কোনও বিষয়ে জোরালো কোনও অবস্থান নেই। রাজ্যে রাজ্যে সিদ্ধান্তহীনতার শিকার এই শতাধিক বছরের প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি। জনভিত্তিক রাজনৈতিক দলের চারিত্র খুইয়ে কংগ্রেস এখন গণ আন্দোলনকে জোরদার করার জায়গায় নেই। এক সময়ের গ্রেট কংগ্রেস এখন ডার্টি কংগ্রেস। ইতিহাস ও বর্তমান ঘেঁটে মূল্যায়ন করেছেন জয়ন্ত ঘোষাল
কংগ্রেসের এই যে অধঃপতন, এই যে মিস ম্যানেজমেন্ট, এই যে অবক্ষয় এটা কিন্তু আজ হঠাৎ শুরু হয়েছে এমন নয়।
সুতরাং সবটাই রাহুল গান্ধীর জন্য হয়েছে এমনটা বললে সত্যের অপলাপ হয়।অথচ এই মুহূর্তে দেখছি পাঞ্জাব শুধু নয়, বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের এই দিশাহীনতা স্পষ্ট।
ছত্তিসশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল। সেখানে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি টি এস সিংদেও মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর দাবিতে সক্রিয়। ভূপেশ বাঘেল এসে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন টি এস সিংদেও, তিনিও দেখা করেছেন। তার কারণ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় ক্ষোভ বিক্ষোভ ভালমতোই ছিল। আর সেটার মোকাবিলা করার জন্য তখন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কথা দিয়েছিলেন যে একটা সময়ের পর টি এস সিংদেও-কে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে। অর্থাৎ, Rotational মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাইকম্যান্ড আর সেটা করতে পারছেন না বা করতে চাইছেন না।
আরও পড়ুন-বিশ্বযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া ভ্যান গঘের ছবি নিলামে
তবে ব্যবস্থাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। Rotational মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, Rotational প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়। হয় না, এমনটা নয়। ইজরায়েলে এই মুহূর্তে rotational প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব বাস্তবায়িত করা হয়েছে। কই সে দেশে তো এরকম কোন বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপ দেখা যাচ্ছে না। বরং বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপ থামাতে, ক্ষোভ বিক্ষোভ সামাল দিতে, ইজরায়েলেই এই ব্যবস্থাটা চালু হয়েছে আর সেটা সকলে মানছেনও।
এখানে প্রশ্ন এটাই যে, কেন এই পথে হেঁটে কংগ্রেস তার অভ্যন্তরীণ বিবাদ সামাল দিতে পারছে না কেন?
আসলে রাহুল গান্ধি যেহেতু নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করছেন না সেহেতু তাঁর নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বের মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সেই কারণে কংগ্রেস কর্মীরা, কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের নেতারা উপরতলার নির্দেশ মানছেন না।
রাহুল গান্ধি আসলে যে কী নির্দেশ দিয়েছেন, সেটাই তো স্পষ্ট নয়। গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে। সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে না রাহুল গান্ধির কাছ থেকে। বিভিন্ন নেতাকে বিভিন্ন বার্তা দিলে কখনওই নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে না। নানা জনকে নানা কথা শুনিয়ে অবস্থা মোকাবিলার চেষ্টা করলে কোনও পক্ষই নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং হচ্ছে।
পাঞ্জাবে এটাই হয়েছে বা হচ্ছে। ক্যাপ্টেন অরমিন্দর সিং-এর পক্ষে রাহুল গান্ধি ছিলেন না কি নভজোৎ সিং সিধুর পক্ষে ছিলেন, সেটা তো স্পষ্ট নয়। ফলে কোনও পক্ষই তাঁকে আস্থাভাজন ভাবতে পারেনি। সেইমতো রাজনৈতিক পথ রচনার দিকে এগোতে পারেনি।
আরও পড়ুন-জম্মু-কাশ্মীরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, মৃত ১১
উত্তরাখণ্ডেও একই ব্যাপার। যিনি উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হতে চান, যিনি উত্তরাখণ্ডের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উত্তরাখণ্ডে গিয়ে রাজনীতি করতে চান, তাঁকে পাঞ্জাবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ঝামেলা সামলাতে হবে। বলা বাহুল্য, সেই দায়িত্ব তিনি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন উত্তরাখণ্ডের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে করা হবে কিনা সেই নিয়ে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তুলকালাম চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও ছবিটা আলাদা কিছু নয়। হাইকম্যান্ডের নীতিতে, অবস্থানে স্পষ্টতা না থাকায় অধীর চৌধুরী প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়মিত আক্রমণ করছেন। এদিকে সোনিয়া গান্ধি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চা পানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন এবং সেখানে রাহুল গান্ধী উপস্থিত থাকছেন। সেখানে বিজেপিকে সর্বভারতীয় প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সমবেতভাবে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা কংগ্রেসের নীতি কোনটা কংগ্রেসের কৌশল সবটাই একটা অস্পষ্ট। সবটাই ভাসা ভাসা। কোথাও কোনও বলিষ্ঠ নীতি আঁকড়ে এগোনোর লক্ষণ নেই। কোনও নির্দিষ্ট নীল নকশা প্রণয়ন ও রূপায়নের কোনও উদ্যোগ আয়োজন নেই।
কংগ্রেসের ইতিহাস একশো বছরেরও বেশি পুরনো ইতিহাস। একটা সময় কংগ্রেসের মাধ্যমেই ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশ হয়েছে। স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেসের প্ল্যাটফর্মের সাহায্য নিয়ে ভারতে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিকশিত হয়। তারপর আস্তে আস্তে সেই কংগ্রেসের অবক্ষয় শুরু হয়।
ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস তাঁর ‘Interrogating Politics and Society: Twentieth-Century Indian Subcontinent’ গ্রন্থে লিখেছেন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটা জাতি গঠনের ডায়নামিকস ছিল। আর সেই ডায়নামিকস কালক্রমে নষ্ট হয়। একটা গ্রেট কংগ্রেস থেকে একটা ডার্টি কংগ্রেসে পরিণত হয় দলটি। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট এরপর থেকে ধীরে ধীরে তার যে ঐতিহাসিক লিগ্যাসি সেটা নষ্ট হতে লাগলো। কিন্তু কংগ্রেস ভারতের প্রথম একটা mass based রাজনৈতিক দল। গান্ধিজীর নেতৃত্বে সেই mass mobilizationটা হয়েছিল। কিন্তু এই কংগ্রেস গঠনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির যে radicalism এর দিকটা ছিল সেটার marginalisation হয়েছে বলে সুরঞ্জন দাস মনে করেন। (পরের অংশ আগামিকাল)