ডিপ্রেশন

বেদ ভট্টাচার্য। সুপরিচিত লেখক। বড় এবং ছোট মিলিয়ে এবার পুজোয় লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটা পত্রিকায়। লেখালিখির জন্য ঘটেছে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তি।

Must read

অংশুমান চক্রবর্তী: বেদ ভট্টাচার্য। সুপরিচিত লেখক। বড় এবং ছোট মিলিয়ে এবার পুজোয় লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটা পত্রিকায়। লেখালিখির জন্য ঘটেছে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তি।
অগাস্ট থেকেই ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছিলেন। কোথায় কী লিখছেন। ধীরে ধীরে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যার প্রচ্ছদ। লেখকসূচি। সঙ্গে নিজের হাসি মুখের ছবি। প্রতিটি পোস্টে লাইকের বন্যা। সঙ্গে রকমারি কমেন্ট। বেদকে দেখে সাহিত্য জগতের অনেকেই অবাক হন, একজন মানুষ কী করে এত লিখতে পারেন!

আরও পড়ুন-রেড রোডে বিদায় বেলায় আনন্দের সুর

চাপা অহংকার অনুভব করেন বেদ। কোনও সভাসমিতিতে তাঁর লেখার পরিসংখ্যান নিয়ে কথা উঠলে শুরুতে বলেন, ‘‘খুব বেশি লিখতে পারলাম না এবার।” তারপরই গড়গড় করে নামিয়ে দেন তালিকা। প্রথমে এলিট পত্রপত্রিকার নাম। পরে লিটল ম্যাগাজিন।
লেখক হিসেবে তাঁকে অস্বীকার করা যায় না। বহু মানুষ পছন্দ করেন। বেরিয়েছে কয়েকটা বই। বিক্রি মন্দ হয় না। বড়-ছোট সব মাপের লেখক-সম্পাদকরা চেনেন। প্রত্যেকেই মনে করেন, আগামীদিনে বেদ আরও নাম করবেন। সেই সম্ভাবনা আছে।
এ হেন বেদের মনকেমন। কেন? দুর্গাপুজো শেষ বলে? একেবারেই না। তাহলে? কারণ অন্য।

আরও পড়ুন-বাসে আগুন, মৃত ১২

পুজোর কিছুদিন আগে থেকেই তিনি ফেসবুকে দেখেন এমন কিছু পত্রিকার নাম, যেখানে নেই তাঁর লেখা। প্রথম প্রথম খুব একটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, দীর্ঘ হয়ে সেই তালিকা। কিছু পত্রিকা তাঁর জানা, কিছু একেবারেই নতুন। লিখছেন পরিচিতজনরা। হিসেব করে দেখা গেছে, যত পত্রিকায় লিখেছেন, তার বেশি সংখ্যক পত্রিকার তিনি নেই। আর যায় কোথায়? এইসব দেখে জাঁকিয়ে বসেছে গভীর মনখারাপ।
বিষয়টা চরমে চলে যায় পুজোর দিন পনেরো আগে। কী ঘটেছে? সম্পাদক অতনু সেনগুপ্ত ‘লক্ষ্মীপেঁচা’ পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য বেদের লেখা নেননি। অথচ আদর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রকাশ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র। এই পত্রিকায় আগে বহুবার লিখেছেন বেদ। এবার তিনি বাদ। লেখক তালিকায় আছেন চেনাজানা অনেকেই। এতেই জোর ধাক্কা খেয়েছেন বেদ। স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষা করেননি অতনু সেনগুপ্তের আমন্ত্রণ।
মহালয়ার দিন পর্ণাভর বাড়িতে গিয়েছিলেন বেদ। পর্ণাভ সুলেখক। বেদের দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাঁরা একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান। লেখালিখি নিয়ে সময় কাটান। কথা হয় পুজোর লেখালিখি নিয়েও। পর্ণাভ কয়েকটি পত্রিকা দেখান বেদকে। প্রত্যেকটাই উচ্চমানের। সেগুলোর পাতায় পর্ণাভ উপস্থিত, বেদ অনুপস্থিত।

আরও পড়ুন-ভূস্বর্গে যাবেন না: মার্কিনিদের পরামর্শ বাইডেন প্রশাসনের

পর্ণাভ জিজ্ঞেস করেন, ‘‘বেদ, তুই এইগুলোয় লিখিস না কেন? খুব স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা।”
বেদ বলেন, ‘‘সম্পাদকরা তো বলেননি। এখন আর যেচে লেখা পাঠাতে পারি না।’’
পর্ণাভ বলেন, ‘‘আমি কোনও কিছুর তোয়াক্কা করি না। ভাল পত্রিকায় নিজেই লেখা পাঠিয়ে দিই। ছাপা হলে ভাল। নাহলে কোনও দুঃখ নেই। লিখি খুব কম। তুই তো প্রচুর লিখিস।’’
প্রচুর লিখলে কী হবে, খিদে কিছুতেই মেটে না বেদের। আরও বেশি লিখতে চান। পর্ণাভর ঘরে সাজানো পত্রিকাগুলো দেখে আশ্চর্যরকম গুটিয়ে গেছেন। মনের অবস্থা এমন, যেন তাঁর কোনও লেখাই জীবনে আলোর মুখ দেখেনি। যতটুকু পেয়েছেন তার জন্য সন্তুষ্ট না হয়ে, যেটা পাননি তার জন্য চরম আফসোস! এটা বেদের বরাবরের সমস্যা।

আরও পড়ুন-ঐতিহ্য-শিল্প-সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনে বিস্মিত বিদেশিরাও, রেড রোডে উৎসবের বিশ্বায়ন

তিস্তা। বেদের হবু বউ। স্কুলে পড়ান। পঞ্চমীর দিন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন দুজন। উপহার বিনিময় হেতু। তিস্তা লক্ষ্য করেন, আশ্চর্যরকম মুষড়ে রয়েছেন বেদ। জানতে চাওয়ার পরেই সামনে আসে কারণ। সব শুনেটুনে তিস্তা বলেন, ‘‘এটা ঠিক হচ্ছে না বেদ। প্রচুর লিখেছ। তোমার মতো এত লেখা খুব কমজনই লিখেছেন। তবু মনখারাপ করছ কেন?’’
বেদের জবাব, ‘‘লিখেছি প্রচুর। এটা সত্যি। পাশাপাশি এতগুলো পত্রিকায় আমি নেই, ভাবলেই অস্বস্তি হচ্ছে। কত নতুন নতুন পত্রিকা। খবরই পাইনি। ফেসবুকে পোস্টগুলো দেখলে চাপা কষ্ট অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, যেন কিছুই পাইনি। জানো তো, পর্ণাভ লিখেছে এর মধ্যে অনেকগুলোয়।’’

আরও পড়ুন-দীপাবলির আগেই দাম বাড়ল সিএনজি ও পিএনজির

চুপচাপ বেদের কথা শোনেন তিস্তা। বুঝিয়ে বলেন, ‘‘তুমি একদম ঠিক নেই, বেদ। নিষ্ঠা, ভালবাসা নয়, লেখালিখি নিয়ে তুমি মারাত্মক অ্যাডিকটেড হয়ে পড়েছ। মেতেছ নিজেকে ছড়ানোর নেশায়। যেনতেনভাবে। এই সমস্যা তোমার আগেও ছিল। এখন চরমে পৌঁছেছে।’’
অবাক বেদ। বলেন, ‘‘তুমি এমন কথা বলছ, তিস্তা? দশ বছর আগেও এত মানুষ আমাকে চিনত না। লেখার জন্য পরিচিতি পেয়েছি। নিজেকে আরও বেশি ছড়িয়ে দিতে চাওয়া কি দোষের?’’
তিস্তা বলেন, ‘‘ধ্রুবদার কথা মনে আছে বেদ? কী বলেছিলেন তোমাকে, মনে পড়ে?’’
মাথা নিচু করে বেদ বলেন, ‘‘মনে পড়ে। উনি বলেছিলেন, কোয়ান্টিটিতে নয়, কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী হতে হবে। আরও বলেছিলেন, কম, অথচ ভাল লেখার চেষ্টা করতে হবে।’’

আরও পড়ুন-রান করেও ভারতীয় দলে ডাক না পেয়ে হতাশ পৃথ্বী

তিস্তা বলেন, ‘‘ধ্রুবদা সঠিক কথাই বলেছিলেন বেদ। সৃষ্টির আধিক্যের দিকে ঝাঁপিও না। কম লেখো। উৎকৃষ্ট মানের লেখো।’’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বেদ, ‘‘বলতে চাইছ আমার লেখা উৎকৃষ্ট মানের নয়?’’
তিস্তা বললেন, ‘‘তা কেন? যথেষ্ট ভাল লেখো তুমি। চেষ্টা করলে হয়তো আরও ভাল লিখবে। তবে তোমার এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টানাপোড়েন আমি মেনে নিতে পারছি না। নিজেকে স্থির রাখতে শেখো বেদ।’’
—আমি স্থির আছি, তিস্তা।
—ভুল বলছ। তুমি একেবারেই স্থির নেই। তুমুল অস্থিরতা খেলা করছে তোমার মধ্যে। আসলে তুমি একা নও, অস্থিরতার শিকার এই সময়ের আরও অনেকেই। সবাই মেতেছে অঙ্কের খেলায়। সংখ্যার খেলায়। কেউ তিরিশ, কেউ চল্লিশ, কেউ পঞ্চাশ। কেউ তারও বেশি। এরজন্য দায়ী মূলত সোশ্যাল মিডিয়া। বিনা পয়সায় অন্যদের বিজ্ঞাপিত করে মানুষের মনের মধ্যে বাড়িয়ে দিচ্ছে চাহিদা। লড়িয়ে দিচ্ছে একে-অন্যের সঙ্গে। অদৃশ্য কুরুক্ষেত্রে জিততে চাইছে সবাই। আপন হয়ে যাচ্ছে পর। বন্ধু হয়ে যাচ্ছে শত্রু। শুধু লেখালিখির জগতেই নয়, এই খেলা চলছে সব ক্ষেত্রেই।

আরও পড়ুন-১০ লক্ষ ব্যবহারকারীর লগইন তথ্য ফাঁস হয়েছে, জানাল মেটা

—ভুল বলছ তুমি।
—ঠিক বলছি। পঞ্চাশটা পত্রিকায় লিখেও তোমার পেট ভরেনি। আরও লিখতে চাও। অথচ দেখো, তোমার বন্ধু পর্ণাভ দশটা পত্রিকায় লিখেই তৃপ্ত। এই হল তফাৎ। আসলে ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে। তাই নিজের নিয়ে বেশ আছে।
চুপচাপ শুনে যান বেদ। ঠান্ডা হতে থাকে খাবার। তিস্তা বলে যান, ‘‘অন্যভাবে ভাবো। ফিরে যাও দশ বছর আগে। শুরু করো শূন্য থেকে। নিজের মতো লেখো। নিজের জন্য লেখো। যেটুকু পাচ্ছো, সেটুকু নিয়েই আনন্দে থাকো। অপ্রাপ্তি নিয়ে হতাশ হয়ো না। তরল হয়ে যেও না কোনওভাবেই। তোমার মধ্যে ক্ষমতা আছে। সেটা কাজে লাগাও। সোশ্যাল মিডিয়া তোমাদের অঙ্ক দৌড়ে নামিয়েছে। তাই এই সংখ্যার খেলা। লক্ষ্য জানা নেই। অনন্ত দৌড়। আরও চাই। আরও চাই। অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা থেকে হতাশা। ডিপ্রেশন। ধীরে ধীরে বাড়ছে। অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে ক্ষতি। মনে রেখো, তুমিও কিন্তু চরম ডিপ্রেশনের শিকার। যাও, একবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নাও।’’

আরও পড়ুন-রেড রোডে শুরু বিসর্জনের বর্ণাঢ্য মেগা কার্নিভাল

তিস্তার শেষ কথাটা নিতে পারলেন না বেদ। দুম করে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘‘যথেষ্ট হয়েছে। আর জ্ঞান দিও না, তিস্তা। এটা তোমার ক্লাসরুম নয়। আমি তোমার স্টুডেন্ট নই। পাগল নই আমি। স্বাভাবিক আছি। মনে রেখো, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়ব না। ভাল থেকো।’’
রেগেমেগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বেদ। পঞ্চমীর দিন। পুজোর মধ্যে আর যোগাযোগ করেননি তিস্তার সঙ্গে। রিসিভ করেননি তিস্তার ফোন। এইভাবেই পেরিয়ে গেছে দশমী। একদিনও বাইরে বেরোননি বেদ। ছুঁয়ে দেখেননি একটা পত্রিকার পাতাও। চুপচাপ শুয়ে বসে কাটিয়েছেন। বারবার মনে পড়েছে তিস্তার কথাগুলো। মনে পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে।
আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। হু-হু করছে বুকের ভিতরটা। যেন সমুদ্র তীরে বালুঝড়। তিস্তার জন্য তুমুল মনকেমন জন্ম নিচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে চোখ।

আরও পড়ুন-রাত জেগে সৎকারের তদারকি কাউন্সিলরের

হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বেদ। চাপিয়ে নিলেন পাঞ্জাবি। ফোনে ধরলেন তিস্তাকে, ‘‘বাড়িতে আছ? আসছি। না, আর রাগারাগি নয়। চল, ধ্রুবদার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। বহুদিন যাওয়া হয়নি।’’

Latest article