আমরা যারা হরর মুভির একনিষ্ঠ ভক্ত বা যারা ভূতের সিনেমা দেখতে ভালবাসি, তারা প্রত্যেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি কোনও মানুষ কোনও আত্মা-দ্বারা পসেসড হয়েছে বা বলা ভাল মানুষটিকে ভূতে ধরেছে। আর এই ভূতে-ধরার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা দেখি যে ওই মানুষটি বিভিন্ন গলায় কথা বলছে তার গলার স্বর, মুখভঙ্গি, চরিত্র— সবকিছুই কেমন যেন পালটে গেছে। তবে কি সত্যিই তেনারা আছেন? প্রশ্ন বিবাদ সাপেক্ষ, উত্তর একটাই— না নেই। আসলে বিজ্ঞামনস্ক মানুষের ভূতপ্রীতি থাকলেও তার অস্তিত্ব স্বীকৃতি ঠিক সাজে না। ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও এই অদ্ভুত চারিত্রিক রদবদলের পক্ষে বিজ্ঞান কিন্তু কয়েকটি যুক্তি সাজিয়েছে আর আজ তারই বিশ্লেষণের পালা। দেখাই যাক না আমাদের অতি-কৌতূহলী মস্তিষ্ককে অতিপ্রাকৃত কিছু অবাস্তব কল্পনা থেকে বের করে আনা যায় কিনা?
আরও পড়ুন-মানিকতলা উপনির্বাচন: শেষ প্রচারে চমক, সুপ্তির পাশে ক্রীড়াবিদরা
রোগটির নাম হল ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার’ বা ‘মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ অর্থাৎ একই ব্যক্তির একাধিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটা। যেকোনও মানুষের সাধারণত তিনটি চারিত্রিক দিক থাকে। এক, সেই মানুষটি আসলে যে চরিত্রের সেটি, দুই, সেই মানুষটি নিজেকে যেটা ভাবে সেটি যাকে বলে সেলফ ইমেজ, আর তিন, সেই মানুষটি যেটি হতে চায় সেটি যাকে বলে আইডিয়াল সেলফ অর্থাৎ তার কাছে যেটা আদর্শ বলে মনে হয় সেটি। কোনও মানুষের এইসব চরিত্র তার আশেপাশের পরিবেশ ও তার বেড়ে ওঠার ধরনের ওপর নির্ভর করে, আর তাই প্রত্যেকের কাছেই এটি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে কোনও মানুষের যদি দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরিত্রের মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকে তাহলে তার আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে, যাকে বলা হয় লো সেলফ এস্টিম। আবার অন্যদিকে, যদি এই পার্থক্য খুব কম হয় তাহলে তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি হয় আর তার সেলফ এস্টিম থাকে ‘হাই’। বিজ্ঞানী কার্ল রজার্স-এর মতে এই সেলফ ইমেজ, আইডিয়াল সেলফ আর সেলফ এস্টিম— এই তিনটি নিয়েই গড়ে ওঠে আমাদের ‘সেলফ’ বা ‘আমি’-র ধারণা। আর এই আমি-র মধ্যে রয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক ও আমাদের চরিত্র— এই দুইয়ের মেলবন্ধন। ধরা যাক একটা মানুষ বাইরে থেকে খুব গম্ভীর কিন্তু ভেতর থেকে সে খুবই হাসিখুশি আবার এমন হতেই পারে যে একটা মানুষ যে কিনা সবাইকে খুব শ্রদ্ধা করে ভক্তি করে সে হয়তো মনে মনে একেবারেই তা পছন্দ করে না অর্থাৎ বোঝা গেল একই মানুষ বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং সে ব্যক্তিত্বগুলি ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ পেতে থাকে। আমাদের সকলের মধ্যেই এই বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সমাবেশ দেখা যায় কিন্তু গন্ডগোলটা সেখানেই পাকে যখন এই সমস্ত ব্যক্তিত্বগুলির সমন্বয় বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত হয়ে এক একটি চরিত্রের রূপ নিতে থাকে এবং তখনই জন্ম নেয় ‘অল্টার’। এই অল্টার কিন্তু সে মানুষটিরই এক একটি ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র যাদের নিজেদের মধ্যে কোনও সংযোগ থাকে না। শুনলে আশ্চর্য লাগবে একটা মানুষের দুই থেকে একশোটা পর্যন্ত অল্টার থাকতে পারে। কিম নোবেল নামক একজন মহিলার এরকম একশোটা অল্টার ছিল। খুব আশ্চর্যজনকভাবে এই সব অল্টারের ছিল আলাদা নাম, আলাদা বয়স এবং আলাদা পরিচিতি, আলাদা মেজাজ, আরও অবাক করা ব্যাপার হল যখন এই কিম একটি চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে সুইচ করতেন তখন তার আগের চরিত্রের কোনও স্মৃতি থাকত না। প্রত্যেকটি চরিত্র তার মস্তিষ্কে নতুন নতুন স্মৃতির জন্ম দিলেও তার সমন্বয় ঘটত না আর এইটাই হল ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার অর্থাৎ সোজা ভাষায় মানুষের বিভিন্ন চরিত্রগুলি যখন নিজেদের মধ্যে তালমিল হারিয়ে ফেলে তখন তারা নিজেরাই একটা স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে ওঠে এবং তারা ভুলে যায় যে তারা একই ব্যক্তি বা একই মানুষ। যদিও চরিত্রের এই রদবদলে একটি এমন চরিত্র থাকে যাকে ‘হোস্ট আইডেন্টিটি’ বা ‘প্রাইমারি আইডেন্টিটি’ যেখানে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বেশি সময় সেই পরিচয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও এরকম চারিত্রিক রদবদল হামেশাই দেখা যায়। যেমন, কোনও মানুষ বন্ধুদের সাথে যেভাবে মেশে বা তখন তার যে চরিত্রটি প্রকাশ প্রায়, সেই চরিত্রটি যখন সে মা-বাবার সাথে থাকে তখন প্রকাশ পায় না আবার কাজের জায়গায় তার অন্য চরিত্র ফুটে ওঠে। তবে এ-ধরনের পরিবর্তনকে আমরা ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার বলি না কারণ এই চরিত্রগুলি সবটাই থাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে, তাদের মধ্যে থাকে সমতা কিন্তু সেটা একবার হারালেই তখন এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই হয়ে যায় ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার-এর শিকার হয় তারা তাদের অজান্তেই এই রোগের কবলে পড়ে তাই তারা নিজেরাও জানে না তারা কখন কীভাবে তাদের চরিত্রগুলি বদল করছে কেবল হঠাৎ করে তাদের স্মৃতি হারাতে থাকে। আমি আগেই এখানে কিম নোবেলের কথা বলেছি তাকে একবার তার নাম জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলেছিল সে জুডি তার বয়স পনেরো এদিকে তার নাম ছিল কিম এবং তার বয়স ছিল প্রায় ষাট বছর। অর্থাৎ তখন সে অন্য একটি চরিত্রের বশবর্তী ছিল। খাবার খাওয়া, স্নান বিভিন্ন সময়ে তার চরিত্রের এরকম রদবদল দেখা যেত।
আরও পড়ুন-উত্তরে বন্যার আশঙ্কা, দায়ী কেন্দ্রই! ধস নিয়ে কী জানালেন মুখ্যমন্ত্রী
বিজ্ঞান বলে আমরা যাকে ভূতে ধরা বলি আসলে সেটি ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার। যার জ্বলন্ত উদাহরণ হল অ্যানিলিস। আমরা আমাদের গোটা জীবনে যা প্রত্যক্ষ করি তাই আমদের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়। শিশুকালের কোনও যন্ত্রণা বা ক্ষত ভোলাতে আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষ এমনভাবেই ভাগ হয়ে যায় যে, আমাদের অজান্তেই আমাদের মধ্যে বেড়ে ওঠা চরিত্রগুলি আমাদের আসল ব্যক্তিত্ব তথা পরিচয়কেই গ্রাস করে ফেলে আর তাই— তাই-ই আমরা ভিন্ন ভিন্ন বিভিন্ন আলদা আলাদা চরিত্র হয়ে বাঁচি। এইসব চরিত্রকে একত্রিত না করলে, এক সুতোয় না গাঁথলে অর্থাৎ বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে রিইন্টিগ্রেশন তা না করলে এই সমস্যার সমাধান করা যায় না।