ডেঙ্গির মোকাবিলায়

বর্ষা পড়তে না পড়তে এই বছর ডেঙ্গির চোখরাঙানিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন তা ঊর্ধ্বগামী। ডেঙ্গি বিপজ্জনক কারণ প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টায় এর উপসর্গ একেবারেই বোঝা যায় না। ফলে ধরা পড়ে না। তাই ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ডেঙ্গি হতে পারে প্রাণঘাতীও। কীভাবে বুঝবেন আপনার ডেঙ্গি হয়েছে; কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন— লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বর্ষা মানেই হু-হু করে বাড়ে ডেঙ্গি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ-রাজ্যেও ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। আক্রান্তের নিরিখে শীর্ষে উত্তর ২৪ পরগনা। ডেঙ্গিতে জেরবার হয় শুধু রাজ্য নয় দেশও।
ডেঙ্গি কী
ডেঙ্গি এডিস এজিপটি বা এডিস অ্যালবোপিকটাস নামক একটি মশাদ্বারা বাহিত রোগ। স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গি-আক্রান্তের রক্তপান করলে প্রথমে তার দেহে সংক্রমণ ঘটে এরপর ৮-১০ দিনে সারা শরীরে ছড়ায় এবং লালাগ্রন্থিতে চলে আসে। সেই মশা যখন কাউকে কামড়ায় তখন ভাইরাসটি লালার মাধ্যমে ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করে। পরে শ্বেত রক্তকোষে ঢোকে এবং প্রজনন শুরু করে। প্রবল সংক্রমণে শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। ক্রনিক অসুখ, যেমন ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, অ্যানিমিয়া, টিবি আছে তাঁদের এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গি প্রাণঘাতী হতে পারে।
ডেঙ্গি ফিরে ফিরে আসে
ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটে ধরন— ডি ই এন ভি অর্থাৎ ডেঙ্গি ভাইরাস ওয়ান, ডেঙ্গি ভাইরাস টু, ডেঙ্গি ভাইরাস থ্রি এবং ডেঙ্গি ভাইরাস ফোর। যেটা ভয়ের তা হল সাধারণত একবার কোনও ভাইরাস আক্রান্ত হলে তারপরে মানবদেহে সেটার ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গির ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। কেউ যদি শুধু ডেঙ্গি ভাইরাস ওয়ানে আক্রান্ত হন তাহলে তাঁর শরীর শুধুমাত্র ডেঙ্গি ভাইরাস ওয়ানের কাছ থেকে ইনমিউনিটি পাবে অন্যগুলোর থেকে পাবে না। ফলে ডেঙ্গি একবার হলে আবার হবে না এই ভাবনা ভাবাটা একেবারেই ভুল। বরং একবার ডেঙ্গি যতটা বিপজ্জনক তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হল দ্বিতীয়বার ডেঙ্গি-আক্রান্ত হওয়া। দ্বিতীয় বার ডেঙ্গি হলে প্রাণসংশয় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

কখন কামড়ায় ডেঙ্গির মশা
বর্ষাকালে ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি হয়। কারণ, এই সময়ে এডিস প্রজাতির মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ফলে তারা ডিম পাড়ে অনেক বেশি। এর থেকে সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ে। ডেঙ্গির মশা সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে ভোর ও সন্ধের দিকে কামড়ায়। তাই সংক্রমণের আশঙ্কা দিনের ওই দু’টি সময়ে সবচেয়ে বেশি থাকে। সাধারণত মশা কামড়ানোর পাঁচ থেকে সাতদিন পরে শরীরে লক্ষণ দেখা দেয়।
জ্বরের কোনও পূর্বাভাস থাকে না হঠাৎ অসুস্থতা শুরু হয়। অনেক সময় এমনও হয় ডেঙ্গির উপসর্গই থাকে না। অ্যাসিম্পটম্যাটিক হয় ফলে হঠাৎ প্রকট হলে চিকিৎসার সুযোগ মেলে না। রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
উপসর্গ
জ্বর বা হাইফিভার।
প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, দু-চোখের মাঝে, মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা। এই কারণে এর অন্য নাম হাড়ভাঙা জ্বর!
সারাক্ষণ একটা বমি-বমি ভাব বা বমি হওয়া, গায়ে লালচে রাশ বেরনো।
ছোটদের বমি-বমি ভাবটাই খুব বেশি দেখা যায়। খিদে একেবারে থাকে না।
ডেঙ্গি বুঝবেন কীভাবে
ডেঙ্গিতে প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টা কিন্তু চোখে ধরা পড়ার মতো আলাদা কোনও উপসর্গ আসে না— সাধারণ জ্বরের মতোই মনে হয়। যদি প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টায় সিম্পটম বুঝতে হয় তাহলে তিনটে বিষয় মাথায় রাখতে হবে— গায়ে ব্যথা সঙ্গে খুব বেশি বমি-বমি ভাব, হঠাৎ করে মাথা ঘোরা।
এছাড়া রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে শ্বেতরক্ত কণিকা সংখ্যায় কম থাকা। এই তিনটে বিষয়ের প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টাতেই অন্য জ্বর থেকে ডেঙ্গিকে আলাদা করতে বা ডেঙ্গি হয়েছে এটা খানিকটা বুঝতে সাহায্য করবে।
সিভিয়র ডেঙ্গি
এছাড়া ডেঙ্গি সিভিয়র হলে দাঁতের মাড়ি থেকে এবং মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
গায়ে হাতে চাকা চাকা হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অ্যালার্জি হয়। ধীরে ধীরে রোগী অচেতন হতে শুরু করে।
অতিরিক্ত ঋতুস্রাব। নিঃশ্বাসে কষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, অত্যধিক দুর্বলতা।
রোগীর আচরণগত পরিবর্তন, হঠাৎ করে হাত-পা ফুলে যাওয়া বা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি। রোগী যদি একদম জল না খেতে পারে ইউরিন কমে যায়। এই লক্ষণগুলো দেখলে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করুন।
ডেঙ্গির প্রভাব
ডেঙ্গির প্রভাবে শরীরে আসতে পারে নানান জটিলতা। যেমন হেপাটাইটিস, লিভার ফেলিওর বা প্যানক্রিয়াটাইটিস দেখা দিতে পারে। কিডনি পুরো খারাপও হতে পারে এবং ইউরিনে রক্ত আসতে পারে। হার্টে কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশনও দেখা যেতে পারে। শ্বাসকষ্ট সঙ্গে পালমোনারি হেমারেজ হতে পারে। চোখের মধ্যে ও রেটিনার মধ্যে রক্তক্ষরণ এবং চোখে না দেখতে পাওয়ার মতো অবস্থাও হতে পারে।
পরীক্ষা
ডেঙ্গিতে রক্তপরীক্ষা বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট জরুরি তার সঙ্গে এনএসওয়ান টেস্ট যা প্রথম দিনই জানিয়ে দেবে ডেঙ্গি আছে কী নেই। তবে আইজিএম ডেঙ্গি টেস্ট জ্বর আসার পঞ্চম দিন থেকে করতে হয়। এই ক্ষেত্রে কবে থেকে জ্বর এল সেটা মাথায় রেখে ডাক্তারকে বলতে হবে সেই অনুযায়ী তিনি টেস্ট করতে দেবেন।
চিকিৎসা
ডেঙ্গি জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কিছু না খাওয়া ভাল। কোনও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ এই সময় খাওয়া চলবে না। অ্যান্টিবায়োটিক সবক্ষেত্রে খাওয়া জরুরি নয়।
ডেঙ্গি হেমারেজিক ফিভারের সমস্যা অনেক জটিল। এক্ষেত্রে রক্ত বা স্যালাইন বা প্লেটলেট দেওয়ার দরকার পড়ে।
রোগীর পথ্য
ডেঙ্গি আক্রান্তদের শরীরে জলের ঘাটতি হয় তাই বারবার জল ও জলজাতীয় পানীয় যেমন ফলের রস, পাতলা ঝোল, ডালের জল, স্যুপ, দইয়ের ঘোল, ডাবের জল, ওআরএসের জল, ভাতের ফ্যান, বার্লির জল দেওয়া যেতে পারে।
এই সময়ে রক্তে প্লাজমা ও অণুচক্রিকা কমে যায়। তাই বেশি করে মরসুমি ফল, ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল ও শাক-সবজি খেতে হবে রোগীকে।
রোগী সুস্থ হতে থাকলেও তেল-মশলাদার খাবার খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। এছাড়াও প্রক্রিয়াজাত খাবার, ভাজাভুজি, প্যাকেটজাত খাবার একেবারেই খাওয়া চলবে না।
প্রচুর ফোলেট ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন চিকেন বা মেটে, কিশমিশ, মাখানা, আখরোট, আমন্ড খেতে হবে। প্রোটিন যেমন ছোট মাছের ঝোল, মুরগির স্টু, ডিমসেদ্ধ ইত্যাদি খেতে হবে।

Latest article