বাঙালি মানেই বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম পার্বণ হচ্ছে রান্নাপুজো, যাকে আবার ‘ইচ্ছেরান্না’ও বলা হয়ে থাকে। রান্না করতে আবার ইচ্ছেও হয় গৃহিণীদের? হয় বইকি! ভাদ্র-সংক্রান্তিতে মনসা পুজোর দিন পালিত হয় এই রান্নাপুজো। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতেই মা মনসার পুজো দেওয়া হয়। আর সেই দিনই পালন করা হয় ইচ্ছেরান্না তথা রান্নাপুজো নামক উৎসবটি।
এই রান্নাপুজো যেমন বাড়িতে হয় তেমনি অনেক জায়গায় আবার সর্বজনীনও হয়। তবে এই রান্নাপুজোতে ভগবানকে অর্পণ করার পাশাপাশি নিজেদের জন্য এবং আশেপাশের সকলের জন্যই তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবারদাবার। আগের দিন রান্না করে সেই সমস্ত খাবার ভগবানকে অর্পণ করে পরের দিন সেই বাসি খাবার সবাই মিলে গ্রহণ করাই হচ্ছে রান্নাপুজোর অন্যতম অঙ্গ।
আরও পড়ুন-আনন্দের ওনাম
সঠিক তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও পরম্পরা অনুযায়ী মনে করা হয় বাঙালির সব পুজোপার্বণ পুরোহিত তথা সমাজের পুরুষদের দ্বারা প্রবর্তিত হলেও এই রান্নাপুজো নামক পার্বণটি শুরু হয়েছিল মহিলাদের হাত ধরে, আর এই রান্নাপুজোর বিধান মহিলারাই দিয়েছিলেন। আর আমাদের নদীমাতৃক গ্রাম-বাংলার একদম নিজস্ব উৎসব হচ্ছে রান্নাপুজো।
এই রান্নাপুজোকে একেক অঞ্চলে একেক নামে ডাকা হয়। কোথাও বলে ইচ্ছেরান্না, কোথাও আবার ডাকা হয় ধরাটে রান্না বা আঠাশে রান্না। কোথাও কোথাও আবার এই রান্নাপুজোকেই বলে বুড়োরান্না। তবে যেখানে যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই রান্না উৎসবের মূল লক্ষ্য কিন্তু জমিয়ে হরেকরকম রান্না করা। আগের দিন রান্না করে পরের দিন সেই বাসি রান্না খাওয়া।
ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোর আগে দিন পরিবারের সকলের কল্যাণ কামনা করে বাড়ির গৃহিণীরা দেবাদিদেব মহাদেবের মানস পুত্রী দেবী মনসার উদ্দেশ্যে নানান ধরনের পদ রান্না করেন এবং তারপর সেই রান্না-করা পদগুলো দেবী মনসাকে নিবেদন করা হয়। রান্নাপুজোর দিন আবার উনুনের পুজো করা হয়। যে উনুনে আমরা সারা বছর রান্না করি সেই উনুনকেও পুজো করা হয় রান্নাপুজোয়। আবার অন্য মত অনুযায়ী উনুনের গর্ত হল মা মনসার প্রতীক। আর তাই দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পুজো বোঝাতেই এই উনুনপুজো করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-শিখিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক বুলি, পাল্টা জবাব দিল তৃণমূল কংগ্রেস
গ্রামবাংলায় রান্নাপুজো করার কারণ হিসাবে যেটা লোকশ্রুতি আছে সেটি হল, লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মা মনসা। শ্রাবণের ভরা বর্ষা কাটিয়ে যখন ভাদ্র মাসে সূর্যের আলো ঝলমল করে সেই সময় শীতঘুমে যাওয়ার আগে গ্রামাঞ্চলে সাপের আনাগোনা শুরু হয়। আর সেই সময় সাপের কামড়ে অনেকের জীবনহানিও ঘটে। মনে করা হয় মা মনসা যদি সন্তুষ্ট থাকেন তবে সাপ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আর সেই বিশ্বাস থেকেই মা মনসাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আগের দিন রান্না করা ভাত, শাক, ওলের বড়া, বিভিন্ন ধরনের ভাজা আর মাছের বিভিন্ন পদ রান্না করে দেবী মনসাকে নিবেদন করা হয়। দিনের দিন বাড়িতে কোনও রান্না করা হয় না, অর্থাৎ ওইদিন উনুন জ্বালানোর কোনও নিয়ম নেই।
এই রান্নাপুজো বা ইচ্ছেপুজোর জন্য দৈনন্দিন ব্যবহারের উনুন প্রথমে গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। এরপরে সেটাতে আলপনা আঁকা হয় আর এরপর মনসাপাতা দিয়ে সাজিয়ে ঘট প্রতিষ্ঠা করে সেই উনুনকে পুজো করা হয়।
জেলা বা অঞ্চলের তারতম্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নিয়ম দেখা যায় এই রান্না উৎসবে। কিছু কিছু অঞ্চলে দেবী মনসাকে উৎসর্গ করা হয় শাকসবজি মাছ ইত্যাদি। অনেকে আবার মনসার প্রতিমা বানিয়ে পুজো করে থাকেন, অনেকে আবার পঞ্চসর্পের ফণাযুক্ত মা মনসা প্রতিমার পুজো করে থাকেন। অনেকে আবার ফণীমনসা গাছের ডাল রেখেও পুজো করেন। নিয়ম অনুযায়ী পুজোর ভাত মাটির হাঁড়িতে রান্না করা হয়। এরপরে শাপলা ফুল দিয়ে সুন্দর মালা তৈরি করে যে হাঁড়িতে ভাত রান্না হয় সেই হাঁড়ির গলায় সেটা পরানো হয়। এছাড়াও উনুনের গায়ে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। আর এই সমস্ত কিছু করার পরেই হয় রান্নার কাজ। রান্নার মধ্যে পুজোর ভাত আগে করা হয়। আর তারপর একে একে সমস্ত রান্না সম্পূর্ণ করা হয়। পুজোর ভাত হয়ে যাওয়ার পরে সেই ভাতের হাঁড়িতে জল ঢেলে সেটিকে পান্তা করা হয়।
আরও পড়ুন-সুনীলের ঘরের মাঠে আজ কঠিন চ্যালেঞ্জ লাল-হলুদের
রান্নাপুজো উপলক্ষে গ্রাম বাংলার মানুষজন অরন্ধনের আগের দিন বাড়ির সকল সদস্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সারারাত ধরে বিভিন্ন ধরনের রান্নাবান্না করে থাকেন। রান্নাপুজোর নিয়ম অনুযায়ী সারারাত ধরে রান্না হয় ঠিকই কিন্তু রান্না শেষ করতে হয় সূর্য উদয়ের আগেই। রান্নাপুজোয় যে-সমস্ত পদ রান্না করা হয় সেটা পরের দিন সারাদিন ধরে খাওয়া হয়। আর সেই কারণেই সবকিছু রান্নার মধ্যে একটা শুকনো ভাব থাকে যাতে সেটা খারাপ না হয়ে যায়।
অরন্ধনের উপকরণের মধ্যে থাকে পান্তাভাত, মুগের ডাল, চচ্চড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, আলু-কুমড়ো-নারকেল দিয়ে তরকারি, ইলিশ মাছ ভাজা ইত্যাদি। এছাড়াও ভেটকি মাছ, ভাপা ইলিশ, চিংড়ি মাছের বিভিন্ন পদ, চালতার চাটনি থেকে শুরু করে পায়েস-পিঠে প্রায় সবকিছুই থাকে এই রান্নাপুজোতে। সারা বছর ধরে যে-সমস্ত জিনিস বাড়িতে খাওয়া হয়, তার সবকিছুই অল্প অল্প করে তৈরি হয় এই রান্নাপুজোতে। মনে করা হয় এই রান্নাপুজোর খাবার খেলে মা মনসার আশীর্বাদে অনেকের কঠিন রোগ সেরে যায়।
আগে তিথি অনুযায়ী সংক্রান্তির দিন ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন পড়লে তবেই সেই খাবার মুখে তুলতেন গৃহস্থ বাড়ির সকল সদস্য। আর সেই কারণেই এই রান্না উৎসবকে অনেকে বলতেন ‘ভাদ্র মাসে রান্না করে আশ্বিনেতে খাওয়া’। তবে এই পুজো বংশপরম্পরায় চলে আসছে, সেই কারণে সকলের বাড়িতে এই রান্নাপুজোর চল নেই। মূলত ঘটি বাড়িতেই এই রান্নাপুজোর চল দেখতে পাওয়া যায়।
শহরাঞ্চলে এই রান্নাপুজোর সেরকম চল না থাকলেও গ্রামাঞ্চলে আজও এই রান্নাপুজোর গুরুত্ব একটুও কমেনি।