মণিপুরে ফের হিংসা, হানাহানি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরও নিয়ন্ত্রণ চাইছেন। এর থেকে দুটো বিষয় বোঝা যাচ্ছে। এক, মণিপুরে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পুলিশ প্রশাসনের পুরো রাশ নেই, অন্তত কিছুদিনের জন্য। দুই, কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করেও রাজ্যে বহিরাগত উপদ্রব ও অভ্যন্তরীণ বিভ্রাট প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ কিংবা অনিচ্ছুক। মণিপুরে সাংবিধানিক ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, সেটা আর অগোপন বিষয় নয়। এক্কেবারে ‘ওপেন সিক্রেট’ । কেন এমন হল বা হচ্ছে?
ভারতীয় সংবিধানের একটা অনন্য বিষয় হল বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা। কেবল জম্মু কাশ্মীর নয়, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, নাগাল্যান্ড, আসাম, অন্ধ্র প্রদেশ, মণিপুর, সিকিম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, প্রভৃতি রাজ্যে বিশেষ ব্যবস্থার কথা সংবিধানে বলা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামো বজায় রাখার জন্য শুধু নয়, ভারতের বৈচিত্র্য ও বিশালত্ব বজায় রাখার জন্যও এই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ৩৭১ চ (চ) ধারার প্রয়োগে সমাজের ভেদাভেদ ও বিদ্বেষ বিষ নাশ করে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। প্রতিদিন ভিটেহারা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই পরিস্থিতির আর অবনতি যাতে না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
আরও পড়ুন-জাগরণে কাটল তাঁর বিভাবরী, তাই আমরা রইলাম নিশ্চিন্তে
১৯৭৫ এ সিকিম যখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত হল, তখনই ৩৭১ চ ধারার মতো বিশেষ ধারার সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি জরুরি হয়ে দাঁড়াল। ৩৭১চ (চ) ধারা সংসদকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করল যাতে সংসদ জনগণের বিভিন্ন অংশের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করতে সমর্থ হয়। ৩৭১চ(ছ) ধারায় সিকিমের রাজ্যপালকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি রাজ্যের জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারেন। ৩৭১ চ ধারার বৃহত্তর উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক স্থায়িত্বের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও ক্ষমতার অংশীদারিত্বর ক্ষেত্রে সম প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিতকরণ। ১৯৫১ র জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটানো হয় যাতে বিধানসভায় আসন বন্টনে সকল জনজাতির প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হয়। ১৯৯৩তে সুপ্রিম কোর্টে আর সি পৌদয়াল-এর কাছে আর্জি জানানো হয় জন প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে আনুপাতিক পরিবর্তন আনার জন্য। যুক্তি ছিল, ৩৭১ চ (চ) এর সুবাদে ভুটিয়া লেপচা জনজাতির প্রতিনিধিত্ব বেড়ে গিয়ে হারে প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে ক্ষুণ্ন করছে। আদালত সেই আর্জি খারিজ করে দেয়। উলটে বলে, ক্ষমতার অনুপাতে এরকম পুনর্বিন্যাস রাজ্যের রাজনৈতিক স্থায়িত্বের জন্য জরুরি।
সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা দৃষ্টান্ত স্বরূপ। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুসারে ওই রাজ্যে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে জেলা ও অঞ্চল পরিষদের ক্ষমতা বাড়িয়ে সামাজিক প্রথা, জমি ও অরণ্যের ব্যবহার, গ্রাম সভা ও নগর পরিষদের গঠন ইত্যাদি বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ পর্যন্ত ত্রিপুরায় ষষ্ঠ তফসিল প্রযুক্ত হয়নি। সংবিধানের ৪৯ তম সংশোধনীর মাধ্যমে এই তফসিলের প্রয়োগ ওই রাজ্যে সুনিশ্চিত করা হয়। তফসিল ভুক্ত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগের বিষয়ে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা পায় জেলা পরিষদ। এটা ছিল কার্যত কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলেন্টিয়ার্স নামক জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ফলে এটা সম্ভাবায়িত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। ওই চুক্তির ফলে বিধানসভার এক তৃতীয়াংশ আসন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়। ১৯৯২ তে ৩৩২ নং ধারার অধীনে ৩খ উপধারা সংবিধানে সংযোজিত হয়।
আরও পড়ুন-আজ অস্কারের বেঞ্চে বসা নিয়ে জট, সমস্যার পাহাড় টপকে জয়ের খোঁজে ইস্টবেঙ্গল
২০০২তে সুব্রত আচার্য মামলায় তফসিলি উপজাতির প্রতিনিধিত্বের হার অস্বাভাবিক, এই প্রশ্ন ওঠে। আদালত গাণিতিকভাবে নিখুঁত প্রতিনিধিত্বের হার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অদলবদলের পক্ষে রায় দেয়।
৩৩২(৩খ) ধারা চুক্তির শর্ত মেনে সরকারে অধিক মাত্রায় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। আদালত জানিয়ে দেয়, ৩৩২ (৩) ও ২৭০ নং ধারা এধরনের অস্থায়ী সংরক্ষণ ব্যবস্থার ফলে লঙ্ঘিত হচ্ছে না। এইভাবে সংবিধানে উল্লিখিত নয় অথচ সংবিধান সম্মত ক্ষমতা বণ্টন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ত্রিপুরায় শান্তি পুরুদ্ধার সম্ভব হয়।
ত্রিপুরার মতো মণিপুরে ষষ্ঠ তফসিল প্রয়োগের সুবিধা নেই। মনিপুর শাসিত হয় ৩৭১ গ ধারা অনুসারে, তাতে স্থানীয়দের নিয়ে পার্বত্য অঞ্চল কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। স্মর্তব্য, এলাকার প্রশাসনিক বিষয়ে পার্বত্য কমিটির অনুমোদন কিংবা সহমত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। সাম্প্রতিক কালে শীর্ষ আদালত সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে অসমে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে একাধিক তারিখকে গুরুত্ব দিয়েছে। এটাও এই ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক হতে পারে।
ষষ্ঠ তফসিলে যেমন জেলা পরিষদ তৈরির কথা বলা হয়েছে, মণিপুরে তেমনটা নয়। মণিপুর পার্বত্য এলাকা স্বয়ংশাসিত জেলা পরিষদ আইন ২০০০ মোতাবেক মণিপুরে জেলা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা আছে। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও ত্রিপুরার মতো মণিপুরে তফসিলি উপজাতিদের ভিটো দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
এমতাবস্থায়, ক্ষমতা ও সম্পদ বন্টন নিয়ে মণিপুরের বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে টানাপোড়েন, উত্তেজনা, আশঙ্কার আবহ তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকেই ভাবছে, অন্য কোনোও পক্ষ বুঝি বেশি সুবিধা, বেশি ক্ষমতা পাচ্ছে।
এই রকম অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারে কেবল সংবিধান। সুপ্রিম কোর্টে আর সি পৌদয়াল-এর এজলাসে যে কথাগুলো একদা শ্রুত হয়েছিল, সেগুলো এখন বিশেষভাবে স্মর্তব্য :
“বহুত্ববাদী সমাজ ইতিহাসের চলনের অপরিবর্তনীয় ফল। এই ফল মুছে ফেলা যায় না। জনগণের রাজনৈতিক মনস্কতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে, প্রয়োজনীয় সংশোধন মেনে নেবে এবং সমস্যার সমাধান খুঁজবে, এমনটাই হওয়া উচিত।”
এই রকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এটুকুই শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, শান্তির পথ দেখাতে পারে একমাত্র সংবিধান। তাছাড়া সমস্যা সমাধানের অন্য যেকোনও রকম চেষ্টা মরিচিকামাত্র।