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব কঠোর তপস্যা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই তপস্যার আগে সরস্বতী ব্যাসদেবকে একটি শর্ত দেন। তাঁর আশ্রমে একটি কুলের বীজ রেখে দেবী বলেন, এই কুলবীজ থেকে গাছ হবে, এবং সেই গাছের কুল পাকার পর যদি ব্যাসদেবের মাথায় পড়ে, সেদিনই তাঁর তপস্যা সম্পূর্ণ হবে। ব্যাসদেব সেই শর্ত মেনে নিলেন। কয়েক দিন পর সেই কুলের বীজ থেকে চারা জন্মাল। ধীরে ধীরে সেই চারা বড় হতে থাকে। কয়েকবছর পর তা মহীরুহ হল। একদিন সেই গাছে কুল হল এবং তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পড়ল। বলা হয় সেই দিনটিই নাকি ছিল শুক্লা পঞ্চমী। এই দিনেই ব্যাসদেব বুঝতে পারেন তাঁর তপস্যা সম্পূর্ণ হয়েছে। আসন ছেড়ে উঠে তিনি সেই কুল দেবীকে নিবেদন করে বেদপাঠ আরম্ভ করেন। এই কারণেই নাকি সরস্বতীকে অর্পণ না করে কুল খেতে নেই বলেই মনে করেন অনেকে। আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা হল— এই সময় কুল ঠিকমতো পাকে না তাই কেউ যাতে পাকার আগেই ওটি খেয়ে না ফেলে তাই এমন নিয়ম চালু।

হলুদে স্নান
শুধু বিয়ের দিনে নয়, বাগ্দেবীর (saraswati) আরাধনার দিনেও অনেক পরিবারে কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে স্নানের রীতি রয়েছে। হলুদ একদিকে হল শক্তি, সমৃদ্ধি ও প্রকাশের প্রতীক। অনেকে বলেন সেই কারণে হলুদ মেখে স্নান করা হয়। আবার বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম শুরুটাও এই সময়। ঋতু পরিবর্তনে এখনই হাম, বসন্তের বাড়বাড়ন্ত হয়। তাই হলুদ মাখার রীতির প্রচলন। হলুদ ত্বকের যে কোনও সংক্রমণের শত্রু। হলুদে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। তাই হলুদজলে স্নান রোগ, জীবাণু থেকে সুরক্ষিত রাখে আর শরীরকে শুদ্ধ করে।

প্রেম দিবসে
আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় মোড়া এমন প্রেমের দিন আর একটিও নেই। সেই প্রেম এক আনকোরা নতুন পাঞ্জাবি আর আর পাটভাঙা হলুদ জামদানির, সেই প্রেম দু’জোড়া চোখের, সেই প্রেম হাতে হাতের। ময়দান, ফেরিঘাট, ভিক্টোরিয়া— সরস্বতীর পুজোয় প্রেমের মরশুম যাপনে মেতে ওঠে নতুন প্রজন্ম। এইদিনেই প্রথম স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়া, শাড়ি পরা, এই দিনেই ঝপ করে অনেকটা বড় হয়ে ওঠা। যতই আসুক ভ্যালেন্টাইন্স ডে— সরস্বতী পুজোকে মাত দেবে এমন সাধ্যি নেই।

ভোকাট্টা জমানো ভালবাসা
আজ রাতভর ঘুড়ি-লাটাই, মাঞ্জার প্রস্তুতি। রাত পোহালেই সরস্বতী (saraswati) পুজো। কাল উড়বে নীল আকাশে ভালবাসার ঘুড়ি। শুধু বিশ্বকর্মা ঠাকুর নন, বীণাপাণিরও বড়ই পছন্দের হল ঘুড়ি। তাই সরস্বতী পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন এই রাজ্যে বহুদিনের। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, মধ্য কলকাতা, লেবুতলা, এন্টালি, মৌলালি, বারাকপুর, ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে বালি বা পূর্ব পাড়ে সোদপুর-ভাটপাড়ার মতো জায়গায় এটাই দস্তুর। আরও কত জায়গায় আকাশ কাল রাঙাবে পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, ময়ূরপঙ্খী, ঘড়িয়াল। বই-খাতাকে তিনদিনের জন্য মায়ের পায়ে সঁপে, ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে’ সেরে টোপাকুল মুখে দিয়ে ছেলেবুড়ো-মেয়ে, বউ— সব্বাই সোজা ছাদে আর পাঁই-পাঁই করে আকাশ-বাতাস ভরে উড়বে ঘুড়ি।

আরও পড়ুন- নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি

মানালি দে
আমাদের বাড়িটা নাচ-গান শিল্পচর্চার তাই আগাগোড়াই সরস্বতী পুজো হত। বাবা করতেন। পাড়াতেও পুজো হত। আগে পাড়ার দাদারা করত তারপর আমরা মেয়েরা মিলে করতাম। চাঁদা তোলা থেকে বাজার সব কিছু। পুজোর শেষে টাকা বেঁচে গেলে কোনও একজন বড় মেম্বারের বাড়িতে ওই টাকায় খাওয়াদাওয়া হত। খুব মজা করেছি। স্বাধীনতা পেয়েছি তখন থেকেই। নাচ শিখতাম বলে শাড়ি পরার অভ্যেস আমার আগেই ছিল কিন্তু সরস্বতী পুজোর দিনটা শাড়ি পরার একটা আলাদা মজা ছিল। হলুদ শাড়িটাই ভাল লাগত। এখন সবসময় হলুদ শাড়ি পরা হয় না কিন্তু হলুদ সালোয়ার অবশ্যই পরি। আর পাড়া আর বাড়ির পুজোয় এতটা বেশি যুক্ত থেকেছি কারও দিকে তাকাতে পারিনি তাই সেই চোখে- চোখে প্রেমটাও আমার হয়নি। আমি পড়াশুনোয় মোটেই ভাল ছিলাম না তাই পাছে কিছু ভুলভাল হয় তাই সরস্বতীর পুজোর আগে কোনওদিন কুল খাইনি! ওই সংস্কারটা আজও রয়ে গেছে।

সোনালি চৌধুরি
আমার কাছে সরস্বতী পুজো মানে একেবারে ছোটবেলায় নাচের স্কুলের পুজো। ঠাকুর আনা থেকে থেকে পুজোর যাবতীয় কাজ করতাম। তবে শাড়ি পরার অভ্যেসটা কিন্তু নাচের কারণে হয়ে গিয়েছিল। তাই শুধু সরস্বতী পুজোয় আলাদা করে কখনও শাড়ি পরিনি। বাসন্তী রঙের শাড়ি আমি পরবই। আমার মনে আছে সরস্বতী পুজোর দিন আমার বাড়ির টেলিফোনে রিং হবেই আর বাবা অথবা মা ফোনটা রিসিভ করত, ব্যস, উল্টোদিকে কেউ সাড়া দিত না। আমার একেবারেই স্বাধীনতা ছিল না। শুধু সরস্বতী পুজোর দিনটাই স্বাধীনতা পেতাম। ওইদিন সন্ধের পরে বাড়ি ঢুকলে বকা খেতাম না। একটা নাচের স্কুলে আমার এক বান্ধবী তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য খিচুড়ি লুকিয়ে রেখেছিল আর অন্যজন সেটা খেয়ে নেয় অজান্তে। সেই নিয়ে এক হুলস্থুল কাণ্ড হয়েছিল। কুল নিয়ে আমার বরাবর সংস্কার ছিল। আমি তখনও খেতাম না পুজোর আগে, আজও খাই না।

স্নেহা চ্যাটার্জি ভৌমিক
বাবা আমাকে ভীষণ স্বাধীনতা দিয়েছে ছোট থেকেই। একা সাইকেল করে টিউশন যেতাম তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেছি, পাড়ার পুজোতে আশপাশের এলাকার পুজো দেখতে গেছি। পাড়ার পুজোর সঙ্গে ওই বয়স থেকে খুব ইনভলভ ছিলাম। চাঁদা তুলেছি, বাজার করেছি। তখন পাড়ায় শুধু সরস্বতী পুজোই হত। তারপর স্কুলে যেতাম। আর প্রথম শাড়ি আমি সরস্বতী পুজোতেই পরেছি। খুব ডেঁপো ছিলাম। শাড়ি আর লিপস্টিক— দুটোই আমার ভাল লাগত। সরস্বতী পুজোর কুলে ছিল আমাদের ভীষণ লোভ। কত কুল চুরি করে খেয়েছি! লোকে বলত সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই— এ কান দিয়ে শুনে ওই কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। একমাত্র সরস্বতী পুজোতেই অঞ্জলি দিতাম কারণ দুর্গাপুজোয় ঘুম থেকেই উঠতে পারতাম না! যখন ডানা গজাল তখন তো সরস্বতী পুজো মানেই প্রেম। বন্ধুদের অনেক প্রেমের সাক্ষী থেকেছি। তবে সিরিয়াস প্রেমটা করেছি আমার বরের সঙ্গেই। যতদূর মনে পড়ছে প্রথম বছর সরস্বতী পুজোর দিন দুজনে বেলুড় আর দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলাম।

অন্বেষা হাজরা
আমার বাড়ি বর্ধমানে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত বাড়িতেই কেটেছে। ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোয় একটা বড় আনন্দ ছিল যে একটা দিন আমি শাড়ি পরতে পারব। ক্লাস ২-তে পড়ার সময় প্রথমবার শাড়ি পরেছিলাম। তাই ওইদিনটা আমার কাছে শাড়ি পরার দিনই হয়ে আছে। এরপর আমি হস্টেল চলে যাই। তখন সরস্বতী পুজোর দুটো দিন ছুটি দিলেই আমি বাড়ি ছুটতাম। ওই দুটো বাড়িতে যে কী করব বুঝেই উঠতে পারতাম না— এত আনন্দ হত। আলাদা করে নিজেকে কখনও পরাধীন মনে হয়নি। আমি খুব ঘরকুনো মেয়ে। পড়ার স্কুলের বাইরে বা এখন নিজের কাজের বাইরে কখনওই স্বাধীনতা উপভোগ করতে ভাল লাগেনি। সবসময় বাড়িতে সবার সঙ্গে থাকতেই ভাল লাগত। সরস্বতী পুজোর দিন দিদির স্কুলে ঘুরতে যেতাম। কুল নিয়ে কোনও সংস্কার ছিল না, দিব্যি খেয়েছি। তবে প্রেম আমার হয়নি কোনওদিন। আমার কখনও মনেও আসেনি। আসলে দু’দিনের জন্য এসে মনে হত আরও কত বেশি সময় বাড়ির সবার কাছাকাছি থাকা যায়। ওটাই আমার গভীর প্রেম। এখনও সরস্বতী পুজোর দিন মনটা ছুটি-ছুটি করে।

Latest article