আমাদের মহান দেশ ভারতে যুগ যুগ ধরে নানা পর্যটক ও ধর্মপ্রচারকেরা এসেছেন। তাঁরা ভারতের সমাজ, দেবদেবী, আচার, লোকায়ত ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভগিনী নিবেদিতা এঁদের মধ্যে একজন। তিনি ভারতকে শিক্ষা দিতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন শিষ্যা হয়ে। তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে ভারতের প্রাণস্পন্দনকে চিনিয়েছিলেন। নিবেদিতা তাঁর বাগবাজারের ছোট্ট গলির স্কুলবাড়িটিতে থাকতেন যে-গৃহ নবজাগরণের পুরোধা পুরুষদের আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এখানে বসেই তিনি বাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো দেখেছিলেন, ভারতের শক্তিপুজোর আঙিনায় এই দেবী-আরাধনার গুরুত্বটিও অনুধাবন করেছিলেন।
আরও পড়ুন-কল্পারম্ভে দুর্গাপূজা
বাঙলার রাজধানী কলকাতা তখন নতুন বাবুসমাজ আর ধনীদের বিচরণ ক্ষেত্র। দুর্গাপুজো তখন নতুন গড়ে ওঠা জমিদারদের জাঁকজমক দেখানোর মাধ্যম। অনেক গৃহে ইংরেজরাও অতিথি। কিন্তু তাঁরা এই পুজো দেখতে গিয়ে দেবীপুজোর মর্মস্থলের মূল বিষয়টি জানতে চাননি কখনওই। নিবেদিতা কিন্তু তাঁদের থেকে একটু ব্যতিক্রমী চরিত্র। তিনি ভিন্নভাবে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন।
শক্তিতত্ত্বের ওপর ভগিনী নিবেদিতার বিশেষ অনুসন্ধিৎসা ছিল। ১৮৯৯ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতে আগমনের কিছুদিন পরেই নিবেদিতা বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর বিষয় ছিল, ‘Kali and her worship’. যদিও তিনি এই বক্তৃতায় দেবী কালীর মহিমা উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন কিন্তু এই বক্তব্যেই তিনি দেবী দুর্গার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
আরও পড়ুন-আবার দাদাগিরি
‘In Durga, we have, indeed an element of queenhood, but it is the power of the queen, not her privilege. Emerging from amidst the ten points of the compass, one foot on the lion, and one on the Asura, striking with the serpent and holding instruments of worship and weapons of destruction, there is, in Durga, a wonderful quality of literary interpretation. She is a wonderful symbol of the Power that manifests itself as Nature— the living energy at the centre of this whirpool.’
নিবেদিতার প্রথম আলোচনায় শক্তির রানি দুর্গা, যাঁর অস্ত্র-সমন্বিত দশবাহু, গলার সাপ থেকে শুরু করে পায়ের তলায় পড়ে থাকা অসুর ও বাহন সিংহ— সবই যেন মহাশক্তির বার্তা ঘোষণা করে। দেবী হলেন শক্তিস্তম্ভ, যা সমস্ত ক্রিয়ার প্রেরণাস্বরূপ। প্রথম বক্তৃতায় বা ১৮৯৯ সালের, ২৮ মে-র কালীঘাট মন্দিরে Kali Worship নামে দ্বিতীয় বক্তব্যে নিবেদিতার দেবী দুর্গা সম্বন্ধে মতামত সম্পূর্ণ রূপগ্রহণ করেনি। দেবী দুর্গা সম্বন্ধে তাঁর আরও পরিণত বর্ণনা আমরা তাঁর গ্রন্থ ‘Studies from an Estern Home’ গ্রন্থের মধ্যে দেখতে পাই। এই গ্রন্থে তিনি বাঙলার নানা উৎসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে দেখি একদিকে তিনি যেমন এই শারদীয়া উৎসবের ক্ষণটিকে চিহ্নিত করেছেন, আবার অন্যদিকে শক্তিতত্ত্বে দেবী দুর্গার ভূমিকা কী তা দেখাতে চেষ্টা করেছেন।
ভগিনী যে যুগে দাঁড়িয়ে দুর্গাতত্ত্বকে চিহ্নিত করছেন সেই যুগটি হল স্বাধীনতা লাভের জন্য বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের যুগ। যেখানে দেশভূমি মাতৃভূমিতে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন ‘আনন্দমঠ’, যেখানে মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন আর মা যা হইবেন— এই তিন স্তরের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে মাতৃতত্ত্বকে। আবার অরবিন্দ লিখেছেন, ‘ভবানী মন্দির’। যেখানে সেই মাতৃরূপ কল্পনাই বিবৃত হয়েছে। সেই যুগে বসে নিবেদিতা কিন্তু তাঁর দেবীভাবনার সূচনা করছেন দেবীর সামগ্রিক রূপবর্ণনা দিয়ে। পুরাণে দেবী দুর্গাকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল ভগিনীর মতে সেই দৃশ্য ছিল একেবারেই সামরিক। দেবী এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি যেন শৌর্য ও সৌন্দর্যের দৃপ্ত কোনও দেবদূত। দেবী মূর্তিমতি সৃজনশীল কর্মশক্তি। অশুভকে ধ্বংস করে শুভকে প্রতিষ্ঠা করেন। সব দেশের পুরাণের মধ্যেই এই শুভ শক্তির দেখা পাওয়া যায়। এখানে ভগিনী ভিন্ন দেশের পৌরাণিক উদাহরণ হিসেবে স্বর্গের জন্য ড্রাগনের সঙ্গে মাইকেলের যুদ্ধের কাহিনির কথা উল্লেখ করেছেন।
আরও পড়ুন-দূরপাল্লার ট্রেনে অনলাইনে খাবার অর্ডার, যাত্রীদের সতর্ক করল রেল
এক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অশুভকে ধ্বংস করা। কিন্তু ভারতীয় আদর্শে মায়ের ভূমিকা রক্ষাকারীর, তাই অশুভকে ধ্বংসের জন্য মায়ের রূপকল্পনা করা হয়েছে। মা রক্ষা করছেন। তাই তাঁর আবেদন অন্যমাত্রা পেয়েছে। ঠিক এর পরেই ভগিনী যে সময় পুজো সম্পন্ন হয় সেই সময়ের প্রকৃতির কথা উল্লেখ করছেন। তিনি বলছেন, ‘হয়তো বর্ষা সবে শেষ হয়েছে, উত্তরভারতে প্রথম সাতদিন যায় অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার ও সেগুলির প্রদর্শনীতে, আর দশমীর দিনে হয় প্রণাম ও অস্ত্রকৌশল দেখানো। নাগপুরে এইদিন মজার দৃশ্য দেখা যায়, ভোঁসলেদের শেষ বংশধর বের হন রাজকীয় পরিব্রাজনে। তাঁর পিতৃপুরুষের কাছে এই যাত্রা হয়তো ছিল লুটের অভিযান, তারও বহু আগে হয়তো ছিল শিকার-সময়ের সূচনা।’
নিবেদিতার মতে, উৎসবের ক্ষেত্রে শরৎ ঋতুকে নির্বাচনের কারণ ছিল, এই পুজোর সামরিক চরিত্রকে আরও তীব্র করা। সমগ্র ভারতে ‘দশেরা’ বা বিজয়া দশমীর উৎসব একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ এইদিন রামচন্দ্র লঙ্কার রাজা রাবণকে বধ করেছিলেন। কিন্তু এই বিজয় উল্লাস উৎসবটির সামরিক দিকটিকে আরও স্পষ্ট করে। নিবেদিতার মতে, বর্ষাশেষে, শরতের মেঘমুক্ত প্রকৃতিতে মানুষ শিকারে নির্গত হত। সময়টি ছিল শিকারের জন্য প্রশস্ত। পরবর্তীকালে এই শিকার অভিযানের চিহ্নও দুর্গাপুজোর আচারের মধ্যে রয়ে গিয়েছে। শক্তির আরাধনা করে শক্তিলাভ করা মানুষের মূল উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-নিরাপত্তা বাড়ল বিদেশমন্ত্রীর
সমস্ত ভারতে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রটি এরকম হলেও নিবেদিতা দেখেছিলেন বাঙালির কাছে এই পুজো এবং তার রূপকল্পনা ভিন্ন আবেদন সৃষ্টি করেছে। এখানে দেবী কেবল মূর্তিমতি শক্তি নন, তিনি বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গললনা রূপে আরাধিতা। যে কন্যা পতিগৃহ থেকে প্রতিবছর পিতৃগৃহে বেড়াতে আসেন। নিবেদিতা বলেছেন,‘‘দেবচরিত্রের উপর এই মানব ধর্ম আরোপ কেবল বাংলায় হয়নি, সমগ্র পূর্ব এশিয়া এ-ব্যাপারে অগ্রণী।’’
আমরা দেখতে পাচ্ছি ভগিনী নিবেদিতা তাঁর বিশ্লেষণে প্রথমে এনেছেন প্রকৃতিকে। কারণ, বর্ষা সবে শেষ হয়েছে। তাই অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শনের জন্য একটি উৎসব তাঁদের প্রয়োজন। সত্যিই আমরা বাঙলার বাইরে দেবী আরাধনার থেকে দশেরা উৎসবের প্রচলন বেশি দেখতে পাই। কিন্তু বাঙালির কাছে দেবী মাতা। তারা মায়ের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে দেবীরূপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন বাঙলার বিপ্লবের পীঠস্থান কলকাতার যুবকবৃন্দ। ভগিনীর আলোচনার মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গার পুজো এবং উৎসব আমাদের চোখে ভিন্ন অর্থ বহন করে। কিন্তু এখানেই ভগিনী থেমে যাননি। তিনি আরও অগ্রসর হয়েছেন, তিনি এই সময়ে আরাধিত তিন দেবীর কথা বলছেন। যে তিন দেবী পরপর পূজিতা হন। তাঁরা হলেন— দেবী দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী। দুর্গাপুজোর পরেই আসে কালীপুজো আর তার কিছুদিন পর জগদ্ধাত্রী। তিনি বলছেন, ‘দুর্গা-কালী-জগদ্ধাত্রী— এই তিন বৈশিষ্ট্যসূচক ধারণার মধ্যে দিয়ে বলতে চেয়েছেন, দুর্গা হলেন দিব্য কর্মশক্তি।
আরও পড়ুন-কোচবিহারের রাস্তায় জয় রাইড
কালী অন্ধকারের জন্মদাত্রী, তিনি ধ্বংস করেন। বলি গ্রহণ করেন। তাঁর কৃপা হল মৃত্যু। আর শেষে ভগবানের হৃদয়ের মমতা হল জগদ্ধাত্রী।… তিনি পৃথিবীর জননী।’ দুর্গাপুজোর পরই আসে কালীপুজো। তারপর জগদ্ধাত্রী। আমরা যদি দেবী দুর্গা আর দেবী কালিকার পৌরাণিক উৎস সন্ধানে যাই, তবে দেখব সেই মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত চণ্ডীতেই দুই দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। একই দেবীর দুই রূপ। নিবেদিতার শক্তিভাবনা পরিপুষ্ট হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের শক্তিভাবনার মাধ্যমে। ‘স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি’ গ্রন্থে নিবেদিতা বলছেন, ‘কালীমূর্তির ব্যাখ্যা করিতে অনুরোধ করিলে তিনি (স্বামীজি) বলিতেন, মা যেন একখানি মহাগ্রন্থ। যাহা পাঠ করিয়া মানব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাইয়া অবশেষে দেখে উহাতে কিছুই নাই। আমার মনে হয় ইহাই চরম ব্যাখ্যা।… যে আচার্যশ্রেষ্ঠকে আমি অনুসরণ করিয়া আসিয়াছি, তাঁহার জীবনের প্রতি যতই গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি, ততই প্রতিদিন আমি অধিকতর স্পষ্টরূপে দেখিতে পাই যে, তিনি স্বয়ং অভিজ্ঞতারূপ মহাগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলি উলটাইয়া যাইতেছিলেন এবং অবশেষে শেষ শব্দটি পড়া হইবামাত্র শ্রান্ত শিশুর ন্যায় মাতৃক্রোড়ে শয়ন করিয়া মহাসমাধিতে মগ্ন হইলেন।’ দেবী দুর্গা, দেবী কালিকা এবং দেবী জগদ্ধাত্রী— একই দেবীর তিন প্রকাশ।
আরও পড়ুন-৭০টি হোমিওপ্যাথি, ৪০টি আয়ুর্বেদিক, ১০টি ইউনানি, রাজ্যে খুলছে আরও ১২০টি নতুন আয়ুষ চিকিৎসাকেন্দ্র
এ-কথা ভগিনী বলেছেন বারংবার। দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে দিয়ে প্রবল কর্মশক্তির আরাধনা করি আমরা। কিন্তু তারপরই আসে মৃত্যুর দেবীকে আরাধনারক্ষণ। দেবী কালিকার আরাধনা। এই দুই বিপরীত ক্রিয়া একসঙ্গে প্রকাশিত হয় দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যে। এঁরা তাই তিনে এক একে তিন। এই পুজোর ক্রমটি যিনি সৃষ্টি করেছিলেন তিনি এই দর্শনকেই অনুসরণ করেছেন বলে নিবেদিতা মনে করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শ্রীশ্রীচণ্ডীর মন্ত্র উচ্চারণ দেবীর সামরিক চরিত্রকে ভরিয়ে তোলে। যে ছন্দ মানুষের জীবনে আনে আশ্বাস আর অভয়বাণী। দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রীর মাধ্যমে একটি নিটোল নারীচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন নিবেদিতা। যা অন্য বিদেশির চোখে ফুটে ওটা দেবীরূপের থেকে একেবারেই পৃথক।