স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন
কয়েক বছর আগে সারা বিশ্বে থাবা বসিয়েছিল কোভিড ১৯ বা করোনা। ফলে ছন্দপতন ঘটেছিল মানুষের স্বাভাবিক জীবনে। জনসাধারণ অতিমাত্রায় পরিচিত হয়েছিল আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলোর সঙ্গে। মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছিল। সতকর্তা অবলম্বন করা সত্ত্বেও প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের। করোনার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল আমাদের দেশেও। সেইসময় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু খ্যাতনামা মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। অনেককেই আমরা হারিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকবার থাবা বসিয়েছে কোভিড ১৯। তবে ততদিনে অনেকটাই দূর হয়ে গেছে তার শক্তি। বহুজনের অজানা, বিপজ্জনক কোভিড ১৯ জুনোটিক রোগের মধ্যে পড়ে।
ঝুঁকি রয়েছে মৃত্যুর
প্রশ্ন হল, জুনোসিস কী? জুনোসিস একটি সংক্রামক রোগ, যা মেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে দ্রুত সংক্রামিত হয়। জুনোটিক রোগজীবাণু ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী হতে পারে। আবার গৃহপালিত, কৃষি বা বন্য প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেও হতে পারে। খাদ্য ও জলের মাধ্যমেও অনেক সময় মানুষের শরীরে প্রবেশ করে জুনোসিস। বিপদ বাড়ায়। কোভিড-১৯ ছাড়াও জুনোটিক রোগের মধ্যে রয়েছে আরও কয়েকটি রোগ। যেমন এভিয়ান ফ্লু, সালমোনেসিস এবং ইবলা হওয়া। এছাড়াও প্রতি বছর মশা, পাখি ও পশুপাখির কারণে জলাতঙ্ক, নিপা ভাইরাস, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গির মতো জুনোসিস রোগ সংক্রমণের কারণে হাজার হাজার মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড ১৯-এর পাশাপাশি এই ধরনের জুনোসিস রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে এই ধরনের রোগ, তার লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও তথ্য থাকা খুবই জরুরি। ক্রমবর্ধমান নগরের বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তন জুনোটিক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনুমান করা হয় যে, ষাট শতাংশ পরিচিত সংক্রামক রোগ এবং পঁচাত্তর শতাংশ পর্যন্ত নতুন বা উদীয়মান সংক্রামক রোগ জুনোটিকভাবে বিকাশ লাভ করে।
আরও পড়ুন-নাবালিকাকে উদ্ধার করল পুলিশ
মৃদু থেকে মারাত্মক
অনেক ধরনের জুনোসিস রোগ রয়েছে। যা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং পরজীবীর কারণে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাল জুনোসিসের মধ্যে রয়েছে করোনা ভাইরাস, জলাতঙ্ক এবং এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা।
করোনা ভাইরাস বলতে এআরএনএ ভাইরাসের একটি শ্রেণিকে বোঝায়, যেগুলি স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের আক্রান্ত করে। এগুলো মানুষ ও পাখির শরীরে শ্বাসনালির সংক্রমণ ঘটায়। এই ভাইরাসের সংক্রমণ মৃদু থেকে মারাত্মক হতে পারে। মৃদু সংক্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণ সর্দিকাশি হতে পারে, যা অন্য ভাইরাস, যেমন রাইনোভাইরাসের কারণেও হতে পারে। তবে কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে মারাত্মক সংক্রমণ, যেমন সার্স, মার্স এবং কোভিড-১৯ হতে পারে। অন্যান্য প্রজাতিতে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন মুরগির মধ্যে এটা ঊর্ধ্ব শ্বাসনালি সংক্রমণ ঘটায়, আবার গরু ও শুয়োরে এটা ডায়রিয়া সৃষ্টি করে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা
জলাতঙ্ক একটি বিপজ্জনক ভাইরাস, যা মস্তিষ্কের প্রদাহ সৃষ্টি করে। এটা প্রাণীদের কামড় এবং আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। টিকা এবং অন্যান্য ওষুধ সংক্রমণের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে সাহায্য করে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা ছাড়া, জলাতঙ্ক ভাইরাস হতে পারে মারাত্মক। তবে, জলাতঙ্কের সংস্পর্শে আসা কোনও ব্যক্তি যদি তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন, তাহলে এটা নিরাময়যোগ্য।
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা হল একটি ভাইরাল সংক্রমণ, যা গৃহপালিত হাঁস-মুরগি এবং অন্যান্য পাখির বিস্তৃত পরিসরে পাওয়া যায়, যার কিছু প্রজাতি বিক্ষিপ্তভাবে বন্য এবং গৃহপালিত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যপ্রাণী এবং তীরবর্তী পাখিরা প্রায়শই সাবক্লিনিক্যালি ভাইরাসের বাহক। মুরগিতে, কম-রোগনিটিভিটি স্ট্রেন সাবক্লিনিক্যাল সংক্রমণের কারণ হতে পারে। তবে, কিছু প্রজাতি সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণ বা ডিম উৎপাদন হ্রাস করে। উচ্চ-রোগনিটিভিটি স্ট্রেন ব্যাপক অঙ্গ ব্যর্থতা এবং আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হতে পারে, প্রায়শই উচ্চ মৃত্যুর হার-সহ। রোগ নির্ণয় ভাইরাল জিনোম বা নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ বা ভাইরাস বিচ্ছিন্নতার উপর ভিত্তি করে করা হয়। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালগুলি কম-রোগনিটিভিটি স্ট্রেন দ্বারা প্রভাবিত পালগুলিতে গৌণ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ অনুমোদিত বা সুপারিশ করা হয় না। জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রতিরোধ সর্বোত্তমভাবে সম্পন্ন করা হয়। অ্যান্টিজেনিক ধরনের সঙ্গে মিলিত টিকা সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে পারে বাড়াতে। ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারে।
মানুষ ও পশুর অন্ত্রে
ব্যাকটেরিয়াল জুনোসিসের মধ্যে রয়েছে সালমোনেল্লা, লাইম ডিজিজ এবং অ্যানথ্রাক্স। সালমোনেল্লা বা টাইফয়েড জ্বর হল অন্ত্রের নালির ব্যাকটেরিয়াজাত একটি রোগ। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষ ও পশুর অন্ত্রের মধ্যে পাওয়া যায়। মলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে। উপসর্গ হল পেট খারাপ, পেটে ব্যথা, জ্বর, বমি, মাথা ঘোরা ইত্যাদি।
লাইম ডিজিজ লাইম বোরেলিওসিস নামেও পরিচিত। এটা একটা টিক-বাহিত রোগ, যা বোরেলিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির দ্বারা সৃষ্ট। বসন্ত এবং গ্রীষ্মের শুরুতে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
ছত্রাকের জুনোসিসের মধ্যে রয়েছে হিস্টোপ্লাজমোসিস এবং ক্রিপ্টোকোকাস। পরজীবী জুনোসিসের মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, টক্সোপ্লাজমোসিস এবং স্কিস্টোসোমিয়াসিস।
ব্রুসেলোসিস হল ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ানো একটি রোগ, যা দূষিত দুধ, মাংস বা পশুজাত দ্রব্য খাওয়ার কারণে হয়।
এই রোগটি পশুদের, বিশেষ করে গরু এবং ভেড়ার দ্বারা গর্ভপাত এবং প্রজনন সমস্যা সৃষ্টি করে এবং মানুষের জ্বর, ক্লান্তি এবং পেশিতে ব্যথা হতে পারে।
সালমোনেলোসিস হল সালমোনেল্লা ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট একটি সাধারণ খাদ্যবাহিত রোগ। এটা দূষিত খাবার বা জলের মাধ্যমে ছড়ায়। এই রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, জ্বর এবং পেটে ব্যথা। এটা প্রতিরোধ করার জন্য, স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েক বছর আগে বার্ড ফ্লু থাবা বসিয়েছিল দেশ জুড়ে। কমে গিয়েছিল মুরগির মাংস বিক্রি। বার্ড ফ্লু একটি ভাইরাল রোগ, যা পাখি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটি আমাদের দেশে মাঝে মাঝেই দেখা দেয়৷ বার্ড ফ্লুর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট।
আরও পড়ুন-নয়া নিয়মের আড়ালে রেলের টিকিটে চলছে অভিনব দুর্নীতি
জোরকদমে থাবা বসিয়েছে
সোয়াইন ফ্লু-ও একটা সময় জোরকদমে থাবা বসিয়েছে। সোয়াইন ফ্লু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা শুয়োরের থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। এর লক্ষণগুলি সাধারণ ফ্লুর মতো। যার মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা এবং শারীরিক ব্যথা। নিপা ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ানো একটি মারাত্মক রোগ। যা ভারতের কিছু অংশে অতিমারি আকার ধারণ করেছে। এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, শ্বাস নিতে অসুবিধা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিস।
রেবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে
আগেই বলা হয়েছে, কোভিড ১৯-এর পাশাপাশি কখনও কখনও অন্যান্য জুনোসিস রোগের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। কোভিড অতিমারি চাক্ষুষ করায় জুনোসিস রোগগুলো কতটা মারাত্মক হতে পারে। সেটা আমরা ভালই বুঝেছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ধরনের জুনোসিস রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। এখনও মানুষের মধ্যে সচেতনতার বড় অভাব। এই অবস্থায় এই ধরনের রোগ, তার লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা ও তথ্য থাকা খুবই জরুরি। প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য, একে অপরের উপর তাদের প্রভাব জানার জন্য প্রাণীদের দ্বারা মানুষের মধ্যে যে রোগ ও সংক্রমণ হতে পারে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন৷ রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করার বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতি বছর ৬ জুলাই জুনোসিস দিবস পালিত হয়। কারণ, প্রখ্যাত ফরাসি রসায়নবিদ এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট লুই পাস্তুর ১৮৮৫ সালের এই দিনেই রেবিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রথম টিকা তৈরি করেন। জুনোটিক রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রক হিসাবে প্রতি বছর ৬ জুলাই তাঁর কৃতিত্বের প্রতি সম্মান জানাতে বিশ্ব জুনোসিস দিবস উদযাপিত হয়। আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন-গেরুয়া-অসমে চিকিৎসকের ‘কীর্তি’, নিছক সংক্রমণে বাদ দেওয়া হল যুবকের গোপনাঙ্গ!
রক্ষা করা সম্ভব
জুনোসিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে প্রধান হল নিজের এবং পশুদের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা৷ পশুদের স্বাস্থ্যের নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং টিকা দেওয়া। এছাড়া এইসব রোগ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষা বিস্তার করাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ অনেক সময় এই ধরনের রোগের লক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষের মধ্যে সমস্যা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরজন্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে, সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে এবং গ্রাম, ছোট শহর এবং মেট্রো শহরে কমিউনিটি পর্যায়ে কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। আয়োজন করা যেতে পারে আলোচনাসভা। তবেই নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হবে জুনোসিস সংক্রামক রোগগুলো থেকে।