কেরলে কমরেডদের কীর্তি কেলেংকারি

পশ্চিমবঙ্গে কত কথা! রাত দখলের সলতে পাকানো। মশালে তেল জোগানো, মোমবাতিতে দেশলাই ধরানো। কমরেডদের সৎ আর সাধু রূপের অজস্র ভন্ডামি। ৩৪ বছর ধরে ওদের চিনেছে বাংলা। স্বভাব যে বদলায়নি, সে প্রমাণ দিচ্ছে কেরল, যেখানে আজও লাল জমানা। আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মুরোদ নেই যাদের, তারা বাংলায় বিভ্রান্তির বীজ ছড়াতে চায়। সত্য সেলুকাস! লিখছেন ডাঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার

Must read

গত দশক ধরে কেরলের রাজনৈতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিপিআই (এম) এবং এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ সমাজে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনাগুলি শুধুমাত্র অপরাধের পরিসংখ্যান নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সংগঠনগত দায়িত্বের ঘাটতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। নিম্নে এই সময়কালের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তাদের বিশ্লেষণ এবং সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা করা হল।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১. সেবিন ফ্রান্সিসের ধর্ষণ মামলা ২০২৪ সালের অক্টোবরে সিপিআই(এম)-এর একটি শাখা সম্পাদক এবং শিক্ষক সেবিন ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে এক কিশোরী ছাত্রীকে বারবার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই নৃশংস ঘটনায় পকসো আইনের আওতায় মামলা রুজু হয় এবং অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনা দলের স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং দায়িত্বহীনতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

আরও পড়ুন-বন্যা-নিয়ন্ত্রণে ডুয়ার্সের নদীতে ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা রাজ্যের

সিদ্ধার্থনের মর্মান্তিক মৃত্যু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ায়ানাডের পশুচিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জে এস সিদ্ধার্থনকে হস্টেলে প্রচণ্ড র‍্যাগিং ও মারধরের শিকার হতে হয়। তদন্তে প্রকাশ পায় যে, এসএফআই-এর কয়েকজন নেতা এই ঘটনায় জড়িত ছিলেন। নির্যাতনের জেরে সিদ্ধার্থন আত্মহত্যা করেন, যা রাজ্য জুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও দলীয় সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তবে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএফআই-এর আধিপত্য এবং হিংস্র সংস্কৃতি নিয়ে।
অভিমান্যুর হত্যা ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এর্নাকুলামের মহারাজা কলেজে এসএফআই নেতা অভিমান্যুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট উঠে আসে। যদিও এটি সরাসরি সিপিআই (এম) বা এসএফআই-এর নীতির ফল নয়, তবে এই ঘটনা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতার একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
পালাক্কাডে নাবালিকাদের ধর্ষণ ও আত্মহত্যা (২০১৭-২০১৯) পালাক্কাডে দুই নাবালিকার ধর্ষণ ও পরবর্তী আত্মহত্যার ঘটনায় সিপিআই (এম)-এর যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-এর কিছু সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালে আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হালকা চার্জশিট দাখিল করে যা রাজনৈতিক চাপের অভিযোগের জন্ম দেয়। এই ঘটনা বিচার ব্যবস্থায় দলীয় প্রভাবের প্রশ্ন তুলেছে।
মলয়ালম ‘মি টু’ আন্দোলন ও সিপিআই (এম) বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০২৪ সালের আগস্টে মলয়ালম চলচ্চিত্র জগতে ‘মি টু’ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সিপিআই (এম) বিধায়ক এবং অভিনেতা এম মুকেশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিনেত্রী ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনেন।
এই অভিযোগগুলি দলের ভাবমূর্তিতে গভীর আঘাত হানে এবং নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে সিপিআই (এম)-এর অবস্থানকে দুর্বল করে।

আরও পড়ুন-বিধ্বংসী সিরাজ, জয়ের খোঁজে ভারত

বিশ্লেষণ : কারণ ও প্রভাব
১. সংগঠনগত ক্ষমতার অপব্যবহার
এই ঘটনাগুলির পেছনে সিপিআই (এম) ও এসএফআই-এর স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষমতার অপব্যবহার একটি প্রধান কারণ। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসএফআই-এর প্রভাব এবং র‍্যাগিং-এর নামে হিংস্রতা একটি বিষাক্ত সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সেবিন ফ্রান্সিস বা সিদ্ধার্থনের মতো ঘটনায় দলীয় নেতাদের জড়িত থাকা এই সমস্যার গভীরতা প্রকাশ করে।
২. বিচারে রাজনৈতিক প্রভাব
পালাক্কাডের নাবালিকা ধর্ষণ মামলা বা মুকেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্তে বিলম্ব বা হালকা চার্জশিটের অভিযোেগ রাজনৈতিক চাপের ইঙ্গিত দেয়। এটি
জনগণের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করেছে।
৩. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
সিদ্ধার্থনের মৃত্যু এবং ‘মি টু’ আন্দোলনের পর কেরলের সমাজে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মলয়ালম চলচ্চিত্র জগতের অভিনেত্রীদের সাহসী পদক্ষেপ সিপিআই(এম)-এর ভাবমূর্তিকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছে। এই ঘটনাগুলি নারী নিরাপত্তা এবং ক্যাম্পাসে সহিংসতার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।
দলীয় শৃঙ্খলার অভাব
সিপিআই(এম) এবং এসএফআই-এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার অভাব এই অভিযোগগুলির পুনরাবৃত্তির একটি বড় কারণ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কঠোর পদক্ষেপের অভাব এবং দলীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
প্রস্তাবিত সমাধান
স্বাধীন ও কঠোর তদন্ত
এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে সিআইডি বা বহিরাগত আইনজীবীদের দ্বারা স্বাধীন অপরিহার্য। রাজনৈতিক চাপমুক্ত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কার
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে র‍্যাগিং ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং এবং অভিযোগ জানানোর নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।
দলীয় সংস্কার ও স্বচ্ছতা
সিপিআই(এম) এবং এসএফআই-এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা জোরদার করতে হবে। অভিযুক্তে তৎক্ষণাৎ সাসপেন্ড করা এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দলের নেতৃত্বকে স্বচ্ছতার সঙ্গে জবাবদিহি করতে হবে।

আরও পড়ুন-অপহরণ করে গাড়িতে চাপিয়ে চম্পট,  নাবালিকার বাড়িতে হুমকি, ধর্ষক এবার যোগীর পুলিশই

সামাজিক সচেতনতা ও নারী নিরাপত্তা
‘মি টু’ আন্দোলনের মতো উদ্যোগকে সমর্থন করে নারী নিরাপত্তা এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা শিক্ষার প্রচলন করা যেতে পারে।
উপসংহার— ২০১৫ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত কেরলে সিপিআই (এম) এবং এসএফআইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যার অভিযোগ শুধুমাত্র অপরাধের ঘটনা নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্ধতা এবং সংগঠনগত দায়িত্বহীনতার একটি ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনাগুলি দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর তদন্ত, দলীয় সংস্কার এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সিপিএম এবং এসএফআই-এর নেতৃত্ব যদি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৎ ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ না নেয়, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং জনসমর্থন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Latest article