ছায়াছবির ছবি

বায়োস্কোপ থেকে ছায়াছবি। তারপর সিনেমা ও মুভি পর্ব। এভাবেই পর্বে পর্বে উত্তরণ। ছায়াছবি থেকে সিনেমা জগতের উত্তরণ পর্বেই আসেন সেরা চরিত্রাভিনেতা ছবি বিশ্বাস। একই সঙ্গে মঞ্চ ও পর্দায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। এই উপলক্ষে কিংবদন্তি অভিনেতার সামগ্রিক অবদান তুলে ধরলেন শঙ্কর ঘোষ

Must read

প্রস্তুতি পর্ব
বাংলা ছবির জগৎ থেকে নির্বাক ছবি পাকাপাকিভাবে বিদায় নেয় ১৯৩৫ সালে। ছবি সবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের জন্য বাংলার মঞ্চের শিল্পীদের চাহিদা বেড়ে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, যাঁরা মঞ্চে সফল ছিলেন তাঁরা বড় পর্দায় অচল হয়ে পড়লেন। সিনেমার সূক্ষ্মতাকে তাঁরা অভিনয়ে ধরতেই পারলেন না! ফলে নাটকের বাঘা বাঘা অভিনেতারা ব্যর্থ হলেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, মহেন্দ্র গুপ্ত, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী তেমনই কয়েকটি নাম। ব্যতিক্রমও ছিল। তেমনই এক শিল্পী হলেন ছবি বিশ্বাস। ছবি বিশ্বাসের সিনেমা জীবনের শুরু থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তাঁর অভিনয়ের একরকম ধারা। পরবর্তী পর্বে অন্য ধারা।

আরও পড়ুন-বৃক্ষনিধন: দিল্লির এলজির তীব্র নিন্দা সুপ্রিম কোর্টের

নতুন পরিচালকদের আগমন
এর মধ্যে কলকাতায় কয়েকজন চলচ্চিত্রপ্রেমী ও বুদ্ধিজীবী যুবক, যাঁরা মনে করতেন চলচ্চিত্র এক শিল্পমাধ্যম (art form), যাঁরা চলচ্চিত্রকে দেখতে চেয়েছিলেন তার বাস্তবতার মধ্যে (life in its realities), তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সত্যজিৎ রায়। ফেলে আসা দিনের বিত্তবান অভিজাত পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নিয়ে চর্চা করেন সত্যজিৎ। সেই সূত্র ধরে গোড়ায় তিনি তৈরি করলেন ‘জলসাঘর’ ও ‘দেবী’র মতো ছবি। জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের আচরণ ও কথাবার্তায় ফুটে ওঠা দম্ভ আভিজাত্য দেখিয়ে ‘জলসাঘর’ ছবি শুরু। কিন্তু কে করবেন বিশ্বম্ভর রায়? নিজের স্ত্রী বিজয়ার কাছে সত্যজিৎ রায় বলছেন, ‘জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস ছাড়া আর কাউকে ভাবাও যায় না।’ দর্শক ও সমালোচকেরা অভিভূত হলেন। এরপর থেকে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় হয়ে ওঠে ভিন্নমাত্রার। পরিণত ছবি বিশ্বাসের পরিণত অভিনয়। ‘দেবী’ ছবির একদিকে রয়েছে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার আর অন্যদিকে যুক্তিবাদ। প্রথমটির প্রতিনিধি জমিদার কালীকিঙ্কর। অন্যটির প্রবক্তা ছেলে উমাপ্রসাদ। স্ত্রীকেই জিজ্ঞাসা করলেন সত্যজিৎ রায়, ‘ছবি বিশ্বাসকে কালীকিঙ্করের ভূমিকায় দারুণ মানাবে না?’ স্ত্রীর স্বীকারোক্তি, ‘এত ভাল আর কাউকে মানাবে না’। নিজের গল্প নিয়ে যখন তিনি ছবি করতে এলেন তখন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবি নির্মাণের সময় নায়িকা মনীষার বাবার চরিত্রে ছবি বিশ্বাসকে প্রথম থেকেই ঠিক করে রাখেন সত্যজিৎ রায়। কারণ, ‘ওর চলা বলা মুখের ভাবের মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ ছিল’। শুধু সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেই নয় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন অভিনয়কে কোন মাত্রায় তুলে নেওয়া যেতে পারে। যেমন হেডমাস্টার, অগ্নিসংস্কার, অগ্নিসম্ভবা, ক্ষণিকের অতিথি প্রভৃতি ছবি। সত্যজিৎ রায় পরে ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে আরও ছবি করতেন। কিন্তু তাঁর বেঘোরে মৃত্যু সত্যজিৎ রায় কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য— ‘এক ধরনের বিশেষ রোলে ওঁকে এত মানাত, ওঁর জায়গা আর কেউ নিতে পারবেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য এরকম শক্তিশালী অভিনেতাকে এভাবে হারালাম।’

আরও পড়ুন-ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে অসম ফুঁসছে ব্রহ্মপুত্র, মৃত ৯০

তপন সিংহ প্রসঙ্গ
রবীন্দ্রনাথের চিরস্মরণীয় গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’। এই গল্পের চিত্ররূপ দেন তপন সিংহ। ‘প্রবাসী আনন্দবাজার’ পত্রিকার তরফে একবার তপন সিংহের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি এই ছবি তৈরির প্রেক্ষাপট বললেন, ‘সে সময় রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি করতে তেমন কেউ বড় একটা উৎসাহ বোধ করতেন না। এমন এক সময় এগিয়ে এলেন প্রযোজক অসিত চৌধুরী। বললেন, কাবুলিওয়ালা নিয়ে ছবি করলে কেমন হয়? এত আনন্দ পেলাম যে ওই ছোট গল্প থেকে সাত দিনের মধ্যে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে ফেললাম।’ সেটা ১৯৫৬ সাল। নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস যেন গল্পের পাতা থেকে উঠে এলেন। স্বভাবে ও চেহারায় সমানভাবে অভিজাত ছবি বিশ্বাস কী অসাধারণভাবে নিজেকে বদলে ফেলে পেস্তা বাদাম আঙুর বিক্রেতা গরিব রহমত হয়ে উঠলেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
জন্মবৃত্তান্ত
১৯০০ সালের ১৩ জুলাই ছবি বিশ্বাসের জন্ম। বিডন স্ট্রিটের বনেদি বিশ্বাস পরিবারে ভূপতিনাথ বিশ্বাসের ছেলে শচীন্দ্রনাথের জন্ম। ছবির মতো চেহারা নিয়ে এই পরিবারে আসেন শচীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর মা আদর করে ডাকতেন ছবি নামে। পরে মায়ের দেওয়া এই নামটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল ও পরে হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করেন। এই হিন্দু স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও পরে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা করেন। ছোট বয়স থেকেই অভিনয়প্রীতি ছিল। বাড়ির প্রকাণ্ড হল ঘরে ভাইবোনেরা প্রায় গান-বাজনা, অভিনয় ও আবৃত্তির আসর বসাতেন। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সূত্রে এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর প্রশংসা পান। যদিও শিশিরকুমারের কাছে তাঁর অভিনয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ হয়নি। তিনি নিজেকে শিশিরকুমারের একলব্য শিষ্য হিসেবে উল্লেখ করতেন। অর্থ বিত্ত শিক্ষায় এগিয়ে থাকা পারিবারিক ঐতিহ্য সত্ত্বেও তিনি যৌবনে শিকদার পাড়া নাট্য সমাজের ‘নদীয়া বিনোদ’ পালায় নিমাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। ঐ মঞ্চে তাঁর প্রথম অভিনীত নাটক ‘সমাজ’ সমাদৃত নাহলেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়। ওই বছরই ‘মীরকাসিম’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন।

আরও পড়ুন-শুনশান ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের জয়

ছবির জগতে প্রবেশ
ছবির জগতে তাঁকে অভিনয় করার আমন্ত্রণ জানান প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। আর সাহায্য করেন তিনকড়ি চক্রবর্তী। তাঁদের আগ্রহে রূপালি পর্দায় ছবি বিশ্বাসকে আমরা প্রথম পেলাম ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ (১৯৩৬) ছবিতে বিশুর ভূমিকায়। এই ছবিতে তাঁর সহশিল্পী নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল তা তাঁর মারা যাওয়া পর্যন্ত বজায় ছিল। ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে তিনি সবার নজর কাড়লেন। অল্প সময় উপস্থিতিতে তিনি চিরস্থায়ী দাগ কাটলেন ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিতে। ‘দুই পুরুষ’ ছবিতে নুটুবিহারী তাঁর আরেক স্মরণীয় কীর্তি। ‘গরমিল’ ছবিতে তাঁর অভিনয় সকলের মন ছুঁয়ে গেল। ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে তিনি নামভূমিকায়। বিপরীতে ছিলেন কানন দেবী (শৈবলিনী)।
চিত্র পরিচালনার কাজ
এত অভিনয়ের ফাঁকে তিনি দু-দুটি ছবি পরিচালনা করলেন। ১৯৪৪ সালে ‘প্রতিকার’ মুক্তি পেল। লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র। সুরকার শচীন দেব বর্মন। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘যার যেথা ঘর’। এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করলেন রেণুকা রায়, পাহাড়ি সান্যাল, জীবন বসু প্রমুখ শিল্পী। এই দুটি ছবির একটিও ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। ফলে তিনি পরিচালনার পথে আর যাননি।
বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে
তাঁর সময়ের সব বিখ্যাত পরিচালকের ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। একেকজন তাঁকে অনেকবার করে নিয়েছেন। এই পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, অগ্রদূত, নীরেন লাহিড়ী, অজয় কর, সুধীর মুখোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, চিত্ত বসু, সুকুমার দাশগুপ্ত, কার্তিক চট্টোপাধ্যায়, যাত্রিক, সুশীল মজুমদার, অগ্রগামী, রাজেন তরফদার, সলিল সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, পিনাকী মুখোপাধ্যায়, হরিদাস ভট্টাচার্য, প্রভাত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পরিচালক।
ছবি বিশ্বাসের বিখ্যাত সিনেমা
তাঁর স্মরণীয় ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে পরশপাথর, দেবী, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লৌহ কপাট, কাবুলিওয়ালা, ক্ষুধিত পাষাণ, সবার উপরে, সূর্যতোরণ, পথে হল দেরি, অগ্নিসংস্কার, বিপাশা, পৃথিবী আমারে চায়, শুভদা, ভোলা মাস্টার, শংকর নারায়ণ ব্যাংক, সপ্তপদী, শশীবাবুর সংসার, দাদাঠাকুর, কেরী সাহেবের মুন্সি, সূর্যমুখী, মায়ামৃগ, পুত্রবধূ, ছেলে কার, অভয়ের বিয়ে, ওরা থাকে ওধারে, সাহেব বিবি গোলাম, চাওয়া পাওয়া, স্মৃতিটুকু থাক, অগ্নিসম্ভবা, হসপিটাল, হেডমাস্টার, বিচারক, আঁধারে আলো, নাগিনী কন্যার কাহিনী, অন্তরীক্ষ, ঢুলি, মধ্যরাতের তারা, একদিন রাত্রে প্রভৃতি।

আরও পড়ুন-ইন্ডিয়া ১১, এনডিএ ২, তিন রাজ্যে সাফ বিজেপি

পেশাদারি মঞ্চে তাঁর অবদান
কলকাতার নানান পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে ছবি বিশ্বাস একটানা ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত নানান ধরনের বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করেছেন। স্বাস্থ্যের কারণে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন ঠিকই। পরে আবার স্টার থিয়েটারে যোগদান ১৯৫৯ সালে। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক ও চরিত্রের মধ্যে রয়েছে পরিণীতা (নরেন), চরিত্রহীন (সতীশ) দেবদাস (নামভূমিকা) কাশীনাথ (নামভূমিকা), সিরাজদৌল্লা (নামভূমিকা), পরমাত্মা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশচন্দ্র) দুই পুরুষ (নুটুবিহারী), শাজাহান (আওরঙ্গজেব), ডাকবাংলো (বিশ্বেশ্বর), শ্রেয়সী (সাধন চৌধুরী) প্রভৃতি শ্রেয়সী নাটকে তিনি শেষ মঞ্চে নামেন। মঞ্চ প্রসঙ্গে ছবি বিশ্বাসের ব্যক্তিগত অভিমত ছিল modern stage should be the Medium of the nation. কথাটা ইংরেজি বলে তিনি নিজেই এর তর্জমা করেছেন ‘মঞ্চেতে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে হবে জাতির মনে’। আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন ‘আমার যদি ক্ষমতা থাকত, আমি মঞ্চের সংস্কার করতে গিয়ে প্রথমেই প্রম্পটিং বন্ধ করে দিতাম’। ১৯৫৯ সালের সংগীত নাটক একাডেমি তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান দেয়। শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমারের দুর্দিনে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে সেখানে অভিনয় করার জন্য এগিয়ে আসেন, অন্য জায়গায় মোটা টাকার প্রস্তাব ছেড়ে দিয়ে। শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমারের সঙ্গে ‘আলমগীর’ নাটকে রাজসিংহ চরিত্রে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন-ভয়াবহ দুর্ঘটনা! রোগী নিয়ে যাওয়ার পথে ট্রাক-অ্যাম্বুলেন্স মুখোমুখি ধাক্কা, মৃত ৬

নিজের দেশের বাড়ির খবর
জাগুলিয়ার প্রাসাদের মতো বাড়ির সিংহদুয়ার আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদের আদি অস্তিত্ব অবশ্য আজ আর নেই। একসময় এই প্রাসাদের ঠাকুরদালানে ছবি বিশ্বাস প্রতিবছর দুর্গাপুজো করতেন। ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি হেল্থ সেন্টারে জন্য ১০ বিঘা জমি দান করেছিলেন তিনি। ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জাগুলিয়ার গ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন চাল-ডাল ও জামা-কাপড়। ১৯৪৫ সালের ৯ মে দরিদ্রবান্ধব ভাণ্ডারকে সাহায্য করতে উত্তরা প্রেক্ষাগৃহে ডিল্যুক্স পিকচার্স বদান্যতায় ‘পথ বেঁধে দিল’ ছবিটি দেখানো হয়। ওই ছবির নায়ক নায়িকা ছবি বিশ্বাস ও কানন দেবী ব্যক্তিগতভাবেও টাকা দিয়েছিলেন এই উদ্যোগে।
অভিনেতৃ সংঘের গোড়াপত্তন
শিল্পীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ছবি বিশ্বাস। অভিনেতৃ সংঘের গোড়াপত্তন কী করে হয় তা ধরা আছে বিকাশ রায়ের জবানবন্দিতে,‘‘সেদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ছবিদার শ্যুটিং ছিল। আমি আর ভানু এক পাশে দাঁড়ালাম। ছবিদা বললেন, ‘জগাই মাধাই এখানে কেন? কী মতলবে?’ আমরা বললাম, না এমনি। ছবিদা বললেন, ‘এমনি আসো যখন একা আসো। দুটি একসঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও বদবুদ্ধি আছে’।’’ শেষ পর্যন্ত বিকাশ রায় বললেন,‘‘আমরা শিল্পীদের একটা সংস্থা করতে চাই।’’ ছবি বিশ্বাসের উত্তর,‘‘কাল সকালে বাড়িতে আয়, আলোচনা করা যাবে।’’ এই ভাবেই জন্ম নেয় অভিনেতৃ সংঘের। প্রথম সভাপতি নরেশ মিত্র আর সম্পাদক ছবি বিশ্বাস।

আরও পড়ুন-আজ জিতলেই সিরিজ ভারতের

আভিজাত্যে সচেতন
তেমনি এক ঘটনার কথা বলি। এক সহকারী পরিচালক হঠাৎ পরিচালক হয়ে একদিন ছবি বিশ্বাসকে ডাকলেন, ‘ছবিবাবু’। এক সেকেন্ড তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ছবি বিশ্বাস। তারপরে বললেন, ‘বলুন’। নব্য পরিচালক বললেন, ‘এই চরিত্রে অভিনয় করার সময় আপনি ভুলে যাবেন যে আপনি ছবি বিশ্বাস’। ছবি বিশ্বাস তাকিয়ে রইলেন। পরে বললেন, ‘তাই বুঝি।’ বাড়ি ফিরে ছবি বিশ্বাস ফোন করলেন প্রযোজককে। বললেন, ‘ওহে, তোমার ডিরেক্টর আমাকে ভুলতে বলেছে যে আমি ছবি বিশ্বাস। কিন্তু তা ভুলি কী করে বল? এই ছবি বিশ্বাস বলেই তো তোমরা খাতির-যত্ন করো নাকি। অন্য লোক দেখো। বিশ্বাস বংশের সন্তান। আমি পয়সার জন্য সে কথা ভুলতে পারব না। ও পার্ট আমার দ্বারা হবে না’ এতেই কাজ হল। পরদিন সেই নব্য পরিচালক ছবি বিশ্বাসের কাছে এসে বললেন, ‘ছবিদা’। ছবি বিশ্বাস বললেন ‘বুঝেছি। কবে থেকে শুটিং জানাও’— এই হলেন ছবি বিশ্বাস।
অভিনীত চরিত্রে বৈচিত্র
যাঁরা মনে করেন ছবি বিশ্বাস অভিজাত, সব চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি আরেকবার ‘হেডমাস্টার’ ছবিটা দেখার জন্য। পূর্ববঙ্গের সাগরপুর গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারের চরিত্রটিতে ছবি বিশ্বাস যে অভিনয় দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন। শরৎ পণ্ডিতের জীবদ্দশাতেই তাঁর দুরূহ চরিত্রে রূপ দিয়ে ‘দাদাঠাকুর’ ছবিতে ছবি বিশ্বাস এমন অদ্ভুত ক্ষমতার নিদর্শন রাখেন, যা স্বয়ং দাদাঠাকুরের প্রশংসা পায়। গরিব হতভাগ্য কাবুলিওয়ালার কথা শুরুতেই বলেছি। আদালতে সাজা মকুবের পর তাঁর হারানো যৌবনের ১২ বছরের জন্য ছবি বিশ্বাস ‘সবার উপরে’ ছবিতে যে হাহাকার করে ওঠেন, স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি প্রমাণ করে দেয় শিল্পী কোন জাতের।

আরও পড়ুন-খাদ্যপ্রেমীদের জন্য সুখবর, অগাস্টেই চালু শিলিগুড়ির ফুড লেন

দুটি অভূতপূর্ব ঘটনা
পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে কলকাতা দূরদর্শনের ‘ক্লোজআপ’ অনুষ্ঠানের সাক্ষাৎকারে তাঁর পরিচালিত ‘শশীবাবুর সংসার’ ছবির দুটি ঘটনার কথা জানান, সেই ঘটনা দুটির উল্লেখ করছি। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ছবি বিশ্বাসের শ্যুটিং হচ্ছে। মেকআপ রুমে ইজি চেয়ারে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর সহশিল্পী পাহাড়ি সান্যাল হন্তদন্ত হয়ে মেকআপ রুমে ঢুকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,‘‘আচ্ছা কোথাও কি শান্তি পাওয়ার উপায় নেই?’’ ছবি বিশ্বাস আস্তে করে বললেন, ‘‘এতক্ষণ এখানে শান্তি ছিল।’’ আরেকটা ঘটনা হল ছবির শেষ দৃশ্যের পরিণতি কী হবে কেউ ফ্লোরে ঠিক করতে পারছিলেন না। ছবি বিশ্বাস পথ বাতলে দিলেন। শশীবাবু (ছবি বিশ্বাস) হাত দুটি পেছনে নিয়ে আঙুল মটকাতে মটকাতে পায়চারি করছেন। যখন সমস্যা মিটল হাত দুটি খুলে সামনের দিকে নিয়ে এলেন। এমন ভাবেই রাখা হয়েছে ‘শশীবাবুর সংসার’ ছবির শেষ দৃশ্যটি।
শিল্পীর চলে যাওয়া
ছবি বিশ্বাসের মতো দুর্ধর্ষ নটকে আমরা হারিয়েছি ১৯৬২ সালের ১১ জুন। আচমকা মোটর দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমরা তেমনভাবে এই মহান শিল্পীকে স্মরণ করতে পেরেছি কি? খানকুল রোডের নাম বদল করে অনেকদিন আগেই ছবি বিশ্বাস সরণি রাখা হয়েছে। ওই পর্যন্তই। এই লেখার মধ্য দিয়ে সেই দুর্ধর্ষ নটকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Latest article