সদ্য বছরের সেরা বিয়েটির সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব। ধনকুবের মুকেশ আম্বানি এবং নীতা আম্বানির কনিষ্ঠ সন্তান অনন্ত আম্বানির বিয়ে হয়ে গেল। গ্র্যান্ড প্রি-ওয়েডিং সেলিব্রেশন থেকে ওয়েডিং এবং পোস্ট ওয়েডিং সেলিব্রেশন দেখে ধাঁধিয়ে গেছে সবার চোখ। এমন এক জমকালো বিবাহপর্বে সবার নজর কাড়ল মুকেশের স্ত্রী নীতা আম্বানির ট্রাডিশনাল এক্সক্লুসিভ লুক। তার কারণ নীতার গয়না।
সবচেয়ে বেশি চর্চিত হল নীতা আম্বানির গলার পান্না আর হীরকখচিত স্টেটমেন্ট জুয়েলারিটির। যে জুয়েলারির রেপ্লিকাও ইতিমধ্যেই ছেয়ে গেছে বাজারে। ট্র্যাডিশন আর আধুনিকতার সুন্দর এক সংমিশ্রণ ওই বিয়ে। ডিজাইনার বাঁধনি শাড়ি আর নানাধরনের ট্র্যাডিশনাল লেহেঙ্গা সঙ্গে কানে, গলায়, হাতে হীরে, পোলকি, পান্না, রুবিখচিত ভারী ভারী সাবেক এবং আধুনিকতার মিশেলে তৈরি কাস্টমাইজড গয়না এবং কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক গয়নাও পরেছেন নীতা এবং আম্বানি পরিবারের মহিলারা। এটা দেখেই বোঝা যায় বিয়ের সাজ-পোশাক গয়না সবেরই ট্রেন্ডটা আসলে কোনদিকে।
গয়নার ভোলবদল
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বিয়ের বাজারে সবচেয়ে পালাবদল এসছে গয়নাতে। বিগ বাজেটের বিয়ে হোক হোক বা সাধারণ বাজেটের সলিড সোনার সাবেক বা আধুনিক গয়নার বদলে মণি, মুক্তা, জড়োয়া, পোলকিকুন্দন, হীরকখচিত গয়নার চাহিদাই বেশি দেখা যাচ্ছে যা ইদানীং ওয়েডিং জুয়েলারি নামে পরিচিত। ট্র্যাডিশন আর নান্দনিকতার যদি বিতর্ক বাঁধে তবে গয়নার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে নান্দনিক অলঙ্কার। কনে সাজে এস্থেটিক কম্বিনেশনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন আধুনিক কনেরা। তাই বেশিরভাগ বিয়ের কনের পরনে দেখা মিলছে ডিজাইনার ওয়েডিং জুয়েলারির। বদলে গেছের বাঙালি বিয়ের বাঙালিয়ানাও। বাঙালি বিয়ের ক্ষেত্রে এতদিন ঐতিহ্য আর সেন্টিমেন্টটাই কনে সাজের আসল রসদ ছিল সেখানে তাঁরাও যুগের হাওয়াতেই গা ভাসাচ্ছেন। ব্যক্তিত্ব, রূপ, রং অনুযায়ী কনেসাজে উপস্থিত করছেন নিজেকে। ফলে গয়না পোশাক এখন সবটাই হয়ে উঠছে কাস্টমাইজড। বিয়ে মানেই লাল বেনারসি আর সোনার গয়না এ কনসেপ্ট উধাও।
আরও পড়ুন-বাঙালির বিয়ের ভোজবাদ
বলিউডি বিয়ের প্রভাব
বাঙালিরা বরাবরই ট্রাডিশন আঁকড়ে পড়ে থাকা এক জাতি। তাই যত আধুনিক কনেই হন না কেন বিয়েতে লাল বেনারসি আর ভারী সোনার গয়না পরতেই পছন্দ করতেন তাঁরা। সেই বাঙালি বিয়েতেই এখন প্রাদেশিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। বহিরাগত সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিয়েছেন তাঁরা। এর মূল কারণ হল বলিউডের হেভিওয়েট কনেরা। সেলিব্রিটি বিয়ের ট্রেন্ডেই এই পালাবদল। ডেস্টিনেশন ওয়েডিং, লেহেঙ্গা চোলি থেকে গীত সঙ্গীত, ভারী ব্রাইডাল গয়না— সবটাকেই আত্মস্থ করেছেন বাঙালি কনে। আর নিজের বিয়ের পুরো প্ল্যান সাজাচ্ছেন তেমন করেই। যেসব সেলিব্রিট্রির বিয়ের গয়না ট্রেন্ডসেট করেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অভিনেত্রী কিয়ারা আদবানি। কিয়ারা নিজের মেহেন্দি আর বিয়ের, অনুষ্ঠানের সাজ আর গয়না ছিল মনভোলানো। তাঁর জুয়েলারির মধ্যে পোলকি আর জড়োয়ার চোকার নেকপিস আর পিঙ্ক রুবিখচিত রানিহার সবার নজর কেড়েছিল। আবার কিয়ারা নিজের বিয়ের সঙ্গীত অনুষ্ঠানে পরেছিলেন সিঙ্গল স্টোনের স্লিক হীরের গয়না।
হোয়াইট আর গোল্ডের কম্বিনেশন পপুলার হয়েছে ২০২২ থেকে। বিশেষ করে যখন অভিনেত্রী আলিয়া ভাট নিজের বিয়েতে এই কম্বিনেশনকেই প্রাধান্য দিলেন। তাঁর বিয়ের ডিজাইনার আউটফিটের কম্বিনেশন ছিল সেই পপুলার সাদা আর সোনালি কালার প্যালেটেই। তাঁর কনে-সাজের আসল আকর্ষণ ছিল হোয়াইট আর গোল্ডের কনট্রাস্টেই পোলকি আর সোনার চওড়া নেকপিস, কড়হা, স্টাইলিশ মাঙ্গটিকা।
অভিনেত্রী ক্যাটরিনা কাইফের ব্রাইডাল ওয়্যারের সঙ্গে ভিন্টেজ লুকের ভারী চোকার স্টাইল নেকলেস, ঝুমকা এবং টু লেয়ারড মাঙ্গটিকার সাজ ছিল দুর্দান্ত। সবগুলোই পোলকি আর সোনার কম্বিনেশনে। এনগেজমেন্টে ক্যাট পরেছিলেন ডায়মন্ড, ওপাল আর রাশিয়ান এমারেল্ডের চোকার।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বিয়ের গয়নায় ছিল মাল্টিলেয়ারড, সিলভার এবং ডায়মন্ডের ময়ূর হার। কাজেই আজকে আধুনিকাদের মধ্যে সেলিব্রিটিরাই গয়নার ট্রেন্ডসেটার হিসেবে হাজির হয়েছে। পাশাপাশি এখন কন্টেম্পরারি জুয়েলারিতে অপশনেরও ছড়াছড়ি। কাজেই নিজের রুচি পছন্দের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পোশাক থেকে গয়না নির্বাচন করছেন আধুনিক কনে। মা-ঠাকুমার বা বাবা-মার দেওয়া সোনার কানের গলার আলমারির লকারে তুলে রেখে দিচ্ছেন আশীর্বাদী হিসেবে।
সোনা স্ত্রীধন
তা হলে প্রশ্ন হল আধুনিক কনেরা কি তবে ট্র্যাডিশন আর নান্দনিকতার মধ্যবর্তী একটা কনফিউশনে ভুগছেন? কারণ ট্র্যাডিশনের চেয়ে বড় কিছু তো নেই কিন্তু তাহলে নান্দনিকতা? সেটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিয়েতে সোনার গয়নার আধিপত্য। সোনার গয়না শুধু আভরণ নয়, সোনা সরাসরি বিত্ত, মা লক্ষ্মী, কুবেরের প্রতীক তাই উৎসবে অনুষ্ঠানে আজও এক টুকরো সোনা কেনাকেই শুভ মনে করেন বেশিরভাগ বাঙালিই। বিয়েতেও সোনার গয়না দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে বাবা-মা মেয়ের ভবিষ্যৎ যেমন সুরক্ষিত করেন তেমনই সোনাকে মাঙ্গলিকতা সৌভাগ্যের স্বরূপ হিসেবে মেয়ের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেন। দীর্ঘ মেয়াদে সোনা কখনও ডোবায় না। তার দাম বাড়তেই থাকে। তাই ঘরে অল্প হলেও সোনার বার বা গয়না রাখাকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে ভাবেন বহু মানুষই। ফলে মানুষ তা কিনতেনও বেশি করে।
ধাতু হিসেবেও সোনা শুভ। হিন্দু ধর্মে এটা পবিত্র ধাতু। তাহলে সেই সোনার বদলে গয়নার ট্রেন্ডের এই ভোলবদল কেন? আসলে আজকের মেয়েদের ভিন্ন পরিচিতি ভিন্ন পেশা তাঁদের সামনে অপশনও অনেক, আগে যেটা ছিল না। ফলে ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়েও ভাবছেন তাঁরা। পেস্টাল শেডের মিনাকারি বেনারসির সঙ্গে লাল রুবি আর সবুজ পান্নার স্টেটমেন্ট জুয়েলারি যতটা ভাল লাগবে একটা সোনার চওড়া সীতাহার এস্থেটিকালি ততটা নজর কাড়বে না এটা তাঁরা বোঝেন। তাই বিয়ের মতো জীবনের এক বড় উৎসবে আজকের কনেরা ট্র্যাডিশনকে সঙ্গে রেখেই একটু অন্যরকমভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলছেন। ক্যামেরাবন্দি হওয়া শ্রেষ্ঠ দিনের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোকে চিরন্তন করে তুলতে চাইছেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির বাংলাভাগের চক্রান্তের প্রতিবাদে গর্জে উঠল কোচবিহার
বিয়ের স্টেটমেন্ট জুয়েলারি
এই মুহূর্তে ভারতীয় তথা বাঙালি কনের স্টেটমেন্ট গয়নার তালিকায় সবার উপরে রয়েছে ওভার সাইজড নথ। নাকের চেয়ে অনেকটা বড় স্টোন এবং মিনাকারি কম্বিনেশনের বড় নথ সঙ্গে মুক্তো টানা। কনের পুরো লুকটাই পাল্টে দেয় মুহূর্তে। বড় স্টেটমেন্ট নথ ছাড়া কনে অসম্পূর্ণ যা তাঁরা চাইলে ব্রাইডাল আউটফিটের সঙ্গে কাস্টমাইজড করে নিচ্ছেন অনায়াসে।
দক্ষিণ ভারতীয় কনেদের হীরের গয়নার প্রীতি সর্বজনবিদিত। হীরে পরার চলা তাঁদের মধ্যে বহুযুগ ধরেই রয়েছে পরবর্তীতে সারা ভারতে বহু কনেকেই স্টেটমেন্ট ডায়মন্ড জুয়েলারি বিয়েতে পরতে দেখা গেছে। হীরের সঙ্গে অন্য প্রেশাস অথবা সেমি প্রেশাস স্টোন স্টাডেড গয়নাও পরছে তাঁরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্রাডিশনাল পোলকি আর কুন্দনের গয়নাকেও পিছনের সারিতে নিয়ে যাচ্ছে হীরের গয়না।
পোলকি, জাড়াউ বা জড়োয়ার গয়না এবং কুন্দনের গয়নার ক্রেজ কিছু কম নয়। সেলিব্রিটিদের বিয়ের বেশির ভাগ স্টেটমন্ট জুয়েলারিতে দেখা গেছে এই তিনের কম্বিনেশন।
ব্রাইডাল জুয়েলারির বড় ব্রেক থ্রু হল মাঙ্গটিকা উইথ পাশা। স্টানিং লুকের ব্রাইডের দুটো গয়না সবচেয়ে নজর কাড়ে— বড় নথ আর কপালভরা মাঙ্গটিকা। আর পাশার সঙ্গে মাঙ্গটিকার কম্বিনেশন খুব লেটেস্ট এবং হটেস্ট ট্রেন্ড।
পালাবদলের গয়নাগাটি
ব্রাইডাল জুয়েলারির আর এক সুন্দর সংযোজন হাতফুল আর ঝালর। এই হাতফুল ঝালর বাঙালি কনেরাও এখন দারুণ ভাবে ক্যারি করছেন। ট্রাডিশনাল হাতফুল বা বাঙালিদের যেটা রতনচূড়। রতনচূড় যেহেতু ট্রাডিশনাল তাই হাতফুলটাই বেছে নিচ্ছেন অনেকে কারণ সেটা অনেক বেশি কনটেম্পরারি। হাতফুলে শুধু সোনার বদলে তার সঙ্গে হীরে-মণি-মাণিক্যের এমনকী খুব সাধারণ কিছু যেমন ঝিনুক ইত্যাদিও কিন্তু ব্যবহার করা হচ্ছে।
আজকের কনেরা মাথার গয়না নিয়ে বেশ খুঁতখুঁতে। মাঙ্গটিকার সঙ্গে শিসপাট্টির ট্রেন্ডিং হয়েছে ২০২৩ থেকেই। হীরে বা জড়োয়ার জমকালো শিসপাট্টি ট্রাডিশনাল বেনারসির সঙ্গেও সমান মানানসই তাই টুকটুকে লাল বেনারসির সঙ্গে শিসপাট্টি, মাঙ্গটিকা আর স্টেটমেন্ট পোলকি বা কুন্দনের গয়নায় স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে বাঙালি কনে।