আগামী সপ্তাহেই মুক্তি পাবে পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরীর ছবি ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’। গত ডিসেম্বরে ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরমা বিভাগে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে এই ছবিটি। বাংলার প্রথম মাল্টিভার্স ছবি পেয়েছে একাধিক সম্মান। এনএবিসি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ছবি, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং সেরা এডিটিংয়ের জন্য মনোনীত হয়েছে। আটালান্টা ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও এই ছবির পরিচালক পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সম্মান।
আরও পড়ুন-সোনার বাইবেল : আবেদন সায়ন্তিকার
কেন এত সম্মান এবং পুরস্কার পেল ‘ধ্রুবর আশ্চর্য জীবন’! কী রয়েছে ছবিতে? জনার নিয়ে যদি কথা বলি তাহলে এই ছবিতে রয়েছে ক্রাইম থ্রিলার এবং সায়েন্স ফিকশন, হরর রোম্যান্টিক প্রেম— সবকিছুই। ছবিটাকে বুঝতে হলে গল্পটা একটু বলতে হবে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ধ্রুব, যে নিজের প্রেমিকা রিমির পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে এক জটিল মুহূর্তের সম্মুখীন হয়। ধ্রুব বুঝতে পারে রিমিদের জন্য টাকা জোগাড় করতে গেলে তাকে একটা অপরাধ করতেই হবে। কিন্তু রিমি চায় না ধ্রুব কোনও খারাপ কাজ করুক। ধ্রুবকে দুটো রাস্তার মধ্যে যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। তখন সমাজের চোখে কোনটা অপরাধ এবং কোনটা নয় নৈতিকতার এই টানাপোড়েনে ধ্রুবর জীবন কখনও ডুবে যায়, কখনও ভেসে ওঠে। এখানেই ছবিটাকে একাধিক স্তরে ভাগ করেছেন পরিচালক। মধ্যবিত্তরা সবসময় আদর্শ আর বাস্তব— এই দুয়ের টানাপোড়েনে ভোগে আর সেটাই তাদের পথ খুঁজতে বাধ্য করে। সেই পথগুলোই হয়ে যায় ধ্রুবর জীবনের এক-একটা চয়েস আর সেই চয়েসগুলো নিয়েই তৈরি হয়েছে ধ্রুবর এক-একটি জগৎ। ধ্রুবর এই চারটে জীবন কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত? এই চারটে জীবন কি আদতে সমান্তরাল বিশ্ব? এটাই ছবির প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-সোনার বাইবেল : আবেদন সায়ন্তিকার
এই ছবি প্রসঙ্গে অভিনেতা ঋষভ বসু বললেন, ‘‘অভিজিৎদার সঙ্গে এটা আমার দ্বিতীয় কাজ। প্রথম করেছিলাম হইচই-এর একটা সিরিজ ‘টুরু লাভ’। ওঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সবসময়ই ভাল। ২০২৩-এ উনি আমাকে গল্পটা বলেন সঙ্গে চরিত্রটাও। শুনেই মনে হয়েছিল বাংলায় এমন গল্প নিয়ে ছবি আগে কখনও হয়নি। এই গল্পের অনেকগুলো স্তর রয়েছে। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা নির্বাচন আমাদের রাস্তা নির্ধারণ করে দেয়। সেই রকমই ধ্রুবর এক-একটা চয়েস কী করে এক-একটা রাস্তা খুলে দেয় সেটা নিয়েই এই গল্প। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টা জটিল মনে হলেও ছবিটা দেখতে বসলেই দর্শক বুঝবে জটিল একেবারেই নয়। খুব ছোট ইউনিট ছিল আমাদের, সবাই মিলে সব কাজ করেছি। ডিরেক্টর, প্রোডিউসার দুজনেই খুব খুশি হয়েছিল শ্যুট শেষে। আমাদের একটা চিন্তা ছিল যে এই ছবিটা মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবেন, কারণ এতগুলো বিষয়কে ছুঁয়ে যাচ্ছে ছবিটা। কিন্তু যখন কলকাতায় নজরুল তীর্থ এবং রবীন্দ্র সদনে দেখানো হল, তখন সেখানে দর্শকদের খুব ভাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আমাদের ছবি বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেল। বিশেষ করে সেরা অভিনেতার সম্মান পাওয়া আমার জীবনের সেরা অ্যাচিভমেন্ট।’’
আরও পড়ুন-অমর একুশে, ভুলিনি ভুলব না
এই ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল ধ্রুবর জীবনের ওই চার অধ্যায়। যে অধ্যায়গুলোয় চারজন কিংবদন্তি বাঙালি চিত্রকরকে ট্রিবিউট দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন যামিনী রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিকাশ ভট্টাচার্য ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। কীভাবে এসেছেন তাঁরা ছবিতে। পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরী বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন, আসলে ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাশূন্যদের মাঝখানে থাকা মধ্যবিত্ত জীবন প্রায়শই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয় যে, আদর্শ আঁকড়ে থাকা না আদর্শ ছেড়ে টিকে থাকার লড়াই চালানো, কোনটা? ছবির নায়ক ধ্রুবও সেই প্রশ্নেরই মুখোমুখি। ধ্রুবর জীবনের চারটি অধ্যায়কে চার চিত্রকরের কাজের থিমে ডিজাইন করেছি। প্রথম যামিনী রায়। ইউরোপিয়ান আর্টে প্রশিক্ষিত যামিনী রায় কিন্তু সব ছেড়ে দেশীয় শিল্পরীতি পটচিত্র বেছে নেন। বহুমূল্যে ছবি বিক্রি করার প্রচলিত রাস্তায় না হেঁটে আজীবন সামান্য টাকায় ছবি বিক্রি করেন যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই যামিনী রায়ের থিম হল প্রথম গল্পের থিম।
এরপর গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ভারতবর্ষে প্রথম কিউবিজম পেন্টিং নিয়ে কাজ করেন। গগনেন্দ্রনাথ দেশের অন্যতম অগ্রণী পলিটিক্যাল কার্টুনিস্টও ছিলেন। সেই সময়ের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক ব্যবস্থা এবং বর্ণবাদকে ব্যঙ্গচিত্রে তুলে ধরেছিলেন। এই গগনেন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছবি বিসর্জন এই গল্পের সেন্ট্রাল থিম।
শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য। তিনি আমার ছোটবেলার খুব প্রিয় শিল্পী। মর্ডান পেন্টিংয়ের অন্যতম। ওঁর একটা নির্দিষ্ট ঘরানার ছবি নিয়েছি যেটা হল ‘ডল সিরিজ’। সেই ডলের মধ্যে দিয়ে সোশ্যাল হরর বিষয়টিকে থিম হিসেবে তুলে ধরেছি।
সর্বশেষ চিত্রকর হলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। যিনি তাঁর মুর্যাষল আর্ট এবং স্ক্রল আর্টের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও তিনি তাঁর শিল্প সৃষ্টিতে অবিচল ছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করেন ‘ইনার আই’। তিনি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন কী করে সম্ভব অন্ধ হয়েও শিল্পসৃষ্টি করা! তখন তিনি বলেছিলেন শিল্পীদের অন্তর্দৃষ্টি থাকে যা দিয়ে তিনি দেখতে পান। শিল্পের এই সীমাহীন শক্তিই আমাদের চলচ্চিত্রে মূল থিম হয়ে উঠেছে। আসলে আপাতদৃষ্টিতে দেখা জীবনের ভিতরেও এক গভীর সত্য লুকিয়ে থাকে যা আমরা সোজা চোখে দেখতে পাই না। এটাই আর একটা থিম।
আরও পড়ুন-মোদির স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার ডাক ডেরেকের
ছবিটি নিবেদন করছেন প্রখ্যাত পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। যৌথ প্রযোজনায় রয়েছে ফোর্থ ফ্লোর এন্টারটেনমেন্ট ও কনসেপ্ট কিউব। গল্প লিখেছেন পরিচালক স্বয়ং এবং আলেখ্য তলাপাত্র। মুখ্য ভূমিকায় ঋষভ বসু ছাড়াও রয়েছেন ঋত্বিকা পাল, কোরক সামন্ত, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, যুধাজিৎ সরকার, আনন্দরূপা চক্রবর্তী, দীপক হালদার, শান্তনু নাথ, সেঁজুতি মুখোপাধ্যায় এবং প্রেরণা দাস প্রমুখ। ক্যামেরা করেছেন অর্ণব লাহা।