দার্জিলিংয়ের অফবিট পর্যটন কেন্দ্র রিম্বিক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮৬ মিটার উচ্চতায়, ভারত এবং নেপালের সীমান্তে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান এলাকায় অবস্থিত। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। সবুজ পাহাড়, কুলকুল ঝর্ণাধারা এবং আঁকাবাঁকা স্রোত দিয়ে ঘেরা। শীতের দিনে বরফের চাদরে ঢাকা। এককথায় প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। এখান থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্ময়কর দৃশ্য। এই দৃশ্য মনকে নিয়ে যায় অন্য জগতে। শীতল পরিবেশ গরমের দিনেও দেয় অফুরান আরাম।
তবে রিম্বিক প্রচলিত পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কোলাহল থেকে বেশ কিছুটা দূরে। নির্জন, নিরিবিলি। ঝকঝকে তকতকে। ছবির মতো সুন্দর। দার্জিলিংয়ের প্রকৃত সংস্কৃতি এবং জীবনধারা সম্পর্কে জানতে হলে এই পাহাড়ি শহর হতে পারে উপযুক্ত জায়গা।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য রিম্বিক একটি স্বপ্নের গন্তব্য। এই অঞ্চলে রয়েছে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেক রুট সান্দাকফু-ফালুট। এই ট্রেকটি কেবল হিমালয়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যই চোখের সামনে তুলে ধরে না, বরং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও দেয়।
ঘন সবুজ বনাঞ্চলে ঘেরা। রয়েছে অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমৃদ্ধ সমাহার। জীববৈচিত্র্যপ্রেমীদের জন্য মন ভাল করে দেওয়ার মতো একটি জায়গা। নানা প্রজাতির বিদেশি পাখি, বিরল প্রাণী এবং অনন্য উদ্ভিদের দেখা মেলে।
আরও পড়ুন-সুকান্তর স্ত্রী দুই জায়গায় ভোটার, অভিযোগ কমিশনে
রিম্বিক একটি সাংস্কৃতিক মিশ্রণস্থল। লেপচা, ভুটিয়া, শেরপা এবং তামাংদের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস। প্রতিটি সম্প্রদায় নিজস্ব রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্য নিয়ে পর্যটকদের অপেক্ষায় থাকে। মঠ এবং মন্দির পরিদর্শন করেও স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষ করা যায় প্রাচীন রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠান। এই সবকিছু সমৃদ্ধ করে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে।
রিম্বিকের কাছে-পিঠে আছে বেশকিছু বেড়ানোর জায়গা, দর্শনীয় স্থান। হাতে সময় নিয়ে ঘুরে দেখা যায়। এখানকার জাপানি শান্তি প্যাগোডা দেখার মতো। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে, জলপাহাড় পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, ঐক্য এবং সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মিত। জানা যায়, জাপানি বৌদ্ধভিক্ষু নিচিদাতসু ফুজির নির্দেশনায় স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল। ডিজাইন করেছিলেন এম ওহকা। বুদ্ধের চারটি অবতারের মূর্তি দেখা যায়। এককথায় অসাধারণ।
ঘুরে আসা যায় ঘুম মঠ। এই বৌদ্ধবিহার পরিদর্শন না করলে রিম্বিক ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। ঘুম মঠটি ইগা চোয়েলিং নামেও পরিচিত। এখানে মৈত্রেয় বুদ্ধের একটি অসাধারণ ৪.৬ মিটার উঁচু মূর্তি রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, ভবনের কাঠামোটি ১৮৫০ সালে মঙ্গোলীয় জ্যোতিষী এবং সন্ন্যাসী সোকপো শেরাব গ্যাতসোর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে তিব্বত দখলের সময় মঠটি বহু উচ্চপদস্থ সন্ন্যাসীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছিল। নীরবতা এবং প্রশান্তি উপভোগ করার জন্য এই মঠ একটি দুর্দান্ত জায়গা। ধ্যান-করা এবং কিছু সময় চুপচাপ বসে কাটানো যায়।
প্রায় ৬৮ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। ঘুরে আসা যায়। লাল পান্ডা, হিমালয় নেকড়ে এবং তুষার চিতা প্রজনন কর্মসূচির জন্য সুপরিচিত। দেখা যায় আরও কিছু বন্যপ্রাণী। এছাড়াও ওক, অ্যাল্ডার, বার্চ সহ প্রায় ২০০ রকমের গাছপালা রয়েছে।
নাইটিঙ্গেল একটি মনোমুগ্ধকর পার্ক, যা পর্যটকদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। একটা সময় ‘ঝোপঝাড়’ নামে পরিচিত এই সবুজ পার্কটি ব্রিটিশ শাসনকালে ছিল একটি ব্যক্তিগত জায়গা। পরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পার্কের মধ্যে হাঁটাচলা করতে বেশ ভাল লাগে। এখান থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ।
রিম্বিকের খুব কাছেই, মল রোডের ঠিক উপরে অবস্থিত অবজারভেটরি হিল। উঁচু পাহাড়। দার্জিলিংয়ের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এখানে আছে মহাকাল মন্দির, কাঞ্চনজঙ্ঘা মন্দির এবং তিব্বতি স্মৃতিস্তম্ভের মতো কয়েকটি মন্দির। ধর্মপ্রাণ মানুষদের অন্যতম প্রিয় জায়গা। অনেকেই মল রোড থেকে খাড়া চড়াই পথ এবং একটি ছোট গুহা দিয়ে ১৫ মিনিটের ছোট হাইকিং উপভোগ করেন। বেড়ানোর সময় দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন এবং রোপওয়ে যাত্রা কোনওভাবেই মিস করবেন না। সবমিলিয়ে রিম্বিক ভ্রমণ মনের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দের জন্ম দেবে। গরমের মরশুমে সপরিবার ঘুরে আসতে পারেন।
আরও পড়ুন-পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ নজর
কীভাবে যাবেন?
রিম্বিকের নিকটতম বিমানবন্দর হল বাগডোগরা। বিমানবন্দর থেকে টানা গাড়ি পাওয়া যায়। শিলিগুড়ি এবং নিউ জলপাইগুড়ি জংশন হল কাছাকাছি দুটি প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ প্রধান রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতিদিন নিউ জলপাইগুড়ি জংশনে বেশ কয়েকটি ট্রেন চলাচল করে। যারা রিম্বিক ভ্রমণ করতে চান তাঁরা শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং হয়ে সহজেই পৌঁছাতে পারেন। শিলিগুড়ি বা বাগডোগরা থেকে রিম্বিক প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন?
রিম্বিকে হোটেল বা গেস্ট হাউস নেই বললেই চলে। আছে বেশকিছু হোমস্টে। মালিকেরা যথেষ্ট আন্তরিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ। অবশ্যই স্বাদ নেবেন স্থানীয় খাবারের। নিরামিষ এবং আমিষ— দু’রকম খাবারই পাওয়া যায়। স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলো বেড়ানোর আগে হোমস্টের মালিকের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যায়।