খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ

রঙের রংবাজিতে নয়, বিভেদকামী অপশক্তিকে চুপসে দিতে হবে সম্প্রীতির বিবিধ রঙে। এটাই এবারের হোলির শপথ। লিখছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

দোলের ভরপুর আবহে প্রত্যক্ষভাবে খেলুন আর না খেলুন, পরোক্ষে রঙের পরশে বর্ণময় হয় প্রত্যেকেই। শরীরে রং নাই বা লাগুক, আত্মিক ছোঁয়ায় রঙিন হতেই হয়। রঙের মাহাত্ম্য বোধহয় একেই বলে। রং যেন ময়ূরের মতো পেখম মেলে। কালীপুজোর আতশবাজির মতো ফুটতে থাকে মন মাঝারে।
দেশের গৌরবময় ত্রিবর্ণ পতাকাও তো রঙের ত্র্যহস্পর্শে রাঙায়িত। ব্রিটিশ বিরোধিতার যে ত্রয়ী-রঙে স্বাধীনতাকামী দেশবাসী আন্দোলিত হয়েছে।
আমরা শুধুমাত্র রঙের বাহ্যিকতাতেই প্রবাহিত হই না। বিমূর্ত রূপেও আমাদের মর্মে লাগে রং। কর্মেও সেই রংবাহার উপচে পড়ে।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন এ-রাজ্যে তাতেও নানা রঙের ছটা। মুখ্যমন্ত্রীর সাহিত্য-সৃষ্টি, তাঁর কবিতার পরতে পরতে রঙের ঘনঘটা।
এতো গেল রঙের সৃষ্টিশীলতার কথা। রঙের মাতব্বরিতেও কেউ কেউ নিজেদের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের জানান দেন৷ আমজনতার ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেওয়ার নামে প্রভূত্বের বিস্তার।
অধুনা বিশ্বগুরু বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে সদা তৎপর যিনি, তিনি ও তাঁর পার্ষদরা তো রং নিয়ে রীতিমতো রংবাজি করেন। রঙাধিপত্যে মুছে দিতে চান অন্যের ভাললাগা, যাপনের রংকে।
বলাবাহুল্য, সেই রং মোটেই মনে দোলা দেয় না, রাঙায়িত করে না। একরঙা, একচোখা বৈষম্যে ধর্ম-জাতি তথা মানব সত্তাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানো হয়। ভারতের শ্বাশত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সঙ্কটাপন্ন হয়। রঙে আমরা-তোমরা’র এই বিভাজনে শরণাপন্ন হতেই হয় প্রাণের ঠাকুরের লেখায়! সেই কবেই বিশ্বকবি লিখে গিয়েছেন—
‘নানা ভাষা। নানা মত। নানা পরিধান!
বিবিধের মাঝে দেখ তবে মিলন মহান!’
কবিগুরুর কথাতেই ঠিকরে বেরচ্ছে সাতরঙা রামধনু।
কথা হল রঙের মাধুর্যকে কী এভাবে দাঁড়িপাল্লায় তোলা যায়? রং তো এক-একটা প্রতীক। যেমন লাল রং বিপ্লবের, শৌর্যের। নীল রং প্রতিনিধিত্ব করে আভিজাত্যের, এলিট বা ব্লু ব্লাডের। হলুদের মধ্যে পাণ্ডিত্য, প্রজ্ঞা, বনস্পতি বিরাজমান। সবুজ তো চিরযৌবনের গান গায়, যেন বসন্তের কোকিল। সাদা পবিত্রতার পথিক। আরও কত কী!
রাঙিয়ে দিয়ে যাক রে মন! এই আশা-আকাঙ্ক্ষাতেই ফি বছর দোলপূর্ণিমায় রঙের মাঝারে হারিয়ে যেতে চাই আমরা। সাধ্যমতো আয়োজনে ত্রুটি থাকে না৷ রঙের পাবনকে ঘিরে আরও কত সাতকাহন। নাচ, গান, কবিতা, গল্পে মাতোয়ারা হওয়া। সঙ্গে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়া। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম সেরা উৎসব যে দোলযাত্রা। দোলের নামচা তো আর নামতা পড়া নয়, যে সবটাই অঙ্ক কষে হবে। আঁককষা জীবনের ঊর্ধ্বে উঠে বাঁধনছাড়া হওয়াতে বেজায় মজা।
রক্তপলাশের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে, কোন বাঙালি দুকলি গেয়ে ওঠে না, ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’
‘খেলব হোলি রং দেব না তাই কখনও হয়।’ জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা একান্ত আপনের এই গানের মধ্যেও সেই সারসংক্ষেপ বিদ্যমান। অর্থাৎ জলে নামলে বেণী তো ভেজাতেই হবে। বুদবুদের মতো ভাসাভাসা নয়, এ রঙে রাঙা হবে হৃদয়। তবেই না দোলের সার্থকতা।
এই যে আমাদের বিভিন্ন উপাচারের মধ্যে হলুদ ব্যবহৃত হয়, সরস্বতী পুজোর হলুদ ছোঁয়ানো থেকে গায়ে হলুদ সবেতেই তো রঙের কীর্তন। মেহেন্দির মেহেফিল জমজমাট হওয়ার নেপথ্যেও সেই একই রঙ্গোলি!
এবারের দোল উৎসবের আনন্দ আরও বেড়ে গিয়েছে পবিত্র রমজান মাস পালনের মধ্যে দিয়ে।
একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান! মহান দুই উৎসব ঘিরে উভয় সম্প্রদায়ই ভারি উৎসাহিত, আবেগতাড়িত৷ পরস্পরের প্রতি খেয়াল রাখাও চলছে সমানতালে। দুর্গাপুজোয় যেমন থিকথিক করা জনতার ভিড়ে বহু মুসলিম ভাই-বোন জোরকদমে পা মেলান, তেমনই সারাদিনের উপবাস ভেঙে পবিত্র ইফতারের সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি উৎসবের মেজাজটাকেই আলাদা রূপ প্রদান করে।
ইফতার তো ট্রেলার মাত্র। আনন্দ প্লাবনে সব সম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাতবে খুশির ইদে। এভাবেই বাংলা ও বাঙালি পুজো আর ইদে সৌভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যুগ যুগ ধরে এই সংস্কৃতি চলছে।
তবে নিজের আনন্দ যেন অপরের নিরানন্দের কারণ না হয়ে ওঠে সেদিকেও বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। রবীন্দ্র-নজরুলের দেশের মূল সম্পদ কিন্তু পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব এবং সহিষ্ণুতা।
দীর্ঘ উপবাসকালে ধর্মপ্রাণ মানুষগুলির বিরক্তির উদ্রেক যেন না হয় তা দেখাও রঙের উৎসবের ভারসাম্য রক্ষার মধ্যে পড়ে।
যদিও দায়িত্ব নিয়ে বাঙালি বরাবর পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নেয়। একথা বলার অবতারণা এবারেও করতে হত না। কিন্তু দেদার টাকা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দিল্লির শাসকদের কালা নজর পড়েছে আমাদের শান্তির রাজ্যে। বাঙালির অটুট ঐক্য ভাঙতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না এই অশুভ শক্তি। গোবলয়ের গোয়েবলসরা যেনতেন মূল্যে বাংলার সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। গোবলয় থেকে ভুয়ো ভোটার আমদানির চেষ্টা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞ চোখে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। এখন প্ল্যান বি, প্ল্যান সি ইত্যাদির পথে হাঁটছে দিল্লির সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ শক্তি। দীর্ঘদিন হাতে হাত ধরে চলা সম্প্রদায়কে খেপিয়ে তোলা যার অন্যতম ছলাকলার অংশ। সে জায়গা থেকে বাঁচতে দোল-সহ প্রতিটা উৎসবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনী গড়ে সজাগ থাকতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিষভরা কালনাগিনী যাতে কোনও ফাঁকফোকর না বের করতে পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। বস্তুত, বিজেপি তথা উগ্র ধর্মান্ধদের কুচকুচে কালো রঙের মোকাবিলায় মেলে ধরতে হবে বাংলার অহংকার, আমাদের গর্বের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ রঙের বর্ণময়তাকে।
আপাতভাবে আলাদা হলে কী হবে। শত্রুর মোকাবিলায় নিমেষে তা মিলেমিশে একাকার হবে।

আরও পড়ুন: সম্মতি দিল রাজ্য, ৪ ইএসআই হাসপাতাল নিয়ে শুরু তৎপরতা

Latest article