আসুন! ঘোড়া কিনি ঘোড়া বেচি, ভাঙি-গড়ি সরকার

হর্স-ট্রেডিং। বঙ্গার্থ ‘ঘোড়া কেনাবেচা’। ভারতীয় রাজনীতিতে এই শব্দবন্ধটিকেই ‘কারেন্ট ট্রেন্ড’-এ ভূষিত করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি।পদ্মপার্টির এই কীর্তিকলাপের আবহে ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতার যোগসূত্র খুঁজে দেখলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

শব্দের ইতিহাস

আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগের কথা। সন ১৮২০-র নিকটবর্তী কোনও সময়। তখনই চালু হল একটি শব্দ বন্ধ, ‘হর্স ট্রেডিং’। যার বাংলা মানে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’। অশ্বব্যবসায়ীদের চালাকি, বদমায়েশি, এসবকে কেন্দ্র করেই শব্দটির আবির্ভাব। ম্যাকমিলান ইংরেজি অভিধান অনুসারে, এই শব্দটিই ক্রমে অপকর্ষের অভিঘাতে একটি বিশিষ্ট অর্থ লাভ করে। দুই পক্ষের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্যে আলোচনা এবং সেই আলোচনার শেষে একটি অপকীর্তি সংঘটিত হলে, পুরো বিষয়টি ‘হর্স ট্রেডিং’ বা ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ এই শব্দবন্ধে চিহ্নিত হয়। রাজনীতির পরিসরে নীতি বিসর্জন দিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও তার পরিণতিতে আপস, এই পুরো ঘটনাটি ক্রমে বিম্বিত হতে থাকে এই নবলব্ধ শব্দ বন্ধটির তির্যক, অভিব্যক্তিতে। কোনও বিল বা আইনসভায় উপস্থাপিত কোনও প্রস্তাবের সমর্থনের প্রশ্নে দুটি পক্ষের মধ্যে নীতিগত অবস্থান জলাঞ্জলি দিয়ে যখন কোনও রফা হয়, তখন তা ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ এই শব্দ বন্ধটির দ্বারা আলঙ্কারিক অর্থে বা বিশিষ্টার্থবাচী প্রয়োগে ‘অভিনিন্দিত’ হয়।

আরও পড়ুন-পিস হাভেন গড়ে তুলবে পুরসভা

১৮৯৩-তে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি সম্পাদকীয়তে প্রথম শব্দটিকে অনৈতিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহারের নজির চোখে পড়ে। ওই সম্পাদকীয়তে খবরের কাগজের সার্কুলেশন সংক্রান্ত বিষয়ে ভুয়ো সংখ্যা তুলে ধরার কাজটিকে বেআইনি ঘোষণা করার জন্য আইন পাশের প্রস্তাব আইনসভায় আনীত হলে সেটির তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং সেই প্রসঙ্গেই ওই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়। তথায় লিখিত হয়েছিল, স্পষ্ট ভাষায়, ‘‘যদি মিথ্যাচার আইন দ্বারা বন্ধ করা যেত তবে ঘোড়া কেনাবেচা কবেই বন্ধ হয়ে যেত…” (If the lying were stopped by Law, the business of horse trading would come to an end…)।

আরও পড়ুন-ভূমিহীন বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ নোটিশ রেলের

এর বছর পাঁচেক পর মার্কিন ব্যাংকার তথা লেখক লিখলেন একটি সাড়া জাগানো উপন্যাস। নাম ‘ডেভিড হারুন’। বিষয়বস্তু, মার্কিন জীবনের কাহিনি (A story of American life)। সেখানে ‘হর্স ট্রেডিং বা ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ শব্দ বন্ধটিকে কাহিনির মুখ্য চরিত্র ডেভিড অধুনা প্রচলিত অনৈতিক ধারণার সঙ্গে অন্বিত করে।
সকল ব্যবসায়িক লেনদেনকে ঘোড়া কেনাবেচার আতশকাঁচে দেখত ওই চরিত্র। বলা হয় শব্দবন্ধটির জনপ্রিয়তা বা বহুল ব্যবহার ওই উপন্যাসের সৌজন্যে।
এরপর আস্তে আস্তে ‘লগরোলিং’ (log rolling) শব্দটিকে হটিয়ে ‘হর্স ট্রেডিং’ শব্দবন্ধটি প্রবলভাবে প্রযুক্ত হতে শুরু করে। তুমি আমাকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলে বিনিময়ে আমিও তোমাকে খানিকটা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেব, অর্থাৎ ল্যাটিনে যাকে বলা হয় ‘কুইড প্রো কুয়ো’, এই অর্থে ব্যবহৃত হত ‘লগ রোলিং’ শব্দটি। স্বার্থসিদ্ধি হলে আইনসভার সদস্যরা বিরুদ্ধবাদীদের সহায়তা করে থাকেন, এমনটা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত হত। ভোট কেনাবেচার এই অর্থের আলোতেই বিকচিত হয় ‘হর্স ট্রেডিং’ বা ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ কথাটি।

আরও পড়ুন-বিলকিস গণধর্ষণ পথে মহিলা তৃণমূল

ইতিহাস থেকে আজ
ভাষাতত্ত্বের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে জার্মান, সুইডিশ, ফিনিশীয় প্রভৃতি ভাষায় ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র বদলে ‘গোরু কেনাবেচা’ কথাটি অভিন্ন আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহার গৌরব অর্জন করেছে। ১৯৩৩-এ সুইৎজারল্যান্ডের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে সুইডিশ কারমারস লিগের সমঝোতা এই শব্দেই চিহ্নিত হয়েছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপার! কোনও এক অজানা অন্বয় গুণে ভারতের গো-বলয়ে রাজনীতির বৃত্তে এই কথাটি মান্যতা অর্জন করে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়টিকে অশ্ব ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে না জড়িয়ে রামের যাতায়াত হিসেবে চিহ্নিত করা হত। ১৯৬৭-তে হরিয়ানা বিধানসভায় দলবদলের হিড়িক, বিধায়কদের রোজ জার্সি বদলের ঘটনা, ‘আয়া রাম গয়া রাম’ কথাটির দ্বারা ‘অগৌরব’ অর্জন করেছিল। এবং ততধিক আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমানে আমাদের দেশে স্বঘোষিত শ্রীরাম পূজারির দল, গেরুয়া পার্টি বা পদ্ম পক্ষ এই ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ কথাটিকে বর্তমান রাজনীতিতে একটি ভয়ানক প্রাসঙ্গিক বিষয় করে তুলেছেন।

আরও পড়ুন-কৌশিকী অমাবস্যার নিশিপুজোয় ভক্তের ঢল

হয়ত কাকতালীয়। কিন্তু শব্দের বিকাশ ও বিন্যাস এমন অদ্ভুত যোগাযোগ, ভৌগোলিক বৃত্ত ছাড়িয়ে সামাজিক পরিসরে, একযোগে ভ্রুকুঞ্চন ও বাকরহিত বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এতে কোনও সন্দেহ নেই।
আজকের ভারতে
বর্তমান ভারতে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ কথাটিকে সংবাদমাধ্যমে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে গেরুয়া আগ্রাসন। বিজেপি-বিরোধী প্রতিটি ভারতীয় রাজ্য এখন সেই দন্ত-নখবিস্তারী ভয়ংকর আগ্রাসী অনৈতিকতার মোকাবিলা করছে।
২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রবলভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতায় বিজেপি বুঝে ফেলেছে, জনতার রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিধানসভা দখল করা সুষ্ঠতর ভাষায় বললে সিংহদ্বার দিয়ে মাথা উঁচু করে মুখমন্ত্রিত্বের গৌরব অর্জন করা, তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তখন থেকেই চালু হয়ে যায় বিরোধী-শাসিত রাজ্যসমূহে ‘অপারেশন লোটাস’। এই অপারেশনের কী-ওয়ার্ড বা মুখ্য শব্দচ্ছ এরকম— আত্মসমর্পণ করতেই হবে। নগদ রেডি আছে। লোভ দেখিয়েও যদি ‘ম্যানেজ’ করা না যায়, তবে রয়েছে ‘কেন্দ্রীয় এজেন্সির শক্তি প্রদর্শন’।

আরও পড়ুন-মরুবিজয়িনী সুচেতা

ভারতের মানচিত্রে গেরুয়াকরণের লক্ষ্য যত ধূসর হচ্ছে, তত বিজেপি-র ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ করে রাজ্য দখলের তাড়না বাড়ছে। একেবারে সমানুপাতিক সম্পর্ক।
তাই, তাই-ই, একে একে ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে অবিজেপ-শাসিত রাজ্যগুলিকে। মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, মহারাষ্ট্রের পর গেরুয়া পার্টির চেষ্টা জারি আছে দিল্লিতে এবং ঝাড়খণ্ডে। কোটি কোটি টাকা ব্যবহৃত হচ্ছে এই কার্যক্রম সফল সার্থক করে তোলার জন্য। সারা ভারতকে গেরুয়া রঙে রাঙাতে বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে ময়দান দাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে যারা, নীতি কাণ্ডারির মুখোশ সাঁটিয়ে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের চৌকিদার হয়ে উঠেছে যারা, তাদের বিপুল অর্থের উৎস কী, সেটা তদন্ত করার জন্য কিন্তু কোনও এজেন্সিকে দূরবিন দিয়েও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কেবল আশ্চর্যের বিষয় নয়, বিপুল দুঃখের বিষয়ও বটে।

আরও পড়ুন-হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা, তুখোড় শিল্পী সুলতা চৌধুরি

অতঃকিম
হর্স ট্রেডিংয়ের সওদাগররা যদি ভারতের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সংগুপ্ত ট্রোজান হর্সদের নিকেশ করে বৈষম্য হ্রাসের পথে হাঁটতেন, তবে দেশটা বোধহয় বেঁচে যেত। অন্তত দেশের গরিবগুর্বোগুলো।

Latest article