দামে আগুন, পুড়ছে মানুষ

Must read

পেট্রোপণ্যের দামে বেলাগাম বৃদ্ধি ঘটিয়ে এখন কমানোর নাটক । এদিকে সেই আঁচ গোটা বাজারে। আনাজপাতি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য— সব জিনিসের অগ্নিমূল্য। ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন এখন দহনজ্বালায় জ্বলছে। লিখছেন অধ্যাপক ড. অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, কার্যত সেইদিন থেকে চালু হয়েছে সরকারের শ্রেণি ভাগ করার বিষয়টি। এরকম শ্রেণিবিভাগ গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও করেছিলেন। তাঁর মতে সরকার দুই প্রকার। সুতরাং একটা হল সেই ধরনের সরকার যে জনগণের স্বার্থ বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। অ্যারিস্টটল এ-ধরনের সরকারকে আদর্শ সরকার বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয় ধরনের সরকার হল বিকৃত সরকার। এই ধরনের সরকার কেবল গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থকে প্রধান্য দেয়।
আলোচনার শুরুতেই এই শ্রেণিবিভাগের কথা তুলে ধরলাম যাতে পাঠক নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে নিতে পারেন বর্তমানে দিল্লিতে ঠিক কী ধরনের সরকার রাজ করছে।

আরও পড়ুন-দামে আগুন, পুড়ছে মানুষ

গত অর্থবর্ষে এপ্রিল–সেপ্টেম্বর সময়সীমার মধ্যে কেন্দ্রের মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যা ছিল চলতি অর্থবর্ষে ওই একই সময়কালে তার পরিমাণ ৬৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর এবং কর-বহির্ভূত আয় বেড়েছে ৯৬.৩ শতাংশ। মোট ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বৃদ্ধির পরিমাণ ৯.৯ শতাংশ। ফলত, ২০২১-’২২-এর প্রথম দফায় আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ৫ লক্ষ ২৬ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। সারা বছরের জন্য তৈরি বাজেটে যতটা ঘটতি হবে বলে প্রত্যাশিত ছিল, তার তুলনায় এই দফার এই ঘাটতির পরিমাণ মোটে ৩৫ শতাংশ বেশি। এক্ষেত্রে ‘মোটে’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যবাহী। সুইস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক ক্রেডিট সুইজি বলছে, ২০০৭-’০৮-এর পর প্রত্যাশার তুলনার আসল ঘাটতির পরিমাণ কখনও এতটা কম ছিল না। বিগত দশ বছরে গড়ে প্রত্যাশার চেয়ে প্রকৃত ঘাটতি ৭৪ শতাংশ বেশি ছিল। অর্থাৎ, এক কথায়, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আগে বাজটে কেন্দ্র আর্থিক পরিস্থিতির যে ছবি এঁকেছিল, বাস্তবে কেন্দ্রের আর্থিক অবস্থা তার চেয়ে ভাল, অনেকটাই ভাল। অতিমারির থাবা কেন্দ্রের রাজস্ব সংগ্রহে বিশেষ ছাপ ফেলতে পরেনি। এই সত্যিটার সমান্তরালে আরও একটি সত্যি নির্লজ্জভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। সেটা হল এই যে, কেন্দ্রের খরচ করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও এখন রয়েছে। গত বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে কেন্দ্রের অর্থ দফতর ব্যয়ে কাটছাঁটে সেরকম যথেচ্ছ পদক্ষেপ করছিল, আর্থিক ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে যেভাবে সমস্ত খাতে খরচ কমানোর পথে হাঁটছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত তেমনটা করার দরকার পড়ছে না।
এই যে আপাত-উজ্জ্বল পরিস্থিতি, এর পেছনে দুটো সম্ভাব্য কারণ বর্তমান।
এক, এপ্রিল-সেপ্টেম্বর, ২০১৯-এ করবাবদ যে রাজস্ব সংগৃহীত হয়েছিল তার তুলনায় এবার মোট কর রাজস্ব আদায় ২৮.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নোটবন্দি, জিএসটি আদায় এবং লকডাউন পর্বের সুবিধা নিয়ে বড় বড় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো অসংগঠিত ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর বাজারের একটা বড় অংশ নিজেদের কবজায় আনতে সক্ষম হয়েছে। বড় ব্যবসায়ীদের কর দেওয়ার অঙ্কটা সব সময় বড় হয়। কারণ, তাদের হিসাবপত্র মোটামুটি সবই নথিবদ্ধ থাকে। তা ছাড়া, তাদের ওপর সহজে নজরদারি চালানো যায়। ফলে, তাদের কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় করবাবদ অর্থ বুঝে নেওয়াটা সহজতর। ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই সুবিধাটা সরকার পায় না। এখন, বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠায় আর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা মৃতপ্রায় দশায় পৌঁছানোর কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের কর আদায়ে গড়ে তোলা কোষাগারটি বেশ নাদুস-নুদুস হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন-জ্বালানীর শুল্ক কমানো নিয়ে কেন্দ্রকে কটাক্ষ কুণালের

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, যখন দেখি, এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০১৯-এর তুলনায় এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০২১-এ কর্পোরেট হাউসগুলো থেকে আদায় করা করের পরিমাণ ২৩.৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে আয়কর বাবদ আদায় বেড়েছে ২৮.৭ শতাংশ।
এ-সব যদি কেন্দ্রীয় কোষাগারের শ্রীবৃদ্ধির একটি সম্ভাব্য কারণ হয়, তবে অপর কারণটি অবশ্যই পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দামবৃদ্ধি।
এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ কেন্দ্রের জ্বালানি থেকে রাজস্ব বাবদ আয়ের অঙ্কটা ছিল ৯৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০২১-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার ৬৮ কোটি টাকায়। পেট্রোপণ্যে আরোপিত শুল্ক থেকেই এই আয়বৃদ্ধি, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৩৩ শতাংশ।
অতিমারির আক্রমণে যখন দেশে বাড়ছিল ক্ষুধা, বাড়ছিল বেকারত্ব, তখন লুঠেরার মতো পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসে শুল্ক চাপিয়ে, ক্রমাগত দাম বাড়িয়ে তার থেকে কালোবাজারি কারবারির মতো মুনাফা তুলেছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। স্রেফ গত এক বছরে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েছে ৭০ বারেরও বেশি। লিটারপিছু পেট্রোল-ডিজেলের দাম গড়ে ২৭ টাকা বেড়েছে। তার ফলে, আনাজপত্র থেকে শুরু করে চাল-ডাল-তেলের মতো নিত্যপ্রয়েজনীয় জিনিসের দামও আকাশছোঁয়া হয়েছে। আর এখন ৫/১০ টাকা দাম কমিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে। কোভিডের ধাক্কায় দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় কমেছে। তার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বেলাগাম দামবৃদ্ধি এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। গরিব মধ্যবিত্তের হেঁশেলে টান পড়েছে। অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ভারত নামতে নামতে ১১৬টি দেশের তালিকায় ১০০টি দেশের পেছনে, ১০১-এ এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানও এই সূচকের নিরিখে আমাদের থেকে এগিয়ে গিয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে— শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, এমনকী পাকিস্তানের চেয়েও আমাদের দেশে পেট্রোপণ্যের দাম অনেকটাই বেশি। গত মাসের ২৫ তারিখেও পাকিস্তানে লিটারপিছু গ্যাসোলিনের দাম ছিল ০.৭৯০ মার্কিন ডলার। আর তখন ভারতে ওই দাম ছিল ১.৪৪৫ মার্কিন ডলার। এর পরে দাম আরও বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যান্য দ্রব্যের দামও।

আরও পড়ুন-জ্বালানীর শুল্ক কমানো নিয়ে কেন্দ্রকে কটাক্ষ কুণালের

মোদ্দা কথা, অতিমারিপর্বে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়ে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে মোদি-শাহ-নির্মলার সরকার। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে পেট্রো বন্ডে দেনা ছিল। বন্ডের দেনা মেটানোর কথা ২০২৫-এর মধ্যে। এর মধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়ে সেই দেনাবাবদ যে টাকা পরিশোধ করার কথা তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ টাকা তুলেছে (পড়ুন লুটেছে) কেন্দ্রের মোদি সরকার। তারপরও এরা পেট্রোল-ডিজেলের দামবৃদ্ধি নিয়ে নানা অজুহাত দিচ্ছে।
তাঁদের যেটা করা উচিত— এক, মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য পেট্রোপণ্যে এক্সাইজ শুল্কে অধিক হ্রাস; দুই, রাজ্যগুলোর জিএসটি বাবদ যে বকেয়া আছে তা মিটিয়ে দেওয়া। কিন্তু রোম যখন জ্বলে তখন সম্রাট নিরো বেহালা বাজান। আর ভারতের মানুষ যখন দামের আগুনে পুড়ছে তখন ‘অচ্ছে দিন’-এর ফেরিওয়ালারা মুখ ফিরিয়ে লাভের কড়ির হিসাব কষেন।
দীপাবলির আগে যে শুল্ক কমানোর নাটক হল তা শুধু গত অক্টোবর মাসে পেট্রো পণ্যের যে দাম বাড়ানো হয়েছিল, তার সমান।
এদের জন্য একটাই শব্দ অন্তরের অন্তস্তল থেকে বেরিয়ে আসে। ছিঃ!

Latest article