‘‘আমাদের ডিএফও একটা সাতদিনের হাতির বাচ্চাকে রেসকিউ করেছে। ওর মাকে খুঁজে পায়নি। তাই ওরা একটা নাম দিতে বলছে? কী নাম দেওয়া উচিত?’’
‘‘ওতো বেঁচে এসেছে এটাই বড় ব্যাপার। লাকি। সাতদিনের বাচ্চা এইভাবে বেঁচেছে!’’
গত ৪ তারিখে উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে দু’দফায় চরকির মতো চষে বেড়াচ্ছেন উত্তরবঙ্গের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পায়ের আর নির্দেশের বিরাম নেই একটুও। এরই মাঝে জিটিএ-র সঙ্গে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিভিউ মিটিংয়ে ডিএফও সাহেবের আবদারে তাৎক্ষণিক নামকরণ করলেন ছোট্ট সাতদিনের একটি হাতির, যে তার মাকে হারিয়েছে এই ভয়াল বন্যায়। সেইসাথে ডিএফও (কার্শিয়াং) সাহেবের এই কাজের জন্য পুরস্কৃত করার কথাও বলতে ভোলেননি।
হ্যাঁ, ইনিই আমাদের দিদি, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata banerjee)। যাঁর সকাল থেকে রাত অবধি সব কর্মকাণ্ডকে বিরোধী রাজনৈতিক মতামত রাখা-রা নাটক বলে অভিহিত করে। কিন্তু উনি শুধুই কাজ করে চলেন…নিরলস নিরন্তর।
পাহাড়ের বিপর্যয়ের খবরে প্রথমেই দু’দিনের জন্য তড়িঘড়ি উত্তরবঙ্গ এসে ক্ষয়ক্ষতির খবর নিয়ে কলকাতা ফিরলেও ফের ১২ তারিখ থেকে টানা রয়েছেন। আর ওনার থাকা মানে তো শুধু নির্দেশ দিয়েই কাজ শেষ নয়। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কার্শিয়াং, মিরিক হয়ে এখন দার্জিলিংয়ে আছেন। ১৭ তারিখ শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতা ফিরেই রয়েছে কালীপুজোর উদ্বোধন।
একটা সত্তরোর্ধ্ব মানুষের অমানুষিক পরিশ্রমের সঙ্গেই ওনার বিরোধীরা পেরে উঠতে পারেন না তাই গোঁসা করে এগুলোকে নাটক বলে অভিহিত করেন। আচ্ছা, সমালোচকরা কখনও ভেবেছেন, সেই যে মহালয়ার দু’দিন আগে কলকাতায় মণ্ডপে মণ্ডপে একশোরও বেশি ও সেইসঙ্গে ভার্চুয়ালি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে টানা বসে কয়েক হাজার জেলার পুজো উদ্বোধন দিয়ে শুরু হয়েছে ওনার ছুটোছুটি… এর মাঝে অতিবৃষ্টির ফলে অবরুদ্ধ কলকাতাকে সচল করার প্রশাসনিক দায়িত্ব আর পুজো মিটতেই উত্তরবঙ্গে বিপর্যয়। যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে এক সপ্তাহের মধ্যে দু’বার উত্তরবঙ্গ এলেন। দ্বিতীয় দফার চূড়ান্ত ব্যস্ততা যা এখনও চলছে। আপনারাও একটু চেষ্টা করলেই তো পারেন। ভোটের রাজনীতি কিংবা নাটকই নাহয় একটু করলেন।
এই যে বন্যায় উত্তরবঙ্গের এক-একটি জায়গায় মানুষ শুধু পরনের কাপড়টুকু ছাড়া টাকাপয়সা, প্রয়োজনীয় কাগজ পর্যন্ত সবকিছু হারিয়েছে। মুহূর্তে মাথার উপর থেকে বেঁচে থাকার সব উপকরণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা উনি বুঝেছেন বলেই আজ ছ’দিন ধরে উত্তরবঙ্গে পড়ে থেকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ব্রিজ, রিলিফ ক্যাম্প, রিলিফের ব্যবস্থা-সহ দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কি না দেখতে একটার পর একটা জায়গা ভিজিট করছেন।
কোথায় নাগরাকাটা যেখানে ব্রিজ ভেঙে গাড়ি যাচ্ছে না। যাহোক করে চলাচল করার মতো প্রশাসনের তড়িঘড়ি বানানো লোহার ব্রিজ দিয়েই ওপারে গিয়ে কথা বলছেন বাসিন্দাদের সঙ্গে। আশ্বাস দিচ্ছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। সেখান থেকে আলিপুরদুয়ারের রিলিফ ক্যাম্প দেখেই জলপাইগুড়ি। রাতটুকু কাটতেই সকালে মিরিকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, বাসিন্দাদের কথা বলতে পাহাড়ি উঁচুনিচু পাথুরে পথ ধরে ধরে বাড়ির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন তাঁদের অসুবিধা। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, ‘‘আমি আপনাদের পাশে আছি।’’ এরমধ্যেই টুক করে সেরে নিচ্ছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা যারা থাকি তারা সবাই জানি, রাস্তায় নামলে ওনার নির্দিষ্ট শিডিউল বলে কিছু থাকে না। চোখের পলক ফেলতে উনি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা লাগান মানুষের সঙ্গে কথা বলতে… তাল রাখতে প্রশাসনের লোকজন, পুলিশ, আমলা-সহ আমাদের দম বেরিয়ে যায়। হাত-পা চলে না। মনে হয় একটু বসি। ওনার ক্লান্তিহীন হাঁটার কাছে আমাদের সবসময় দৌড়ানো অবস্থা হয়।
আমি আজও অবাক বিস্ময়ে ভাবি বিগত চল্লিশ বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই একইরকম থেকে গেলেন। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর সেই চূড়ান্ত পর্যায়ের ডেডিকেশনের আজও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। এই বয়সে এসেও যেন রক্ত নিংড়ে নিজেকে পারলে উজাড় করে দেন মানুষগুলো যাতে ভাল থাকে।
আপনারা এই বিরামহীন কাজকে কথায় কথায় বলেন নাটক। তা উনি যদি নাটক করেন, আসুন না আপনারাও সেটা একটু করুন। আপনারাও দিন-রাত এক করে পড়ে থাকুন। কেউ তো বারণ করেনি। আপনারা আজ নতুন তো জানছেন না যে, উনি বরাবরই এরকম। বিরোধী নেত্রী থেকে আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়েও যাঁর পাহাড় থেকে জঙ্গল, নদী সর্বত্র পদচারণায় শুধু মানুষের খোঁজ খবর রাখাতেই নিবদ্ধ। সেই কাজ, আপনাদের কথায় নাটকগুলো তো বহুল প্রচলিত, চল্লিশ বছরের উপর ধরেই মঞ্চস্থ হচ্ছে। এতদিনে আপনাদের তো নাটকের প্রতিটি কথা মুখস্থ হয়ে যাওয়া উচিত, তাই না?
আমরা অনেকসময় দেখি, কেউ পাঁচটা কম্বল বিতরণ করছে, সেটাও ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানায়। এতে অনেকেই দেখি কড়া ভাষায় আক্রমণ শানান যে এত লোক দেখানোর কী আছে? কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছবি তুললেও পাঁচটা লোকের তো উপকার হল। আপনারা তো সেটাও করেন না! আপনাদের দৌড় ওই স্নো পাউডার মেখে চ্যানেলের ঠান্ডা ঘরে বসে চিল চিৎকার করে বুকের হাহাকার মেটানো অবধিই… তার বেশি ভাবতেও পারবেন না। করা তো দূরের ব্যাপার। মানসিক ও শারীরিক অলসতায় আর যাই হোক, অসহায় সাধারণ মানুষের জীবনের আশা ভরসা হওয়া যায় না।
আমি জানি, আমাকে তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কয়েকটি বিশেষ ভূষণে অভিহিত করেন। তাতে আমার কেশাগ্রও বাঁকে না। কিন্তু আপনারা বলুন তো, পারবেন এইভাবে মানুষের বিপদের দিনে খুঁটিনাটি সবটুকু দাঁড়িয়ে থেকে খেয়াল রাখতে?
আমার বিরোধীদের থেকেও বেশি মজা লাগে, আমাদের সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভের বাঁদর নাচ দেখে। ঘণ্টাখানেক মিডিয়াকুল তাঁর কথার খুঁত ধরেই দু’দিন পড়ে রইল। ব্যাপারখানা এমন যেন ওনাদের বাড়ির মা-ঠাকুমারা সদাই ব্যাকরণ মেনে কথা বলেন। তাই একজন মুখ্যমন্ত্রী (CM Mamata banerjee) কী করে এরকম বলতে পারেন, এই অপরাধে ওনাকে ফাঁসি-টাসি দেওয়ার সুযোগ থাকলে এরা বোধহয় তাই দিত! সেটা দিতে না পারার অক্ষমতায়, আসলে বুকজ্বালায় তারা কিন্তু পাহাড়ের দুঃখে শামিল হতে পারেনি বটে তবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে দুর্গাপুরেই রইল। বছরখানেক আগের আরজি করকেও একটু একটু পরিবেশন করে সান্ধ্য মজলিশের মৌতাত বাড়াল। অথচ যাঁর কথার ভুল ধরলেন তিনি ডুয়ার্স থেকে পাহাড়ে উঠেও সেই কাজের ভিতরেই সারাদিন কাটাচ্ছেন।
বাস্তবটা আপনাদের স্বীকার করার মতো বুকের বল নেই যে, আপনাদের মতো উচ্চ চিন্তার অসাধারণ মানুষ উনি নন। সাধারণ মানুষের বৃত্তে থাকা উনি সাধারণেরই প্রতিনিধি। তাই রাজনীতির মাঠে ওনার গ্রহণযোগ্যতা আপনাদের পেটে গ্যাস উৎপন্ন করে। আর সেটা কুৎসা অপপ্রচার মিম নোংরা অশ্লীল গালি হয়ে মুখ দিয়ে বেরোয়।
বিরোধী নেত্রী হিসাবে ওনাকে মারধর করা তো নিয়ম করে ফেলেছিল একসময় তৎকালীন সরকার। কই একবারও সরকারের কেউ ওনাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল? উনি কিন্তু খগেন মুর্মুকে দেখতে গেছেন। কথা বলেছেন। ঠিক এখানেই মুখ্যমন্ত্রী ওনার তথাকথিত কুৎসাকারীদের থেকে আলাদা কারণ নাটক করে হলেও আপনাদের ক্ষমতাই নেই লাগাতার মানুষের মাঝে পড়ে থাকার। উনি শুরু থেকেই এটা করেন। এটা যদি রাজনীতি হয় রাজনীতি। নাটক হয় নাটক।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুগুলো যখন ‘দিদি দিদি’ বলে হাত নেড়ে ওনাকে ডাকে, উনি এগিয়ে চকোলেট দেন, কখনও ওদের চোখে মুখের খুশি দেখেছেন? কখনও খেয়াল করে দেখেছেন শিশুরা ওনার কোলে উঠে কাঁদে না। কারণ আপনাদের ওই নাটকের স্নেহময়ী স্পর্শটা ঠিক ঠাকুমা-দিদিমাদের মতো। ওরা সেই মমতাতেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আপনাদের সহবত আদব-কায়দা সবটাই নষ্ট হয়ে গেছে বলে মুখ দিয়ে ওনার সম্বন্ধে খারাপ শব্দগুলোই বের হয়।
ফলত আপনাদের কাছে একজন মুখ্যমন্ত্রী পটুয়াপাড়ার মেয়ে, বস্তি, চটিপিসি অনেককিছু কিন্তু সারা বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে উনি বাংলার মেয়ে বাঘিনি মুখ্যমন্ত্রী, সকলের প্রিয় দিদি। তাই উঠতে বসতে টিভি, কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় ওনার ওপর আক্রমণ, কথায় কথায় ভুলধরা, নানান মিম বানিয়ে বিপ্লবী সাজার সব জবাব আবারও পাবেন ছাব্বিশের নির্বাচনে।
রাজ্যের বাম, কংগ্রেস তো ছেড়েই দিলাম, প্রবল প্রতাপের গেরুয়া দলের নামীদামি নেতা এমনকী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও নামুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপক্ষে। কিন্তু আমি লিখে দিচ্ছি, বুথে বুথে ঘুরলেও ভোটের অঙ্কে আপনাদের হারই হবে। তার কারণ মমতা, এই নামটা মানুষের মনের ভিতরে গাঁথতে যে দীর্ঘ সময় তিনি পার করেছেন তাদেরই জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থেকে…সেই ভরসা-বিশ্বাসের বন্ধন ছিন্ন করার চেষ্টাটুকুই আপনাদের কল্পনার অতীত পরিশ্রম। যা করার সাহস বা ক্ষমতা আপনাদের নেই। কোনওদিন হবেও না।
তাই আপনারা স্নো পাউডার মেখে চ্যানেলে-চ্যানেলে বসুন। মাঝেমধ্যে এলাকায় গিয়ে একটু নরমে-গরমে মুখ্যমন্ত্রী-সহ ওনার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো করুন। এগুলোই আপনাদের মানায়। রাজ্যবাসীকে ভাল রাখার জন্য যা কাজকর্ম করার তা করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, থাকবেন।
দার্জিলিংয়ের সাধারণ মানুষ কয়েকজন গতকাল বলছিল—উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করা কাঞ্চনজঙ্ঘা নাকি বহুদিন পরে এমন দেখা যাচ্ছে। হাসতে হাসতে এটাও বলল, দিদি আয়ে না ইসিলিয়ে। হয়তো কাকতালীয়। তবুও মমতার স্পর্শে প্রকৃতি যে খুশি হয় সে তো পাহাড়-জঙ্গলের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনেই স্পষ্টতই পরিলক্ষিত…তাই উনি যতদিন সুস্থ শরীরে থাকবেন, পাহাড় এভাবেই হাসবে। জঙ্গলও শান্ত থাকবে।
আরও পড়ুন-কালীপুজোয় শহরজুড়ে নিষিদ্ধ বাজির কেনা-বেচা নিয়ে সতর্কতা নগরপালের