মোদিজির মতো নকলনবিশ চৌকিদার নন। অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘরের লক্ষ্মীর মতো বাংলা মা’কে আগলে রেখেছেন। তাঁর স্নেহস্পর্শ থেকে বাঙালিকে জর্জরিত করতে ঠগি-বর্গির মতো ভোটের ঠিক আগে যথারীতি একদল চিল-শকুন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নানা ছলাকলায় না এঁটে শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে কার্যত জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে বগলদাবা করে বাংলার ভোটারদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আরম্ভ করেছে বিজেপি। যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামের এই পবিত্র মাটি ইলেকশন কমিশনের বকলমে এসআইআর-এর নামে বাংলায় ভোটবন্দির যাবতীয় ফন্দিবাজদের মাঠের বাইরে ফেলবে তা মুখ্যমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এযুগের দুঃশাসনরা বাংলার পাঞ্চালির দিকে হাতে বাড়ালে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। বিজেপির দালালদের বিরুদ্ধে একযোগে গর্জে উঠবে বাংলার মাতঙ্গিনী ব্রিগেড। যে বিজেপি ক’দিন আগেই সংসদে শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরার চূড়ান্ত অপমান করেছে, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে মাস্টারদা, নবজাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন-বিদ্যাসাগরকে হেয় করেছে তার বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির গর্জে ওঠা সময়ের অপেক্ষামাত্র। মুখ্যমন্ত্রী তথা দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ফের আরও এক স্বাধীনতা সংগ্রামের সলতে পাকাচ্ছে বিপ্লবী ও মনীষীদের পদধূলিধন্য বাংলার মাটি। ব্রিটিশের অনুচরদের বংশধরদের সমুচিত শিক্ষা দিতে হতেই পারে আরও এক অগ্নিযুগের সূচনা।
যেমন খুশি বলো। শীতকালীন অধিবেশনে (Parliament Winter Session) এবারের লোকসভার থিম সং নিঃসন্দেহে উপরোক্ত লাইনটি। যার সূচনা করলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বেশ কয়েক বছর ধরেই আদরণীয় মোদিজির শখ হয়েছে ‘বাঙালি বাবু’ সাজার। রবিঠাকুরের মতো দাড়ি রেখে অনেকেই নিজেকে কবি ভাবতে পারেন। সেরকমই বিশ্বকবির আঙ্গিকে নিজেকে বিশ্বগুরু ভাবা মোদিবাবু এবার টাইম মেশিনে চেপে ‘যেমন খুশি সাজো’ থেকে ‘যেমন খুশি বলো’-য় শিফট করেছেন। লোকসভায় দাঁড়িয়ে তিনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সটান বঙ্কিমদা বলে বসেছেন। বলবেন তো বলুন, একেবারে তৃণমূলের অধ্যাপক সাংসদ সৌগত রায়ের সামনে। বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ সৌগতবাবুও লোপ্পা ফুলটসকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এই বিষয়ে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে সময় না দিলে এবার কড়া পদক্ষেপ
মোদিজিও তৎক্ষণাৎ ঢোক গিলতে বাধ্য হয়েছেন বঙ্কিমবাবু বলে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, রাজ্য দখল বা ভোটের অছিলায় এভাবে আর কত নিচে নামা যায়। মোদিজির পর কার্যত সেই নকলনবিশের হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে বিজেপি মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত তো বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই বারকয়েক হড়কেছেন। বঙ্কিমদাস পর্যন্ত বলে বসেছেন। এত আস্পর্ধা এই তথাকথিত গোমূর্খদের। বিষয়টা না জেনেও তা নিয়ে হামবড়াই দেখাতেই হবে। বিজেপি সাংসদ দীনেশ শর্মা স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরাকে মাতা-গিনি হাজরা বলে রীতিমতো খোরাক হয়ে উঠেছেন। ভাগ্যিস, গোয়েবলসীয় ধাঁচে, ‘জয় মাতাজি’ বলে বসেননি! তারওপর তিনি আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মুখোশ পরতে গিয়ে বীর শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরাকে মুসলমান বলে দিয়েছেন। সামান্য চিকেন প্যাটিস বিক্রির অপরাধে যারা গরিব মুসলমানকে হেনস্থা করে, তাদের কথা কুম্ভীরাশ্রু ছাড়া আর কী হতে পারে। সত্যজিতের স্মরণ নিয়ে বলা যেতেই পারে নকল ডক্টর হাজরার মতো একদল প্রতারক, ধাপ্পাবাজের হাতে সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আজ ভারি বিপন্ন।
এভাবে শর্ট কাটে বাঙালি সাজতে যাওয়া ‘যেমন খুশি সাজো’তে পর্যন্ত লাস্ট বেঞ্চে থাকবে। কারণ, আদ্যোপান্ত বাঙালি বিরোধী যারা তাদের মুখের প্রবচন প্রলাপে পরিণত হতে বাধ্য।
হচ্ছেও ঠিক তাই। বাংলা তথা দেশের নবজাগরণের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা থেকে রাজা রামমোহনকে ইংরেজের তাঁবেদার বলা, ধৃষ্টতার পরতে পরতে সেই বাঙালি বিদ্বেষের দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। যতই মোদিজিরা বিহার জয়ের পর বাংলা দখলের দিবাস্বপ্ন দেখুন না কেন, তাঁদের এই দুঃসাহস গিমিকে পালটে যাওয়া সময়ের অপেক্ষামাত্র। বলাবাহুল্য, সেই ল্যাজেগোবরে হওয়ার আগের ট্রেলার দেখাচ্ছেন গোবলয়ের গোয়েবলসরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে অসংসদীয় গালাগাল দিয়ে বসেছেন। চরম উত্তেজনার বশে মানুষ হয়তো এই ভুল করে। আর অমিতবাবু যাকে কিনা বাংলা দখলের রাজার পার্ট দেওয়া হয়েছে তিনি গতবারের দুশো পারের দুঃস্বপ্ন ভুলে এবার পগারপারের প্রহসনে পরিণত হয়েছেন। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে গালিভার-লিলিপুটের চিনের প্রাচীর থেকেই গিয়েছে।
শীতের শহরে আগে সার্কাসের বড় রমরমা ছিল। কিন্তু যবে থেকে পশুপাখি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে (সঙ্গত কারণেই) তবে থেকে সার্কাস বাঙালির ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গিয়েছে। নবপ্রজন্ম আর সেই সার্কাসের আস্বাদন পাচ্ছে না। বলতে খারাপ লাগলেও দেশের পার্লামেন্ট এই ভরা শীতে সার্কাসের অভাব অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছে। এই শীতকালীন অধিবেশনে (Parliament Winter Session) একটু আমাদের লোকসভার দিকে তাকান। মনে হবে জোকার পরিবৃত হয়ে সার্কাস চলছে। নানা আঙ্গিকে জোকারদের হাতে দেশের গণতন্ত্র টলমল করছে। ক্ষমতার নেশায় বলিয়ান একদল অশিক্ষিত, অপগণ্ডদের হাতে এভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা হাস্যকর হয়ে ওঠে তবে আজকের গ্লোবাল ভিলেজে দেশের মানসম্মান কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে তা কি আর বলার অবকাশ রাখে!
যদিও এই মুহূর্তে দিল্লির জমিদারদের সেসব দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। জুলভার্নের অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেইজের কায়দায় আরএসএস-বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছে চটজলদি জোরজবরদস্তি ভারত দখলের আদিম খেলায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী বহু বিদেশি শাসন দেখেছে ভারত। কিন্তু কবির ভাষায়, শক-হুন-মুঘল-পাঠান একদেহে হয়েছে লীন। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভারতে রাম-রহিমের আদর্শ মিলেমিশে একাকার হয়েছে। সেই ভাবনায় জারিত ভারতবাসী আজ দেখছে সম্পূর্ণ উলটো মেরুর শাসকদের। বৈচিত্র্য বরবাদ করে এক অদ্ভুত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা রূপায়ণে ব্রতী তারা। যাদের তুরুপের তাস সন্ত্রাসী স্বাধ্বী প্রজ্ঞা, আশারাম বাপু, কার্তিক মহারাজ, বাগেশ্বর নামক বাতেলাবাজরা।
মানে মানে বুঝে গেলে ভাল। নাহলে জবরদখল। আর সেজন্য রাখঢাক না করে যাবতীয় কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে লেলিয়ে দেওয়া। যার সাম্প্রতিক নিদর্শন হল নখদন্তহীন জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একবার তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এই দখলদারদের ছুঁড়ে ফেলে দেবেন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

