কথামুখ
যে শিল্পীর কথা বলতে বসেছি তিনি সাজতে খুবই ভালবাসতেন। এমনিতেই তিনি অপরূপ সুন্দর দেখতে। অল্প বয়সে তাঁর মতো সুন্দরী নায়িকা ছিল না বললেই চলে। স্বাভাবিক সৌন্দর্য মেকআপ, সাজ-সজ্জার সাহায্যেই তিনি আরও ফুটিয়ে তুলতেন। এজন্য স্টুডিওতে তাঁর অনেকটা সময় ব্যয় করতে হত। স্টুডিওতে ঢুকেই তিনি এতটুকু সময় নষ্ট না করে সোজা মেকআপ রুমে চলে যেতেন। তারপর মেকআপ-ম্যানের হাতে নিজের মুখটি সঁপে দিতেন। একঘণ্টা দুঘণ্টা জুড়ে মেকাপের কাজ চলত। না হলে মেকআপ-ম্যানের রেহাই ছিল না। শেষ টাচটা অবশ্য তিনি নিজেই দিতেন। নায়িকা থাকাকালীন তো বটেই এমনকী যখন তিনি চরিত্রাভিনয়ে চলে গেলেন তখনও মেকাপের এই বাতিক তিনি ছাড়েননি। কোনও কোনও সময় মনে হয়েছে তিনি নায়কের মা নন, তিনি নায়কের দিদি বুঝি। গোলমাল বাধল একটি ছবিকে কেন্দ্র করে। আউটডোর-নির্ভর ছবি। সব শিল্পী মুখে একটু প্যারাফিন লাগিয়ে তৈরি হতেন যাতে তাঁদের মুখটা তেলতেলে দেখায়। ছবির ইন্ডোর শ্যুটিং শুরু হল। তখন তিনি প্রায় রোজই হালকা বেসের উপর অল্প পাউডার দিয়ে চলে আসতেন। ফ্লোরে পরিচালকের নজর এড়াতে চাইতেন। বলতেন, ‘‘একবার ঢুকে পড়বার সময় পরিচালকের নজর এড়াতে পারলেই হয়।” কিন্তু পরিচালকও তেমনি কড়া। মেকআপম্যানকে ডেকে মেকআপ তুলে প্যারাফিন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। একদিন অভিনেত্রীকে পরিচালক বললেন, ‘‘ম্যাডাম রোজ রোজ সবার সামনে কচি মেয়ের মতো ধমক দিয়ে আপনার মেকআপ তুলে দিতে হয়। আপনার মনে হয় না যে আর কখনও করবেন না।” কচি মেয়ের মতো মিষ্টি হেসে শিল্পী তখন বলতে থাকেন, ‘‘মেকআপ না করলে যে শ্যুটিং করছি মনেই হবে না। কতদিনকার অভ্যাস বলুন তো। আমি রোজ একটু-আধটু মেকআপ করেই আসব। আপনিও রোজ সেগুলো তুলে দেবেন।” এরপর আর কোনও কথা চলে না। যে শিল্পী আর পরিচালকের কথা বলছিলাম সেই শিল্পী হলেন চন্দ্রাবতী দেবী। আর পরিচালক হলেন বিকাশ রায়। ছবির নাম ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। সেখানে অবধূত-এর চরিত্রে বিকাশ রায় আর ভৈরবীর চরিত্রে চন্দ্রাবতী দেবী।
জীবনকথা
চন্দ্রাবতী দেবীর জন্ম ১৯০৯ সালের ১৯ অক্টোবর মজফফরপুর শহরে। পিতা গঙ্গাপ্রসাদ সাউ মজফফরপুরের জমিদার ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষা কলকাতায়। স্কুলজীবন কাটিয়েছেন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। কলেজজীবন কাটিয়েছেন বেথুন কলেজে। ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ও তাঁর দিদি কঙ্কাবতী দেবীকে (পরবর্তীকালে খ্যাতনামা অভিনেত্রী) জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠাতেন। বেথুন কলেজে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তাঁরা দুই বোন সংগীতশিক্ষা করেন। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। স্বয়ং শরৎচন্দ্রের স্নেহধন্যা ছিলেন তিনি। কঙ্কাবতী দেবীর স্বামী শিশিরকুমার ভাদুড়ীর স্নেহধন্যা ছিলেন চন্দ্রাবতী। ১৯২৯ সালে তিনি অন্যতম প্রযোজক হিসেবে একটি ছবি তৈরি করলেন। ছবির নাম ‘পিয়ারী’। নির্বাক ছবি। তিনি নায়িকার ভূমিকাতে ছিলেন। ‘বায়োস্কোপ’ পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক বিমল পালের সঙ্গে চন্দ্রাবতী পার্টনারশিপে ‘মুভি প্রডিউসারস’ নামে যে সংস্থা (শ্যামবাজারের এক নম্বর ন্যায়রত্ন লেন) গঠন করেছিলেন সেই ব্যানারের ছবি পিয়ারি। ইতিমধ্যে বিমলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছে। সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তখন চন্দ্রাবতীকে নিউ থিয়েটার্স নিয়ে এলেন বিখ্যাত পরিচালক অভিনেতা অমর মল্লিক। দেবকীকুমার বসু তখনকার নির্মীয়মাণ ‘মীরাবাঈ’ ছবির জন্য নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন । নিউ থিয়েটার্স-এর কর্ণধার বীরেন্দ্রনাথ সরকার ও অমর মল্লিকের উৎসাহে চন্দ্রাবতীকে নির্বাচন করলেন দেবকীকুমার বসু মীরাবাঈ চরিত্রের জন্য। গানে এবং অভিনয়ে চরম সাফল্য পান চন্দ্রাবতী। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি চন্দ্রাবতীকে।
তাঁর ছবির কথা
স্বনামধন্য নায়ক ও নির্দেশক প্রমথেশ বড়ুয়া যখন নিউ থিয়েটার্স-এর ‘দেবদাস’ ছবি করছেন তখন তিনি চন্দ্রমুখী চরিত্রের জন্য চন্দ্রাবতীকে নির্বাচন করলেন। চন্দ্রাবতীর নিজের অবশ্য পছন্দ ছিল পার্বতী চরিত্রটি। কিন্তু প্রমথেশ তাঁর চিত্রনাট্যে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন চন্দ্রমুখী চরিত্রটির। সেই যুগের বাম্পার হিট ছবি দেবদাস। চন্দ্রমুখী চরিত্রে চন্দ্রাবতীর অভিনয় দেখে স্বয়ং শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘আমার রচনার চেয়ে অনেক বেশি সতেজ হয়েছে তোমার অভিনয়।’ নিউ থিয়েটার্স-এর ব্যানারে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ‘বিজয়া’। নাম ভূমিকায় সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন চন্দ্রাবতী। নিউ থিয়েটার্স-এর দ্বিভাষী ছবি দিদি (হিন্দিতে প্রেসিডেন্ট) চন্দ্রাবতীর অমর সৃষ্টি। নাম ভূমিকায় এখানেও তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করলেন। ১৯৪০ সালে ‘শুকতারা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নায়িকার স্বীকৃতি লাভ করলেন ‘বঙ্গীয় চিত্রসাংবাদিক সংস্থা’র বিচারে। ১৯৪৩ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবির জন্য আবারও নায়িকা শ্রীমতী চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে শ্রেষ্ঠ নায়িকা নির্বাচিত হলেন ‘বঙ্গীয় চিত্রসাংবাদিক সংস্থা’র বিচারে। ১৯৪৫ সালে ‘দুই পুরুষ’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে তিনি ‘বিএফজেএ’র তরফ থেকে শ্রেষ্ঠ নায়িকা নির্বাচিত হন। নায়িকা থাকাকালীন চন্দ্রাবতী তাঁর বিপরীতে নায়ক হিসেবে পেয়েছেন প্রমথেশ বড়ুয়া, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কুন্দনলাল সায়গল, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, ধীরাজ ভট্টাচার্য, দেবী মুখোপাধ্যায়দের। তিনি প্রমাণ করেছিলেন বিভিন্ন নায়কের বিপরীতে তিনি কতখানি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল ছিলেন। ‘মীরাবাঈ’-এর চরম সাফল্যের জন্য বোম্বে থেকে আমন্ত্রণ আসে। সেখানে একটি ছবিতে অশোক কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি লাভ করেনি।
বিশিষ্ট পরিচালকদের সঙ্গে কাজ
দেবকীকুমার বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া শুধু নন, বাংলা ছবির বহু বিশিষ্ট পরিচালকদের ছবিতে তাঁর সময়ে চন্দ্রাবতী অভিনয় করেছেন। দেখে নেওয়া যাক সেই তালিকা : নীতীশ বসু (দিদি, দেশের মাটি), অগ্রদূত (অগ্নিপরীক্ষা, ত্রিযামা, পথে হলো দেরি), সুশীল মজুমদার (মনের মানুষ), অমর মল্লিক (দুর্গেশনন্দিনী), হেমচন্দ্র চন্দ্র (প্রতিশ্রুতি), মধু বসু (শেষের কবিতা), কার্তিক চট্টোপাধ্যায় (সাহেব বিবি গোলাম, চন্দ্রনাথ), সুবোধ মিত্র (দুই পুরুষ, রাইকমল), সুধীর মুখোপাধ্যায় (শশীবাবুর সংসার), বিকাশ রায় (মরুতীর্থ হিংলাজ, সূর্যমুখী, রাজা সাজা), অসিত সেন (চলাচল, পঞ্চতপা, দীপ জ্বেলে যাই), চিত্ত বসু (কঙ্কাবতীরঘাট, একটি রাত, পুত্রবধূ), যাত্রিক (ছিন্নপত্র), অজয় কর (হারানো সুর, কায়াহীনের কাহিনী), প্রভাত মুখোপাধ্যায় (বিচারক), নীরেন লাহিড়ী (ইন্দ্রাণী, ভোলা মাস্টার), মঙ্গল চক্রবর্তী (তাসের ঘর) পীযূষ বসু (জীবন জিজ্ঞাসা), বিজয় বসু (ফরিয়াদ), অজিত গাঙ্গুলি (অগ্নিভ্রমর), অজিত লাহিড়ী (আটাত্তর দিন পরে), স্বদেশ সরকার (জীবন সৈকতে), প্রফুল্ল চক্রবর্তী (সখের চোর), পীযূষ গাঙ্গুলি (নয়া মিছিল), সুশীল মুখোপাধ্যায় (আমি সিরাজের বেগম, রোদন ভরা বসন্ত), কনক মুখোপাধ্যায় (এ জহর সে জহর নয়) প্রমুখ পরিচালক। সত্যজিৎ রায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে অভিনয় করেছিলেন ‘পরশপাথর’ ছবিতে একটি পার্টির দৃশ্যে।
চরিত্রাভিনয়ে তাঁর সাফল্য
নায়িকা থাকতে থাকতেই চরিত্রাভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন চন্দ্রাবতী দেবী। ফলে বহু সুপার হিট ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটে রেখেছে। দাপটের সঙ্গে পর্দার বুকেও বিরাজ করে গেছেন। জীবন্ত করে তুলেছেন প্রতিটি চরিত্রকে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে নায়িকা তাপসীর (সুচিত্রা সেন) শহুরে অভিজাত মায়ের চরিত্রে অন্য চন্দ্রাবতী। নাবালিকা মেয়ের বিয়ের পুতুল খেলাকে মানতে পারেন না। ‘পুত্রবধূ’ ছবিতে তিনি দিলীপের (উত্তমকুমার) রক্ষণশীল মা যিনি শুক্লার (মালা সিনহা) সঙ্গে ছেলের বিয়ে বরদাস্ত করতে পারেন না। ‘শশী বাবুর সংসার’ ছবিতে তিনি শশীবাবুর (ছবি বিশ্বাস) স্ত্রী যিনি স্বামী ও সন্তানদের মধ্যে সংযোগ সাধন করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। ‘হারানো সুর’ ছবিতে তিনি অলকের (উত্তমকুমার) মা, গভর্নেস রমাকে (সুচিত্রা সেন) সহজে মেনে নিতে পারেন না। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে তিনি উন্মাদদের হসপিটালের মেট্রন। ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে সরযূর (সুচিত্রা সেন) হতভাগিনী মায়ের চরিত্রে। তিনি ‘ফরিয়াদ’ ছবিতেও রত্নমালার (সুচিত্রা সেন) অসহায় মা। তিনি ‘জয়জয়ন্তী’ ছবিতে সঞ্জয়ের (উত্তমকুমার) ঠাকুমা যিনি হুইলচেয়ারে বসে সবকিছু তত্ত্বাবধান করেন। ‘ছিন্নপত্র’ ছবিতে তিনি প্রবীরকে (উত্তমকুমার) নিযুক্ত করেন তাঁর পুত্রের মৃত্যুর তদন্ত করতে। ‘জীবনজিজ্ঞাসা’ ছবিতে তিনি ইন্দ্রনীলের (উত্তমকুমার) ঠাকুরমা যিনি গর্ভবতী রাধাকে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়ি থেকে বার করে দিতেও দ্বিধাগ্রস্ত হন না।
অন্যান্য গুণপনা
চন্দ্রাবতী দেবী, কানন দেবী, মলিনা দেবী, ভারতী দেবী, সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে তৈরি করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। চন্দ্রাবতী (Chandraboti Devi) ছিলেন প্রেসিডেন্ট। দুঃস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে এটি গঠিত হয়েছিল। মহিলা শিল্পীমহলের তরফ থেকে অভিনীত হয়েছিল মিশরকুমারী, আলিবাবা প্রভৃতি নাটক। কিন্তু কানন দেবীর সঙ্গে চন্দ্রাবতী দেবীর মতপার্থক্য হেতু ওই মহিলা শিল্পীমহল স্থায়িত্ব পায়নি। সুধাকণ্ঠ চন্দ্রাবতী দেবী একসময় বহু ছবিতে গান গেয়েছেন এবং অনেক জনপ্রিয় গানের রেকর্ড বেরিয়েছে। বাংলা ছবির প্রথম প্রযোজক অবশ্যই চন্দ্রাবতী দেবী। ছবির নাম ‘পিয়ারী’ (১৯২৯)। এদিক থেকে বিচার করলে প্রতিভা শাসমলকে কোনওভাবেই প্রথম মহিলা প্রযোজক বলা যাবে না কারণ তাঁর প্রযোজিত ‘নিবেদিতা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৬ সালে। মহিলা হিসেবে নেপথ্যে থেকে প্রথম পত্রিকা প্রকাশ চন্দ্রাবতীর। পত্রিকার নাম ‘বায়োস্কোপ’। চন্দ্রাবতী প্রথম প্রেক্ষাগৃহের মহিলা স্বত্বাধিকারী। সিনেমা হলের নাম ‘টকি শো হাউস’। (শিবদাস ভাদুড়ী স্ট্রিটে অবস্থিত)। চন্দ্রাবতী দেবীর সাহায্যে সুপ্রিয়া দেবী প্রথম সুযোগ পান নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘নাগপাশ’ ছবিতে অভিনয় করার। ‘চন্দ্রাবতী দেবী (Chandraboti Devi) বলছি’ বলে তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থটি সুখপাঠ্যই বটে।
না-ফেরার দেশে গমন
সেই চন্দ্রাবতী দেবী এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান ১৯৯২ সালের ২৯ এপ্রিল। তিনি চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর অভিনয়দৃপ্ত অসংখ্য ছবি, যা বাংলা ছবির স্বর্ণযুগকেই সমৃদ্ধ করেছে অনায়াসে।