ডেস্টিনেশন পশ্চিমবঙ্গ

পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র— কী নেই? আছে ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থান। সুবিধা রয়েছে বেড়ানোর। তাই গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠেছে ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের ডেস্টিনেশন। লিখলেন চৈতালী সিনহা

Must read

পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় একটা রাজ্য। অতীতে ভ্রমণমানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের ঠাঁই ছিল পিছন দিকে। নানারকম পরিমার্জনার পর পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
উত্তরে হিমালয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা মুকুট সিকিমের হলেও পাহাড়ের অনেকটা অংশ পশ্চিমবঙ্গের। চির-চেনা দার্জিলিং, কর্শিয়াং, লাভা, লোলেগাঁও ছাড়াও হাল আমলের গজিয়ে ওঠা একাধিক কাঞ্চনমুখী জায়গা এখন এক-একটা স্পট। তাকদা, তিনচুলে, তাবাকোশি, বিজনবাড়ি, বড় ও ছোটমঙ্গেয়া, কালিম্পং, সিতং অহল্যাদাঁড়া, চিমনি, কাফেরগাঁওয়ে ভিড় যেন সারা বছর।

আরও পড়ুন-পুজোয় মহাকাশ ভ্রমণ

পলাশ লালে লাল
পলাশ ফোটার সময় জঙ্গলে জঙ্গলে এখন মানুষের ভিড়। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে শেষ শীতে, বসন্তে মানুষের ঢল। জঙ্গলে রকমারি বিলাসবহুল রিসর্ট, নানা আমোদ-প্রমোদের মাঝে থাকছে আগুন রাঙা পলাশের সমারোহ। পুরুলিয়া এখন পর্যটন মানচিত্রে খুবই জনপ্রিয়। চকচকে কালো পিচ রাস্তা, দু’ধারে সবুজ জঙ্গল রোড ট্রিপে পুরুলিয়া বাঁকুড়াকে পছন্দ করার আরও একটা কারণ। বড়ন্তি, মাঠাবুরু, চরিদা, অযোধ্যা, মার্বেল লেক, চামতাবুরু, মুরুগুমা, দুয়ারসিনি, মুকুটমণিপুর, সবুজদ্বীপ, ভালপাহাড়, গড় পঞ্চকোট, মুরুগুমা হয়ে সুতানের গভীর জঙ্গল। আবার ওই পথ গিয়ে মিলবে ঝাড়গ্রামের রাস্তায়।
বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল
শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি সবই তরাইয়ের অংশ। নিউ মাল জংশনে নামলেই লাটাগুড়ি, মেদলাবাড়ি, জলদাপাড়া, চিলাপাতা, ডামডিং, সামসিং সুন্তালে-খোলা। ঘন জঙ্গলে ইতিউতি পাহাড়ের ক্ষয়াবশেষ, সঙ্গে সংকর্ষণ, জলঢাকা-সহ আরও কত তিরতির করে বয়ে চলা নদী গান শোনায়। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির ব্যাস একবুক দুঃখ গলে জল। জঙ্গলে হাতি, হায়না, নেকড়ে, গন্ডার— সব আছে। রিসর্টের উষ্ণ আতিথেয়তা ভোলাবে মন। সকালে হাতির পিঠে চেপে জঙ্গলভ্রমণ কিংবা জিপে চেপে। ডুয়ার্সভ্রমণ এখন খুবই সহজ আর সীমিত সাধ্যের মধ্যে বলে জনপ্রিয় তো বটেই। তাই ডুয়ার্সের অবশ্য দর্শনীয় স্থানগুলি আলাদাভাবে লেখা ভাল।
গরুমারা জাতীয় উদ্যান পশ্চিমবঙ্গের একটি জাতীয় উদ্যান। তোর্সা নদীর তীর-ঘেঁষে ডুয়ার্সের আরেকটি সংরক্ষিত বন যা জলদাপাড়া নামে পরিচিত। ২০১২ সালে একটি জাতীয় উদ্যান হিসাবে, জলদাপাড়া অসমের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের পরে একশিংওয়ালা গন্ডারের বৃহত্তম জনসংখ্যার জন্য পরিচিত। ভুটানের পাহাড় দ্বারা ঘেরা বক্সা টাইগার রিজার্ভ নামে একটি সবুজ বন। বাঘের দেখা নেই কিন্তু বক্সা টাইগার রিজার্ভ তার ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং ট্রেকিং রুটের জন্য বিখ্যাত। বক্সা টাইগার রিজার্ভ বক্সা দুর্গ বা লেপচাখা গ্রামে ঘুরে আনন্দ পান।

আরও পড়ুন-বাংলাসাহিত্যে ভ্রমণ

মাদারিহাট থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দক্ষিণ খয়েরবাড়ি উত্তরবঙ্গের প্রথম প্রাণী-উদ্ধার কেন্দ্র— রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার অ্যান্ড লেপার্ড। রেসকিউ সেন্টার নামে পরিচিত, দক্ষিণ খয়েরবাড়ি উদ্ধার করা প্রাণীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। দক্ষিণ খয়েরবাড়িতে ১৮টি চিতাবাঘ রয়েছে। দর্শনার্থীরা দক্ষিণ খয়েরবাড়ি ঘুরে দেখতে পারেন এবং ব্যাটারিচালিত গাড়ির সাহায্যে তাদের আধা প্রাকৃতিক আবাসস্থলে উদ্ধার করা প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
মূর্তি পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের উপ-ক্রান্তীয় বনের মধ্যে অবস্থিত সবুজ নদী উপত্যকা। এটি প্রকৃতিপ্রেমীদের এবং অভিযাত্রীদের জন্য একটি জনপ্রিয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের সীমানায় অবস্থিত চিলাপাতা নামে একটি বিলাসবহুল বন সংরক্ষিত। এটি আলিপুরদুয়ার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাভা উপজাতির বাড়ি, চিলাপাতা বন বৃহৎ তৃণভোজী প্রাণীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানান্তর করিডর। চিলাপাতার ঘন জঙ্গলে নলরাজা গ্রহের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
চা-বাগানে ঘেরা স্যামসিং ডুয়ার্সের একটি অফবিট গন্তব্য। স্যামসিং শিলিগুড়ি থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের সূচনা পয়েন্ট। স্যামসিং-এর অনন্য অবস্থান এবং সচিত্র দৃশ্য-সহ অনেক ভ্রমণকারীর জন্য একটি গেটওয়ে গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
স্যামসিং থেকে ৪ কিমি দূরে অবস্থিত সুনতলেখোলা নামে আরেকটি অফবিট গন্তব্য। স্থানীয় ভাষার জন্য এটির নাম এসেছে সুনতলে শব্দের মানে কমলা এবং খোলা শব্দটি নদী। আধা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন সুনতলেখোলা বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুটের আশ্রয়ের জন্য পরিচিত। সুনতলেখোলা থেকে সবচেয়ে বিখ্যাত ট্রেকিং রুট নেওড়া ভ্যালির দিকে।
রকি আইল্যান্ড ডুয়ার্সের একটি ইকো ট্যুরিজম হাব যা স্যামসিং থেকে ২ কিমি দূরে অবস্থিত। মূর্তি নদী দ্বারা বেষ্টিত, রকি দ্বীপটি বিশালাকার পাথরের গঠন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। এটি মূর্তি নদীর তীরে ক্যাম্পিং এবং অ্যাঙ্গলিং করার জন্য একটি আদর্শ জায়গা।
ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়
মুর্শিদাবাদ নবাবদের বাসভূমি। বাংলার নবাব আলিবর্দি খান, সিরাজ উদ দৌলা, আর তাঁদের নবাবি প্রাসাদ হাজারদুয়ারি। এখন সরকারি সংগ্রহশালা হলেও এক সময়ের ইতিহাসের কয়েকটি পাতা এখানে জীবন্ত আছে। সামনে গঙ্গা আর ওপারে মোতিঝিল— সিরাজের কবর। লুৎফা যেন নবাবি প্রসাদের ঝরোখা থেকে চেয়ে আছে উদাসী নয়ন মেলে। সে-দৃষ্টি বেয়ে গঙ্গা পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় খুশবাগে— খুশি কীসের জন্য নেই তবে ইতিহাসের একটা অধ্যায় এখানে মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে কবরে। কৃত্রিম মুক্ত চাষের লেকের নাম মোতিঝিল। মুর্শিদাবাদ মানে বাঙালির ইতিহাসের গৌরবগাথা। মুর্শিদাবাদ মানে বীরত্ব আর বেইমানির মিশ্র পাঠ। বাংলার আরও ইতিহাস গৌড়, মালদহে। পাণ্ডুয়া, আদিনা, হুসেন শাহি যুগের সাক্ষী। শশাঙ্ক একা হাতে ভার নিয়ে বাংলার সম্মান রক্ষা করেছেন আগ্রাসনের আর্যাবর্তীয় অভ্যাস থেকে। শীতের মুর্শিদাবাদের ভিড় জানান দেয় ইতিহাস মানুষের কত প্রিয়।

আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য

বাংলার ইতিহাসে মল্ল রাজাদের বীরত্ব, বীর হাম্বিরের কথা ছড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুরের ধুলোয় ধুলোয়। দলমাদল কামান, রাজবাড়ি, মদনমোহন আর ভেঙে যাওয়া প্রসাদ এখনও সাক্ষী দিতে পারবে গৌরবময় বাংলার ইতিহাসের। কালের বিবর্তনে রাজবাড়ির দালানে বসে হাসেন মা মৃন্ময়ী। বিষ্ণুপুর ভ্রমণ-প্রেমিক, মন্দির-গবেষক আর ইতিহাসপ্রেমীদের বড়ই প্রিয় জায়গা।
সাগর জলে সিনান করি
আগে বাঙালি সমুদ্র চিনত পুরীতে। এখন দিঘাকে ঢেলে সাজিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। তাই উপচে পড়া জনতার ঢেউ বঙ্গোপসাগরের বালুকাবেলায়। ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গার বিস্তার সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। বকখালি এবং ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রকে ঠিক সমুদ্র বলে মনে না হলেও কালচে বালির বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, ঝাউগাছের জঙ্গল, ভেড়ির মাছ মনোরম ছুটি কাটানোর জায়গা। গঙ্গাসাগর জনপ্রিয় হিন্দু তীর্থ। সাগরসঙ্গমে স্নানের পুণ্যলাভের আশায় সারা বছর মানুষ ভিড় করে গঙ্গাসাগরে। মকর সংক্রান্তির সময় এইখানে মেলা হয় আর লোক সমাগম হয় প্রচুর।
সমুদ্র-তীরবর্তী পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে অনেক। লাল কাঁকড়ার বিচ পুরুষোত্তমপুর, রয়েছে জুনপুট, শঙ্করপুর, তালসারি, তাজপুর মন্দারমণি হয়ে চির-চেনা দিঘা। ভাটার টানে পিছিয়ে যাওয়া সমুদ্র এগিয়ে আসে জোয়ারে। নরম বালিতে ঢেউয়ের রেখা আঁকে ফেনার আলপনা। জলের আসা-যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দোকান পশরা সব খুঁটির উপর, দোতলায়।

আরও পড়ুন-দার্জিলিং-কালিম্পংয়ে ফের ধস

চরণচিহ্ন ধরে
পশ্চিমবঙ্গের ধূলিধন্য নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পেয়ে, কামারপুকুরের মাটি ধন্য অবতার বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আগমনে। আর বিশ্বতীর্থ জয়রামবাটি জগজ্জননী সারদাদেবীর জন্মস্থল। বাংলার অক্সফোর্ড শান্তিনিকেতন।
পুরাণ সে পুরোনো কথা
সতীর মৃতদেহ নিয়ে শিবের তাণ্ডব— ধরিত্রী টলোমলো। সৃষ্টি বাঁচাতে নারায়ণের সুদর্শনচক্র এগিয়ে চলে, সতীর দেহ টুকরো করে একান্ন খণ্ডে। এক-এক খণ্ড মাটিতে পড়ে, তৈরি হয় মহা সতীপীঠ। কাঁধের ভার হালকা হতে টনক নড়ে শিবের, বসেন যোগে, রক্ষা পায় ধরা। একান্ন সতীপীঠের বেশ কয়েকটি পশ্চিমবঙ্গে। জলপাইগুড়িতে দেবীভ্রামরি, মুর্শিদাবাদে দেবী কিরীটেশ্বরী, বীরভূমে নলহাটিতে নলাটেশ্বরী, সাঁইথিয়াতে দেবী নন্দীকেশ্বরী, লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, বক্রেশ্বরে দেবী মহিষমর্দিনী, কঙ্কালীতলায় দেবী দেবগর্ভা, হুগলিতে দেবী রত্নাবলী, বর্ধমান জেলায় ক্ষীর গ্রামে মা যোগাধ্যা, অট্টহাসে মা অট্টহাসি, বহুলায় দেবী বাহুলা, কোগ্রামে দেবী মঙ্গলচণ্ডী সর্বোপরি কালীঘাটে মা কালী। বিশেষ তিথিতে এই সতীপীঠগুলিতে ভিড় উপচে পড়ে। এছাড়া সাধনপীঠ হিসেবে তারাপীঠ আর দক্ষিণেশ্বর সারা বছর লোককে টেনে রাখে। বিশ্ববিখ্যাত হয়েছে মায়াপুরের ইসকন মন্দির, বেলুড় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ মিশন।
ভ্রমণে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানের জনপ্রিয়তার গ্রাফ রীতিমতো ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণ চকচকে রাস্তাঘাট আর ঝকঝকে রিসর্ট। পর্যটন কিন্তু রীতিমতো অর্থকরী শিল্প।

Latest article