বর্ষায় দুর্গম হয়ে ওঠে পাহাড়ি রাস্তা। যদিও বৃষ্টির মরশুমে ঢেউ খেলানো পাহাড় আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে মায়াবী। একটু ঝুঁকি নিয়ে এই সময় বেড়াতে গেলে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া যায়। অন্য রাজ্যে নয়, বৃষ্টিদিনে ঘুরে আসতে পারেন আমাদের রাজ্যের একটি অসাধারণ হিল স্টেশনে। কালিম্পংয়ের রিকিসুম (Rikisum)। যেমন মিষ্টি নাম, তেমনই মিষ্টি জায়গা। পেডং থেকে ৮ কিলোমিটার এবং কালিম্পং থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ে প্রায় ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
নির্জন নিরিবিলি রিকিসুম হল ফুলের উপত্যকা। রংবাহারি নাম না জানা নানা পাহাড়ি ফুলে ঢেকে থাকে গ্রামটি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে দেখা যায় টাইগার হিল। রিকিসুম থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য মনের মধ্যে গেঁথে যায়। পাইন গাছের জঙ্গল আর ঝিরঝিরে হাওয়ায় মন ভাল হতে বাধ্য।
পাহাড়ের রূপ প্রতিটি ঋতুতেই এক-এক রকম। রিমঝিম বর্ষায় রিকিসুম হয়ে ওঠে উদ্দাম কিশোরীর মতো। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ৩৬০ ডিগ্রি রূপ দেখতে পাওয়া যায়। যদিও বর্ষার সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তবে মেঘের খেলা দেখতে পাওয়া যায় সবুজ পাহাড় জুড়ে। ভুটান পাহাড়ের একাধিক চূড়াও দেখা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে তবেই পাহাড়ের শৃঙ্গগুলোর দেখা মিলবে। কিছুটা দূরে তিস্তা নদী। তবে বর্ষার তিস্তা এড়িয়ে চলাই ভাল। দেখতে হবে চঞ্চলা ঝর্নার সৌন্দর্য। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা ট্রেক করেন। অনেকেই থাকেন তাঁবু খাটিয়ে। যদিও বর্ষায় কিছুটা বিপজ্জনক। বিয়ের পর অনেকেই রিকিসুমে মধুচন্দ্রিমার জন্য আসেন।
আরও পড়ুন-নিবার্চন কমিশনের কীর্তি, এবার রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেটে ট্রাক্টরের নাম
অবস্থানগত কারণে রিকিসুমের (Rikisum) উপরে বাড়তি নজর ছিল ইংরেজ শাসকদের। এখানে তাদের একটা বাংলো ছিল। কথিত আছে, ১৯০২ সালে তৈরি হয়েছিল বাংলোটি। তবে পরবর্তী সময় এই বাংলোর একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে বাংলোর ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাওয়া যায়।
রিকিসুমের আশেপাশে আছে বেশকিছু বেড়ানোর জায়গা। তারমধ্যে অন্যতম কুয়াশা ও মেঘে ঢাকা পাইন গাছে ঘেরা লাভা। গ্রামটি রিকিসুম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০১৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ভূটানের সঙ্গে বাণিজ্যের পুরনো পথের মধ্যে অবস্থিত গ্রামটি রয়েছে ২৩৫০ মিটার উচ্চতায়। প্রকৃতি উপভোগ ও পাখি দেখার জন্য বিখ্যাত লাভা। নেওরাভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ওঠার সূচনাবিন্দুও। শিলিগুড়ি থেকে সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ডামডিম-গরুবাথান হয়েও লাভা যাওয়া যায়। উন্নত ও সুব্যাপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপোলি মুকুট লাভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। মূল শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলের নিরিবিলি পথে ঘুরে বেড়ালেও মন তরতাজা হয়ে উঠবে।
প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় লেপচা-অধ্যুষিত গ্রাম রিশপ। বেড়ানোর দারুণ জায়গা। রিকিসুম থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ পাহাড়ের ধাপে ধাপে নানা রকমের ফুলে ঢাকা ছোট্ট সাজানো গ্রাম। রিশপ শব্দের অর্থ ‘পাহাড়ের মাথায় একলা গাছে’। ঢাল বেয়ে চাষের জমি দেখতে অপূর্ব লাগে। রিশপকে ঘিরে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, সিনিয়ালচু, পান্ডিম-সহ নানান শৃঙ্গ। সারা রিশপে সবসময় অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে থাকে। জঙ্গলের মধ্যে ট্রেক করে যাওয়া যায় দেড় কিলোমিটার দূরের টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট।
রিকিসুম (Rikisum) থেকে ঘুরে আসা যায় কোলাখাম। ২১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অপূর্ব নিসর্গ নিয়ে কোলাখাম পর্যটকদের স্বাগত জানাতে তৈরি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, চোখ মেললে সামনে দেখা যায় তুষারধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা। কোলাখাম থেকে যে রাস্তাটি চলে গেছে লাভার দিকে, তার প্রায় সবটাই গিয়েছে নেওড়া ভ্যালি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। এই রাস্তা ধরে এগোলে চোখে পড়ে অজস্র পাখি। ডার্ক সাইডেড ফ্লাই ক্যাচার, রুফাস সিবিয়া, গ্রিন-ব্যাকড টিট ইত্যাদি। সন্ধেবেলা কোলাখাম থেকে দেখা যায় আলো-ঝলমলে রিশপ। মনে হয় অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে অজস্র উজ্জ্বল হীরকখণ্ড। ছাঙ্গে ঝর্নার উদ্দেশ্যে যেতে হবে ঘন জঙ্গল চিরে। কানে আসবে জলপ্রপাতের প্রবল শব্দ। ৩০০ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দিয়েছে জলধারাটি। সবমিলিয়ে রিকিসুম- ভ্রমণ মনের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দের জন্ম দেবে। বৃষ্টিদিনে ঘুরে আসতে পারেন।