শতবার্ষিক-স্মরণ পরিচালক অসিত সেন

অবিস্মণীয় কিছু ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অসিত সেন। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করলেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

দক্ষিণী চলচ্চিত্রে যিনি উত্তমকুমার তিনি হলেন শিবাজি গণেশন।  মাদ্রাজের (এখন চেন্নাই) সেই বাড়িতে সন্ধ্যায় পরিচালককে শিবাজি গণেশন হাজির করলেন তাঁর বাড়ির প্রোজেকশন থিয়েটার হলে। চিত্র পরিচালকের তখন ভিরমি খাওয়ার দশা। শিবাজি বললেন, “আই ওয়ান্ট টু শো ইউ মাই গীতা।” পরে আরও কিছু কথা জানালেন। “প্রতিদিন বাড়ি ফিরে এই প্রোজেকশন রুমে প্রথমেই আমি এই গীতা দেখি তারপর ভাল লাগলে অন্য ছবি দেখি।” শিবাজি গীতা শুরু করতে বললেন। এবার অবাক হওয়ার পালা পরিচালকের। বড় পর্দায় ভেসে উঠল সুচিত্রা সেনের মুখ। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির শেষ দৃশ্য দেখানো হল। পরিচালক বাক্যহারা। পরিচালকের অকপট স্বীকারোক্তি, “শিল্পীকে শিল্পীর এমন গভীর শ্রদ্ধা জানানোর উদাহরণ আর আছে কি?” যে পরিচালককে নিয়ে এই প্রস্তাবনা, তিনি হলেন পরিচালক অসিত সেন। নিজের আত্মজীবনীতে এমন ঘটনা জানিয়েছেন অসিত সেন।

আরও পড়ুন-হিটলারের প্রেমকাহিনি

পরিচালকের জন্ম ১৯২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিক্রমপুরে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় এলেন। ফটোগ্রাফির দিকে আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। তাঁর এক আত্মীয় বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রামানন্দ সেনগুপ্ত। সেই আত্মীয়র সঙ্গে নিয়মিত স্টুডিওতে যাতায়াত শুরু করেন। পরে ভারতলক্ষ্মী পিকচার্সের নির্মীয়মাণ ছবিতে ডি কে মেহেতার সহকারী চিত্রগ্রাহক রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন অসিত সেন। পরে রামানন্দ সেনগুপ্তের সহকারী হিসেবে ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে কাজ করলেন। প্রথমে তিনি কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করলেন এককভাবে। মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালি ও পাটনা ভ্রমণ করছেন, তা নিয়ে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরি করলেন। এই সময় তিনি গান্ধীজির সফরসঙ্গী ছিলেন। স্বাধীনভাবে পরিচালক হিসেবে যে ছবিটি নির্মাণ করলেন সেটি অসমীয়া ভাষায় নির্মিত ছবি ‘বিপ্লবী’ (১৯৪৮)। সেই সময়ে অসিত সেন আসামে থাকতেন। সেখানকার কৃষ্ণা টকিজের মালিক চেয়েছিলেন একটি ছবি করতে। সেই সূত্রেই ছবিটি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন-দেশের রাজনৈতিক মহলের লক্ষ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস করা, আক্ষেপ করলেন রামান্না

স্বাধীনভাবে বাংলায় ছবি করতে এলেন অসিত সেন ১৯৫৬ সালে। ছবির নাম ‘চলাচল’। প্রযোজক বিদ্যাভূষণ অসিত সেনকে দিয়ে পরপর দুটি ছবি করালেন। প্রথমটি চলাচল, দ্বিতীয়টি পঞ্চতপা। দুটি ছবির নায়িকা অরুন্ধতী দেবী। দুটি ছবিই বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। প্রথম ছবিটিতে অরুন্ধতীর বিপরীতে অসিতবরণ, নির্মলকুমার। দ্বিতীয়টিতে অরুন্ধতীর বিপরীতে অসিতবরণ, প্রশান্তকুমার। অসিত সেনের প্রথম চারটি ছবিরই কাহিনিকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়— চলাচল, পঞ্চতপা, জীবনতৃষ্ণা এবং দীপ জ্বেলে যাই। জীবনতৃষ্ণা ছবির যখন প্রাথমিক কাজকর্ম চলছে তখন রাজনাথ চরিত্রে উত্তমকুমার এবং শকুন্তলার চরিত্র অরুন্ধতী দেবীকে ঠিক করা হল। ডেট ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর জানা গেল অরুন্ধতী বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে কাবুলিওয়ালা ছবির নির্মাতাদের সঙ্গে গেছেন। অসিত সেন একটু অবাকই হলেন। কারণ কাবুলিওয়ালা ছবিটিতে তো অরুন্ধতী নেই। তা হলে কী কারণে যাওয়া? পরে বিষয়টি স্পষ্ট হল যে, অরুন্ধতী দেবী তাঁর প্রথম স্বামী পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর তপন সিংহের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। অরুন্ধতী না থাকলেও শুটিং তো বন্ধ হতে পারে না। তখন সুচিত্রা সেনের কাছে প্রস্তাব রাখা হল শকুন্তলা চরিত্রের জন্য। প্রথমে তিনি সম্মত হননি। পরে স্বামী দিবানাথ সেনের পরামর্শে নায়িকা হলেন জীবনতৃষ্ণা ছবিতে। সুচিত্রা-উত্তম জুটির আরেকটি সুপারহিট ছবি এই জীবনতৃষ্ণা। জীবনতৃষ্ণা ছবির প্রযোজক রাখালচন্দ্র সাহা অসিত সেনকে নিয়ে আরেকটি ছবি তৈরি করতে শুরু করলেন। বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘নার্স মিত্র’ অবলম্বনে ছবি করলেন অসিত সেন দীপ জেলে যাই। এক মানসিক হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গল্পটি। হাসপাতালের প্রধান (পাহাড়ী সান্যাল)। তাঁর অধীনে নার্স রাধা মিত্রকে (সুচিত্রা সেন) দায়িত্ব দিলেন প্রেমে বঞ্চিত তাপসকে (বসন্ত চৌধুরি) প্রেমের অভিনয় করে সুস্থ করে তুলতে।

আরও পড়ুন-দেশের রাজনৈতিক মহলের লক্ষ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস করা, আক্ষেপ করলেন রামান্না

কিন্তু তার কী পরিণাম হতে পারে তা তিনি ভেবে দেখেননি। সেই মর্মস্পর্শী গল্পের শেষে রাধা মিত্র নিজেই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন! সেই অভিনয়ে সুচিত্রা সেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এই ছবি নিয়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে অসিত সেনের জীবনে। প্রযোজক রাখালচন্দ্র সাহা বারংবার পরিচালককে পীড়াপীড়ি করেছিলেন যে সুচিত্রা সেন একা একটা ছবি টানতে পারবেন না। উত্তমকুমারকে সঙ্গে নিন। এই গল্পে উত্তমকুমারের জায়গা কোথায়, তাই সে প্রস্তাব খারিজ হল। ছবি যখন সুপারহিট হল, তখন প্রমাণিত হল যে নিজের কাঁধে একা নিয়ে একটি ছবি সুচিত্রা সেন সুপারহিট করাতে পারেন। দীপ জ্বেলে যাই ছবিতে থিম সং-এর প্রয়োজন হয়েছিল নায়িকার জন্য। ছবিতে নায়িকার আবার একটা স্মৃতি আছে। পূর্ব-প্রেমিক দেবাশিসকে ঘিরে। সেই স্মৃতি গানের আকারে ফিরে ফিরে আসে। গানটি হল— ‘এই রাত তোমার আমার”। সুরকার ও গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্তবাবুর সঙ্গে অসিত সেন আলোচনা করে একটা উপায় বার করলেন যে গানের প্রিলুডে একটি শিস ব্যবহার করা হবে। সেই শিসের শব্দে আলোড়িত হবে দর্শকের মন। গানটা আছে দেবাশিসের চরিত্রটির জন্য। যে মানুষটি রয়েছে ব্যাক টু ক্যামেরা। যেদিন এ দৃশ্যের শুটিং সেদিন মেক-আপ রুমে সুচিত্রা সেন তলব করলেন পরিচালককে— ‘‘দেবাশিস কে করছে?” পরিচালক বলেন, ‘‘একজনকে ঠিক করা হয়েছে। কাঁধের গড়নটা ভাল। ব্যাক টু ক্যামেরায় চলে যাবে।” সুচিত্রা সেন রেগে উঠে বললেন— ‘‘যাকে-তাকে দিয়ে তুমি দেবাশিস করবে? আমি করব না। রাস্তা থেকে যাকে-তাকে ধরে আনবে, তার সঙ্গে রোম্যান্টিক অভিনয় করতে পারব না!” মহামুশকিলে পড়লেন পরিচালক। সুচিত্রা সেন প্রস্তাব দিলেন, ‘‘ওই দেবাশিস তুমি করবে।” পাহাড়ী সান্যাল সমর্থন করলেন বিষয়টিকে। বড় পর্দায় সেই প্রথম ও শেষ অভিনয় অসিত সেনের।

আরও পড়ুন-বাড়ির সামনে গুলি, খুন তৃণমূল কর্মী

অসিত সেন পরিচালিত অন্য ছবিগুলি হল— স্বয়ম্বরা, স্বরলিপি, জোনাকির আলো, আগুন, উত্তরফাল্গুনী, তৃষ্ণা, প্রার্থনা, প্রতিজ্ঞা। পাশাপাশি হিন্দিতে তাঁর পরিচালিত ছবিগুলি হল মমতা (উত্তরফাল্গুনী ছবির হিন্দি), খামোশি (দীপ জেলে যাই ছবির হিন্দি), সফর (চলাচলের হিন্দি), শরাফৎ, মা ঔর মমতা, অন্নদাতা, পরিবার, আনোখা দান, আনাড়ি, বৈরাগ, অপরাধী কৌন, উকিলবাবু, মেহেন্দি প্রভৃতি। বম্বেতে বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন— দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্র, হেমা মালিনী, সায়রা বানু, জিনাত আমান, শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ী, মৌসুমি চ্যাটার্জি, লীনা চন্দ্রভারকর প্রমুখ। মেহেন্দি তাঁর হিন্দিতে শেষ ছবি। ১৯৮৩ সালে বোম্বের পাট চুকিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়।

আরও পড়ুন-লারার রেকর্ড ভেঙে দিলেন বুমরা

কলকাতায় এসে প্রার্থনা এবং প্রতিজ্ঞা ছবি দুটি করলেন ঠিকই, কিন্তু সেই অসিত সেনকে আমরা খুঁজে পেলাম না। কলকাতা দূরদর্শনের জন্য কয়েকটি টেলি সিরিয়াল পরিচালনা করেছিলেন। এই সময়ে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ‘নটী বিনোদিনী’ ছবি করার তোড়জোড় করেছিলেন তবে সেটা বাস্তবায়িত হয়নি একমাত্র সন্তান পার্থর জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্ত্রী রেখা সেনকে হারান। আর বিয়ে করেননি। নাকতলা ফ্ল্যাটে শেষ জীবনে তিনি আর তাঁর দিদি থাকতেন। ২০০১ সালের ২৫ মার্চ কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের জন্য এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর। সেটি সম্প্রচারিত হয় ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর রবিবার এবং ৯ সেপ্টেম্বর রবিবার। তিনি অবশ্য টেলিকাস্ট দেখে যেতে পারেননি। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০০১ সালের ২৪ আগস্ট। বাংলা-হিন্দি ছবির পরিচালক হিসেবে তাঁর চলচ্চিত্রজীবন নিয়ে অসাধারণ স্মৃতিকথা তিনি লিখেছেন ‘স্মৃতির সোনালি লেখা’। স্মৃতি সততই সুখের। তারই হদিশ পাওয়া যায় বইটিতে। তিনি চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় কিছু ছবি। সেই মহান পরিচালকের উদ্দেশে রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Latest article