প্রতি বছরেই জরায়ুর মুখের ক্যানসার সচেতনতা মাস পালনের একটা থিম থাকে। ২০২৫-এর সার্ভাইকাল ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস মাসের থিম হল— ‘We Can Prevent Cervical Cancer’. ন্যাশনাল সার্ভাইকাল ক্যানসার কোয়ালিশন (NCCC) সারাবছর ধরেই এই ক্যান্সার নিয়ে প্রচার কর্মসূচি চালায় তথাপি বছরের প্রথম মাসটাকে তারা বেছে নিয়েছে আর বেশি করে এই কর্মসূচিতে মানুষকে যোগদান করানোর কাজকে ফলপ্রসূ করতে। কারণ এই রোগটাকে ধরতে হলে শুধুমাত্র সচেতনতা এবং পর্যবেক্ষণটাই জরুরি।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এই মাসে কী কী ভাবে এই সার্ভাইক্যাল ক্যানসার সচেতনতায় যোগদান করতে পারেন
নিয়মিত স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা। অর্থাৎ বছরে সময় এবং নিয়ম মেনে এই পরীক্ষা অবশ্যই করান।
সার্ভাইকাল ক্যানসার সম্পর্কে আরও বেশি করে মানুষকে জানানো। এই সংক্রান্ত তথ্য শেয়ার করুন। কারণ রোগটা সম্পর্কে আজও বহু মানুষ ওয়াকিবহাল নন।
এইচপিভি টিকাকরণকে সমর্থন করুন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার করুন। যাঁদের এই ভ্যাকসিনের প্রয়োজন তাঁদের দেওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।
কিছু বিষয় যা জানা আবশ্যিক
সার্ভাইকাল ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। শুধু জরুরি সময়মতো ধরা-পড়া এবং টিকাকরণ।
২১ বছরের পর থেকে মহিলাদের প্রতি ৩ বছর অন্তর প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করা জরুরি। এই পরীক্ষাতেই রোগটি ধরা পড়ে।
৬৫ বছরের পরে আর সার্ভাইকাল ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের দরকার নেই যদি তার আগে পর্যন্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসে থাকে।
সার্ভাইকাল ক্যানসার কী
৯৯% শতাংশ সার্ভাইকাল ক্যানসারের কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। এইচ ভিপি। যা যৌন সংস্রবের মাধ্যমেই ছড়ায়। এই ক্যানসারকে জানতে হলে আগে ফিমেল জেনিটাল ট্র্যাক্টর অ্যানাটমিটা জানতে হবে। এই অংশের উপরে থাকে ইউট্রাস। যেটি ফাঁপা। সন্তানসম্ভবা হলে ন-মাস পর্যন্ত শিশু ওই ফাঁপা অংশেই থাকে। ওর নিচেই থাকে ইউটেরাইন ওপেনিং বা জরায়ুর মুখ। এই মুখটা ওপেন হয় নিচের দিকে ভ্যাজাইনাল ক্যানালে বা জন্মনালিতে। ওই জরায়ুর মুখে যখন ক্যানসার হয় তাকে সার্ভাইকাল ক্যানসার বলে। এর কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। মূলত যৌনবাহিত রোগ। যৌনসংস্রবের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি একজনের শরীর থেকে আর একজনের শরীরে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমরা অটল: বছর শেষে বার্তা অভিষেকের
কাদের রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি
মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে বা সন্তানধারণ করলে রিস্ক বাড়ে।
কোনও মহিলার একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে বা কোনও পুরুষের একাধিক মহিলাসঙ্গী থাকলে। কোনও মহিলা যিনি একাধিক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যদি কোনও মহিলা পাঁচ বছরের বেশি জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি খেয়ে থাকেন। ধূমপান একটা বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। যাঁদের রোগ-প্রতিরোধ শক্তি কম। যদি কারও এইচআইভি সংক্রমণ হয়ে থাকে।
সার্ভাইকাল ক্যানসারকে তিনটে স্টেজে ভাগ করা হয়। প্রি-ক্যানসার স্টেজ যখন ক্যানসার হবার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু হয়নি। আর্লি স্টেজ যখন রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকতে পারে এবং লেট স্টেজে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলো হল প্রচুর ব্লিডিং, মেস্ট্রুয়াল সাইকেলের সময় বেড়ে যাওয়া, যৌনসংস্রবের পর রক্তপাত বা ব্লিডিং, তীব্র গন্ধযুক্ত যোনিস্রাব, মেনোপজের পরে রক্তপাত, ওজন কমে যাওয়া বা খুব বেড়ে যাওয়া, দুর্বলতা ইত্যাদি।
রোগ ছড়ালে ব্যথা হতে পারে, ব্লাডারে ছড়িয়ে পড়লে সেই সম্পর্কিত সমস্যা দেখা যায়। ইউরিন ধরে রাখতে না পারা, বারবার ইউরিন। রেকটামে ছড়ালে সেখান থেকেও ব্লিডিং হতে পারে।
এছাড়া কিছু লক্ষণ রয়েছে যা দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে জরায়ুর মুখে ক্যানসার হয়েছে। যেমন গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়ারিয়া হতে পারে। হালকা খাবারের পর পেট ভর্তি লাগা, পেটে অস্বস্তি লাগা ইত্যাদি পেটের কোনও সমস্যা খুব বেশি হলে তা জরায়ু-মুখের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।
সুইডেনের ক্যারোলিনক্সা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক জানিয়েছেন, মানসিক সমস্যা বা স্নায়ুর সঙ্গে যুক্ত মনের রোগে আক্রান্ত নারীদেরও জরায়ু-মুখে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। মেয়েদের জরায়ু-মুখে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে কোন স্টেজে রয়েছে তার ওপর। প্রি-ক্যানসারাস স্টেজের এক ধরনের চিকিৎসা। লক্ষণের ওপর নির্ভর করে ব্যথানাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। আর্লি স্টেজে সার্জারি বা রেডিওথেরাপি দুটোই করা হয়। এ ছাড়া অ্যাডভান্সড স্টেজে কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি করা হয়ে থাকে। অপারেশনের ক্ষেত্রে হয়ে যাবার পর নিয়মিত ফলো-আপ জরুরি। তিন মাস অন্তর প্রথম এক বছর, ছয় মাস অন্তর পরের এক বছর ও এরপর এক বছর অন্তর-অন্তর ফলো-আপ করাতে হবে।
আরও পড়ুন-বর্ষবরণে মাতোয়ারা বাংলা
সার্ভাইক্যাল ক্যানসার প্রতিরোধে
দশ বছর বয়স থেকেই এই ক্যানসার প্রতিরোধক টিকা নেওয়া যায়। একবার ক্যানসার হয়ে গেলে টিকা কোনও কাজে আসে না। তিনটে ডোজ রয়েছে। প্রথমটির এক মাস পরে দ্বিতীয় টিকা এবং তারও পাঁচ অর্থাৎ প্রথমটির ছয় মাস পরে তৃতীয় ডোজের টিকা নিতে হয়। তবে এটাও ঠিক টিকাকরণ এই ক্যানসারকে একশোভাগ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
কিন্তু নিয়মিত চেকআপ ও ‘প্যাপস্মিয়ার’ টেস্টে জরায়ু-মুখের ক্যানসারজনিত কোনও পরিবর্তন হলে তা ধরে ফেলা সম্ভব।