‘আমার কাছে সব সময় দু’টি সাদা গোলাপ থাকে। একটি মিত্রকে দেওয়ার জন্য। অন্যটি, শত্রুকেও!’ কিউবার প্রবাদপ্রতিম কবি হোসে মার্তির কবিতার দুটি লাইন। চে গুয়েভারার কন্যা অ্যালেইদা লাইন দুটি বারবার উচ্চারণ করতেন তাঁর ভারত ভ্রমণকালে।
একইভাবে একই কথা গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের উত্তরাধিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলতে পারেন, বলতেই পারেন। দিল্লির পর রাজভবনের ধরনা সে-কথাটাই মনে করিয়ে দিল।
আরও পড়ুন-ঝাউডাঙায় বন্যা-পরিস্থিতিতে বাসিন্দাদের নিরাপত্তায় জোর, পাশে পঞ্চায়েত
প্রকৃত নাম এর্নেস্তো রাফায়েল গেভারা দে লা সের্না। তবে, শুধু ‘চে’ নামেই চেনে গোটা দুনিয়া। আর্জেন্টিনার মানুষ। ছিলেন ডাক্তার। ভালবাসতেন কবিতা শুনতে ও লিখতে। তিনি একই সঙ্গে ডাক্তার, লেখক, ভ্রমণপিপাসু, রাগবি, ফুটবল, দাবা খেলার ভক্ত এবং বিপ্লবী। ছাত্রাবস্থায় মোটরসাইকেলে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণকালে সেখানকার দারিদ্র তাঁকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দেয়। তাঁর তরুণ মন এর জন্য একচেটিয়া জমিদারতন্ত্রকে দায়ী করে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় এটাই হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ। বর্তমান ভারতে যার প্রতিভূ ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি।
চে এর পর গুয়েতেমালায় সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তার পর ফিদেল কাস্ত্রোর সংস্পর্শে এসে কিউবার বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। কিউবার অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারের সঙ্গে প্রায় দু’বছরের সংগ্রামের পর সেই সরকারের পতন হয়। ১৯৬১ সালে ফিদেল কাস্ত্রো চে গেভারাকে শিল্পমন্ত্রী করেন। কিউবার রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে যান। ১৯৬৫ সালে কাস্ত্রো জানান, কিউবা ছেড়েছেন চে।
আরও পড়ুন-রাজ্যের হাত থেকে রাস্তা ফেরাতে মোদিস্তুতি করে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি পাঠালেন উপাচার্য
বলিভিয়ার ভয়ঙ্কর জঙ্গল থেকে ’৬৫-র পয়লা এপ্রিলে ফিদেল কাস্ত্রোকে একটা চিঠি লেখেন চে। সবুজ কালিতে লেখা। চে লিখেছিলেন, ‘‘ইফ মাই ফাইনাল আওয়ার ফাইন্ডস মি আন্ডার আদার স্কাইজ, মাই লাস্ট থট উইল বি অফ দিস পিপ্ ল অ্যান্ড এস্পেশ্যালি অফ ইউ।’’ (আমার মৃত্যুটা যদি হয় অন্য কোনও দেশে, তা হলেও আমার শেষ চিন্তাটা থাকবে এই মানুষগুলিকে (কিউবার জনগণ) নিয়ে, বিশেষ করে তোমাকে নিয়েই।’’ জানিয়েছিলেন, ‘‘তিনি আর থাকতে চান না কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির কোনও ‘সরকারি’ পদে। থাকতে চান না অত্যাচারী বাতিস্তা সরকারকে হটিয়ে গড়া বিপ্লবী সরকারের জাতীয় ভূমি সংস্কার প্রতিষ্ঠানের শিল্প দফতরের প্রধানের পদে। থাকতে চান না জাতীয় ব্যাঙ্কের সভাপতি, শিল্প দফতরের মন্ত্রী।
আরও পড়ুন-কালিকাপুর রাজবাড়ি টানে ছবির পরিচালকদেরও
চে লেখেন ওই চিঠিতেই, ‘আজ তোমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই। মারিয়া আন্তোনিয়ার বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা হল। আলাপ-পরিচয় হল। তুমি বললে, এসো, এক সঙ্গে লড়ি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ি। হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে। তার পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা হয়ে উঠল গাঢ় থেকে গাঢ়তর। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারি না। যেন আত্মার আত্মীয়! তখন আমাদের কোনও না কোনও কমরেডকে প্রায় প্রতিদিনই যেতে হচ্ছে লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে (যুদ্ধে মৃত্যুই যেখানে অনিবার্য)! কে এক জন যেন এসে বলল, আমাদের দু’জনের মধ্যে কাকে বেছে নেওয়া হবে, সেই বলির জন্য? আমি আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম, আমার নামটাই লিখতে। চেয়েছিলাম, তুমি থাকো। এখন আমাদের সেই আবেগটা একটু কমেছে, কারণ আমরা আরও পরিণত হয়েছি। কিন্তু আবার সেই একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, নিজের ভূখণ্ডে কিউবার বিপ্লবে আমার যতটুকু করণীয় ছিল, আমি করেছি। করতে পেরেছি। এখন তোমার কাছ থেকে আমার বিদায় নেওয়ার পালা।’’
আরও পড়ুন-কালিকাপুর রাজবাড়ি টানে ছবির পরিচালকদেরও
স্বীকারও করেছিলেন অকপটে, ‘‘আমার সবচেয়ে বড় ভুলটা ছিল সিয়েরা মায়েস্ত্রার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর দিনগুলি থেকেই তোমার ওপর আমি তেমন করে ভরসাটা ধরে রাখতে পারিনি। খুব তাড়াতাড়ি বুঝে উঠতে পারিনি, নেতা ও বিপ্লবী হিসেবে তোমার গুণগুলিও। এখানে আমার কিছু গুরুতর খামতি ছিল।’’
আজ যখন কেন্দ্রের স্বৈরাচারী সরকার পদে পদে বাংলাকে পিষে মারতে চাইছে, রাজভবনের দালালকে পথে নামিয়ে ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে মরিয়া, নজর ঘোরাতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে এজেন্সি ঢুকিয়েছে (অথচ সেই তল্লাশির ফলে একটা সিজার লিস্টও তৈরির মুরোদ হয়নি ভাড়াটে এজেন্সির), তখন যাঁরা, যেসব জগাই মাধাই চে যেমন ফিদেল কাস্ত্রোকে ভুল বুঝেছিলেন, সেই একই ভাবে এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়ে গদাইদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করতে ব্যস্ত হয়ে উঠছেন, তাঁদেরকেও আগামীতে চে-এর মতো ভুল স্বীকার করতে হবে, করতেই হবে। সৎ সাহস থাকলে মানতেই হবে, তাঁদেরকেও, চে-র ভাষা ধার করেই হয়ত বলবে তাঁরাও, ‘‘বলতে লজ্জা নেই, … আমি সব সময়েই তোমাকে অনুসরণ করেছি। আর সেটা করার জন্য গর্ব বোধ করেছি। আমি সেই অর্থে তোমার পথেরই পথিক ছিলাম।”
ভয় হয়, তখন না অনেক দেরি হয়ে যায়!
আরও পড়ুন-জুয়ার ঠেক থেকে ধৃত বিজেপি নেতা
ক্ষমতার আস্ফালন দেখানোর ব্যাপারে পুঁজিবাদী আমেরিকা বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চিন, এদেশের সিপিএম কিংবা বিজেপি— সবারই নীতি এক। রাজনৈতিক দলমতনির্বিশেষে ক্ষমতা ছাড়তে সবারই আপত্তি সমান। এইখানেই চে স্বতন্ত্র। এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতন্ত্র। ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করে চে আফ্রিকার কঙ্গোয় যান বিপ্লব সংগঠনের উদ্দেশ্যে। তার পর বলিভিয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিত্ব ত্যাগের ইতিহাস, বড় দল ছেড়ে রাস্তায় নেমে লড়াইয়ের ইতিহাস তো সবারই জানা। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। শুধু একটাই কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন-অব্যবস্থায় হোটেলেই প্রস্তুতি বাংলার
আপনি পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতে পারেন, গোঁড়া ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস করতে পারেন, অতি রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীও হতে পারেন— কিন্তু বিভিন্ন দেশে ঘুরে বিপ্লবে শামিল হওয়া চে গুয়েভারার দ্রোহময় জীবনকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারবেন না।
অনুরূপভাবে, ভারতে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে একদম নিচুস্তরের পঞ্চায়েত পর্যন্ত আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র গরিবগুর্বো মানুষের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুরের সংগ্রাম, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বকেয়া আদায়ের জন্য লড়াইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না-করার মুরোদ কারও নেই। অস্বীকার করতে গেলে অনৃত ভাষণ বিনা পথ নেই।