প্রতিবেদন: ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত মায়ানমার আর ব্যাংককে এখন কোথাও শ্মশানের নিস্তব্ধতা, কোথাও আবার বুকফাটা হাহাকার। শুধুমাত্র মায়ানমারেই মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে গিয়েছে ২৫০০। জখম অন্তত ৫০০০। কিন্তু মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে আরও অনেক অনেক বেশি। উদ্ধারের কাজ চলছে জোরকদমে। তাই সংখ্যাটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা ১০০০০ ছাড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। শুরু হয়েছে অপারেশন ব্রহ্মা। ত্রাণ এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মায়ানমারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ২টি জাহাজ। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ৮০ জনের একটি উদ্ধারকারী দলও পাঠানো হয়েছে। তবে মৃত্যুর অন্ধকারের মাঝেই ফুটে উঠেছে নতুন জীবনের আলো। ব্যাংককে পুলিশ হাসপাতালের সামনে রাস্তাতেই স্ট্রেচারে শুয়ে সন্তানের জন্ম দিলেন এক তরুণী। কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গিয়েছে প্রবল ভূমিকম্প। হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল বেশ কয়েকজন আসন্নপ্রসবাকে। কিন্তু প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ায় ওই তরুণীকে রাস্তাতেই ঘিরে ধরে আড়াল করেন নার্স এবং চিকিৎসকরা। সেখানেই মা হন তিনি। শুক্রবারের জোড়া ভূমিকম্পের জেরে মায়ানমার জুড়ে শুধুই ধ্বংসের ছবি। সাগাইং, মান্দালয়, ম্যাগওয়ে, বাগো, ইস্টার শান রাজ্য এবং রাজধানী নেপিডোতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। একাধিক শহর তছনছ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত থাইল্যান্ডও। দুই দেশ মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কত দাঁড়িয়েছে এবং নিখোঁজের সংখ্যাই বা কত তা সঠিকভাবে বলতে পারছে না কেউই। মায়ানমারের মান্দালয়ে ভেঙেপড়া একটি বহুতলের নিচে এখনও ৯০ জন আটকে রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-প্রবন্ধে রাজনীতি এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য
রিখটার স্কেলের ৭.৭ এবং ৭.১ তীব্রতা নিয়ে দু’-দু’বার কেঁপে ওঠা মায়ানমারের চারিদিকে শুধুই লাশের স্তূপ। শনিবারেও চলছে উদ্ধারকাজ। একাধিক বিল্ডিংয়ের নীচে থেকে নিথর দেহ উদ্ধার হতে থাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ধ্বংসস্তূপ থেকে চাপা পড়া মানুষকে উদ্ধার করার মতো পরিকাঠামোর খুবই অভাব রয়েছে সে দেশে। ভারত সব রকমের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। ধূলিসাৎ একাধিক বৌদ্ধ স্থাপত্য। একাধিক প্যাগোডা, মনাস্ট্রি ভেঙে পড়ার ছবি দেখে শিউরে উঠছেন সকলেই। জায়গায় জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সাহায্য পৌঁছে দিতে সমস্যায় পড়ছে রেড ক্রস। ভারত থেকে মায়ানমারে এখনও পর্যন্ত ৪০ টন ত্রাণ পাঠানো হয়েছে বলে খবর মিলেছে।
তদন্ত কমিটি ব্যাংককে
প্রকৃতির রুদ্ররোষে একের পর এক বাড়ি ভেঙে পড়েছে ব্যাংককেও। একটি বহুতলের ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৬টি দেহ। আরও ৫০ জন আটকে আছেন বলে আশঙ্কা। তাঁদের উদ্ধারের জন্য অন্যান্য দেশের সাহায্য প্রার্থনা করেছে থাইল্যান্ড প্রশাসন। কিন্তু একইসঙ্গে ভেঙে পড়া বাড়িগুলোর ভিত এবং কাঠামো যথাযথ ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের তদন্ত কমিটিও।
ব্যাংককে ভূমিকম্পের সময় যখন ৩০ তলা একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে তখন সবেমাত্র জল খেতে বাইরে বেরিয়েছিলেন খিন আং নামে এক শ্রমিক। বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে উঠছিলেন তিনি। বললেন, ভাইটা ভেতরে কাজ করছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। ধুলোয় ঢেকে গেল চারদিক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখের সামনে ভেঙে পড়ল ৩০ তলা বাড়ি। জানি না ভাই কোথায়।
আরও পড়ুন-বিশ্ব থিয়েটারের কথা
প্রতিবেশীর পাশে ভারত
ভারতীয় বিমানবাহিনীর পণ্যবাহী বিমান সি-১৩০ জে ইতিমধ্যেই ইয়াঙ্গন পৌঁছেছে। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন ব্রহ্মা। শুকনো খাবার, ওষুধ, তাঁবু, কম্বল, স্লিপিং ব্যাগ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, জেনারেটর-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ইতিমধ্যেই মায়ানমারে পাঠানো হয়েছে। ত্রাণ নিয়ে সমুদ্রে ভেসেছে ভারতীয় নৌবাহিনীর দু’টি জাহাজও। সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে আমেরিকা, রাশিয়াও।
ব্যাংককে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরাও বাংলায় ফিরেছেন। মৃত্যুপুরী দর্শন করে কলকাতায় ফিরেছেন থাইল্যান্ড ভ্রমণে যাওয়া রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অনুভূতি, ব্যাংককের বর্তমান অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও সেই মুহূর্তে সকলের মধ্যে মৃত্যুভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। চোখের সামনে সমস্ত মল, অফিস থেকে লোকজন ছুটে বেরিয়ে আসছিলেন। দ্রুত মেট্রোরেল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। আর এক পর্যটকের কথায়, কয়েক মুহূর্তের জন্য আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেছিল গোটা শহর।