বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার: ছোট থেকেই স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন মনে। বড় হয়ে বদলে দেবেন সমাজ। দুর্গম গিরি আর কান্তার মরু জয় করার শক্তি তো তাঁর মজ্জায় মজ্জায়। তাই কোনও প্রতিকূলতাকেই তিনি বাধা বলে মনে করেননি। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে আদর্শ মেনেছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সুযোগও চলে এসেছিল হাতের সামনে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে অচিরেই মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন পাহাড়ি-কন্যা সোনম। পুরো নাম সোনম জঙ্গমো ডুকপা। রাজভাতখাওয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। বাড়ি সিঞ্চুলা পাহাড়ের দুর্গম গ্রাম আদমায়। ২৮০০ ফুট উচ্চতার গ্রাম থেকে স্বপ্নপূরণের লড়াই শুরু। কলেজের পড়াশোনা সামলেই তিনি সমাজসেবার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের দুয়ারে। বাড়ি ছেড়ে পিছিয়ে পড়া জনজাতির সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। মানুষের পাশে থাকতে বাসা বেঁধেছেন সেই সকল পরিবারের মাঝেই।
আরও পড়ুন-মুড়িগঙ্গায় বিরল নীল তিমি, আগলে রেখে সাগরে ফেরাল বন দফতর
জন্ম থেকেই দুর্গম পাহাড়ের চড়াই-উতরাই তাঁর নখদর্পণে। পাহাড়িকন্যা স্বপ্ন দেখতেন সমাজের প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি একদিন বদলে দেবেন। মানুষের সীমিত চাওয়া-পাওয়াগুলোকে এনে দেবেন হাতের মুঠোয়। নানা বাধার বেড়াজাল পেরিয়ে তিনি পেরেছেন সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে। তাই আজ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন তিনি।
সোনমের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। পুঁজি বলতে মুখমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আদর্শ ও শৈশব-দেখা স্বপ্ন। সেই আদর্শ স্বপ্নই তাঁকে মানব ও সমাজসেবায় নিযুক্ত করে। পঞ্চায়েত ভোটে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগও চলে আসে তাঁর। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের আদর্শ মানেন সোনম, ডাক আসে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে। তৃণমূলের টিকিটে ভোট-ময়দানে নেমে নির্বাচিত হন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যা। শুরু হয় নিয়মিত রাজনৈতিক আঙিনায় বিচরণ। তখন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি মানুষের উন্নয়নে কাজ। বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করে তাঁর স্বপ্ন।
আরও পড়ুন-বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ডুয়ার্স উৎসবের সূচনা
সোনমের জন্মভিটা আদমায় পৌঁছতে সান্তলাবাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। কারণ সান্তলাবাড়ি থেকে পাকদণ্ডী ধরে পৌঁছতে হয় আদমা গ্রামে। সোনমের পরিবারে রয়েছেন বাবা-মা ও তিন ভাই। বড় ভাই ভুটানে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টারে কাজ করে সোনমের পড়াশোনার খরচ চালান। ছোট দুই ভাইয়ের একজন জয়গাঁওতে ও অপরজন সামসিতে শ্রমিকের কাজ করেন। বাড়িতে থাকা বয়স্ক বাবা পশুপালন ও সামান্য কিছু চাষবাস করে সংসার প্রতিপালন করেন। মা গৃহবধূ হিসেবে বাবার সঙ্গ দেন প্রতিটি কাজে। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা তেমন না থাকলেও, নিজের জীবনের লক্ষ্য একেবারে পরিষ্কার সোনমের। তিনি আগামী দিনে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কাজের সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে চান। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আরও বড় পরিসরে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চান। পাহাড়ের ডুকপা সম্প্রদায়ের এই প্রতিভাবান কলেজছাত্রী পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যা হিসেবে কাজ করার পর, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে রাজভাতখাওয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। সেই গুরুদায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি জয়গাঁও ননী ভট্টাচার্য মহাবিদ্যালয়ে কলা বিভাগে স্নাতকস্তরে পাঠরতা। এরপরেই জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় সোনমকে। গ্রাম প্রধানের দায়িত্ব ও নিজের জীবন গড়ার লড়াই চালাতে ছাড়তে হয় নিজের বাড়ি। পাহাড়ে বয়স্ক বাবা-মাকে রেখে রাজভাতখাওয়ায় থাকতে শুরু করেন সোনম। এই গ্রাম দুর্গম পাহাড়, জঙ্গল, নদীতে ঘেরা। চা-বাগান বেষ্টিত দুর্গম এলাকার মানুষ পরিষেবা নিতে বহু দূর থেকে বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত দফতরে আসেন। মূলত তাঁদের পরিষেবা দিতেই আদমা পাহাড়ের গ্রামে বসবাস করেন প্রধান সোনম। সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কাজ কোনওভাবে ব্যাহত হোক চান না তিনি। পঞ্চায়েত প্রধান কলেজছাত্রী সোনমকে নিয়ে গর্বিত রাজভাতখাওয়া অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমাদের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় জনজাতির মানুষদের এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলেন, আমরা তাঁর সেই আদর্শকে সামনে রেখেই সোনমের মতো একজন ডুকপা জনজাতির কলেজছাত্রীকে পঞ্চায়েত প্রধান করেছি। তিনি এলাকার মানুষের জন্য দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে কাজ করে যাচ্ছেন। আর সোনম বলেন, মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন নিজের সেরাটা দিয়ে মানুষের উন্নয়ন করে যেতে চাই। সপ্তাহ শেষে আবার পাহাড়ি পাকদণ্ডীর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন গ্রামে মা-বাবার কাছে ফিরে যান সোনম সঙ্গে নিয়ে যান মানুষের অনেক আশীর্বাদ। মনে থাকে আত্মসন্তুষ্টির রেশ, যা তাঁকে আগামী দিনের কাজে নতুন করে প্রেরণা দেয়।