ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা (Riots) নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক কালে হরিয়ানার নুহ জেলায় এবং গুরগাঁও-তে তারই প্রকাশ দেখা গিয়েছে। তবে প্রকৃতি, চরিত্র এবং ফলাফল বিচার করলে এবারের দাঙ্গা অনেকটাই আলাদা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
মেওয়াটের নুহ অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে পড়া একটা জেলা। তবে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা সেখানকার দাঙ্গার মুখ্য কারণ নয়। দাঙ্গার কারণ মেরুকরণের রাজনীতির তীব্রতা। দাঙ্গার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা বিচার করলে স্পষ্টতর হচ্ছে, নুহর দাঙ্গায় মুসলমানদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য চোকাতে হচ্ছে।
এর উল্টো দিকে রাখা যাক পল ব্রাসের দাঙ্গার প্রাতিষ্ঠানিকতার তত্ত্ব, Institutionalised riot system। আলিগড় ও মিরাটের দাঙ্গার ভিত্তিতে তিনি এই তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু হরিয়ানার ঘটনায় স্বতঃস্ফূর্ততার চেয়ে হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্যবাদের বিস্তার অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার ঔদাসীন্য আর পদক্ষেপ গ্রহণে অনাগ্রহ বিষয়টিকে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি দান করেছে। হরিয়ানা ও পাঞ্জাব কোর্টের এ-বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, বুলডোজারের ন্যায়কে জাতি নির্মূলকরণের পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা, বুঝিয়ে দিয়েছে, সরকারের আদর্শগত অবস্থান এই দাঙ্গার (Riots) ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আলিগড় ও মিরাটের দাঙ্গা, যার ভিত্তিতে পল ব্রাস তাঁর তত্ত্বটি প্রণয়ন করেন, সেখানে কিন্তু এই উপাদানটি এভাবে ছিল না।
১৯৯২। বাবরি মসজিদ ভাঙল গেরুয়া পক্ষ। কেন্দ্র তখন নরসিংহ রাওয়ের সরকার। চারটি বিজেপি-শাসিত রাজ্য— উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও হিমাচলপ্রদেশে সরকার ফেলে দিয়েছিল কেন্দ্র। তখনও পর্যন্ত ওই রাজ্যগুলিতে দাঙ্গার আঁচ লাগেনি। সেজন্য অনেকেই সরকার ফেলার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেদিন মুখর হয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের জমানায় দাঙ্গার (Riots) আঁচ লাগে না, এমন দাবি সেদিনও শোনা যেত। এই সেদিনকেও যোগী আদিত্যনাথ সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছিলেন, উত্তরপ্রদেশে ২০১৭ থেকে আর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি। এসব দাবির অন্তঃসারশূন্যতা হরিয়ানার জমিতে প্রমাণিত হয়ে গেল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর উপাত্ত জানাচ্ছে, ২০২১-এ ৫,৩০২টি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।
কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বলতে শোনা গিয়েছে, কর্নাটকে কংগ্রেস সরকার করলে সেখানে দাঙ্গা বাধবে। নিহিতার্থ, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে দাঙ্গা হয় না। হরিয়ানা সেই দাবির মূলে কুঠারাঘাত করল।
আরও পড়ুন-বৌবাজারে রাসায়নিক গুদামে আগুন
বিজেপির জোট যখন মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় ছিল তখন সেখানে, ২০২৩-এর এপ্রিল থেকে, কোলাপুর, মুম্বই, শাম্ভজিনগর, জলগাঁও, আকোলা এবং আহমেদনগরে দাঙ্গা হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে মন্দির বা মসজিদ, নিদেনপক্ষে সমাজমাধ্যমে কোনও একটা পোস্ট, দাঙ্গা বাধানোর ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। নুহ-র দাঙ্গাতেও অনেকাংশে এই প্যাটার্নটাই অনুসৃত হয়েছে। পল ব্রাসের তত্ত্বে দাঙ্গার তিনটি পর্যায়ের কথা বলা হয়েছিল। ১. প্রস্তুতি বা মহড়া, ২. বাস্তবায়ক বা কার্যকর করা এবং ৩. ব্যাখ্যা প্রদান। বিজেপি জমানার সব দাঙ্গাতেই কিন্তু এই প্যাটার্ন অনুসরণ করা হয়েছে।
এতদ্সত্ত্বেও, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, নুহ থেকে গুরগাঁওয়ে যে দ্রুততার সঙ্গে দাঙ্গা ছড়িয়েছে, মসজিদে হামলা হয়েছে, হামলাকারীদের হাতে ২৬ বছর বয়সি একজন ইমান খুন হয়েছেন, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। মাস দুয়েক আগে সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলায় জেতার সুবাদে মসজিদটা সম্প্রসারণের সুযোগ এসেছিল। এগুলো যদি খতিয়ে দেখা যায়, তবে স্পষ্ট হয়ে যায়, ২০১৮-এ গুরগাঁওতে নমাজ-বিতর্ক থেকেই এই দাঙ্গার বীজ রোপিত হয়েছিল। মুসলমানরা জুম্মাবারে গুরগাঁওয়ের যেসব জায়গায় নমাজ পড়তেন, হিন্দু দক্ষিণ-পন্থী সংগঠনগুলোর ক্রমাগত জেদাজেদির চাপে, ছটিতে নেমে এসেছে।
এ-কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে জুম্মার নমাজের জেরে গুরগাঁওতে ট্রাফিক জ্যাম দেখা দেয়। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সেই যানজটের সমস্যা স্থায়ী হয় না। সে তো গণেশপুজো বা দুর্গাপুজোর বিসর্জনের সময়েও হয়। কানওয়ার যাত্রার সময়েও হয়। জনজীবনে খানিকটা প্রভাব তো পড়েই। সমস্যা তো সেখানে নয়। মুসলমানদের ভারতীয় সমাজে জায়গাটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই তো দক্ষিণ-পন্থী হিন্দু সংগঠনের এত তৎপরতা। সেটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। জনজীবনে সুবিধা-অসুবিধার ইস্যু স্রেফ ছুতোমাত্র। কথায় বলে, দুষ্টের ছলের অভাব হয় না।
মুসলমানেরাও বা কেমন একগুঁয়ে যে তারাও প্রকাশ্যে রাস…