গর্ভাবস্থায় মধুমেহ : লড়াই নাকি আত্মসমর্পণ

গর্ভকালীন অবস্থায় মায়েদের এক বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস হয় যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস। এই ডায়াবেটিসে অনেক সময় গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। কেন হয় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস? কী কী করণীয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন মালদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ পল্লব বসু

Must read

গর্ভবতী মায়েদের শরীরে বেশ কিছু গর্ভকালীন (প্ল্যাসেন্টা নিঃসৃত) হরমোনের আধিক্য দেখা দেয়, অনেক মা মোটা হতে শুরু করেন, কাজে কিছুটা আলস্য আসে, খাওয়া বেড়ে যায় অনেকটাই। এ-সময়ে শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, যেটা কাটাতে প্যানক্রিয়াস অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসৃত করে। কিন্তু, কিছু মায়ের ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত ইনসুলিন বেরোয় না। এর সঙ্গেই কারও পারিবারিক ইতিহাসে আত্মীয়দের মধ্যে ডায়াবেটিস পাওয়া যায়, আবার কেউ কেউ প্রি-ডায়াবেটিক থেকে থাকেন। আবার কোনও মায়ের আগের সন্তানটি জন্মের সময় সাড়ে চার কেজির বেশি ওজনের হয়ে থাকে বা আগের গর্ভের সময় শুগার বাড়ার ইতিহাস থেকে থাকে। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই গর্ভজনিত ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস হওয়ার সম্ভাবনা মায়েদের মধ্যে বেশি হয়। অধিকাংশ মায়ের ক্ষেত্রেই অবশ্য শিশুর জন্মের সঙ্গেই রক্তে শুগারের মাত্রা স্বাভাবিকে নেমে আসে। খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রে অবশ্য রোগটি শিশুর জন্মের পরেও জেঁকে বসে শরীরে।

আরও পড়ুন-বিকল্প চিকিৎসায় নিউমোনিয়া

অনেক মায়ের মাথায়ই বাজ ভেঙে পড়ে, যখন জানতে পারেন গর্ভাবস্থায় শুগার বেড়েছে অনেকটা। আকুল হয়ে ডাক্তারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেন তাঁরা। স্বাভাবিক যে প্রশ্নগুলো তাঁদের মাথায় আসে, তেমনই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি এখানে––
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (GDM) ঠিক কখন বলা উচিত?
যে গর্ভবতী মায়ের আগে কোনওদিন ডায়াবেটিস ছিল না বা ধরা পড়েনি। গর্ভাবস্থায় চব্বিশ থেকে আঠাশ সপ্তাহের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করে শুগার ধরা পড়েছে। একমাত্র তাঁদেরই গর্ভকালীন মধুমেহ হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়। যারা গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং নিয়মিত চিকিৎসা করাচ্ছেন, অথবা চিকিৎসা না করালেও শুগার বেশি এটা জানেন, তাঁরা গর্ভধারণ করলে সেই অবস্থাকে কিন্তু জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলা যাবে না।

আরও পড়ুন-সন্তানের নিউমোনিয়া রুখবেন মা-ই

ঠিক কত শুগার হলে ডায়াবেটিস বলা যায়?
আট থেকে চোদ্দ ঘণ্টা ফাস্টিং অবস্থায় যদি ব্লাড গ্লুকোজ গর্ভাবস্থার তেরো সপ্তাহের আগে 92 mg/dL- এর বেশি থাকে, তাহলে পুনরায় গর্ভধারণের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। যদি এই সময়ে ফাস্টিং গ্লুকোজ 92 – 12-g/dL-এর মধ্যে থাকে এবং ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুঘণ্টা পর140 mg/dL বা তার বেশি হয় তবে একে GDM বলে। এই সময়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য অনেক ডাক্তার ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করতে বলেন। এক্ষেত্রে আট ঘণ্টা ফাস্টিং-এ গ্লুকোজের মাত্রা 92 mg/dL-এর বেশি এবং ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার একঘণ্টা পর ব্লাড গ্লুকোজ 180 mg/dL বা তার বেশি হয় এবং দুণ্টার পর 153 mg/dL-এর বেশি হয়, তাহলে GDM বলতে হবে। হাই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সই এইরকম হওয়ার কারণ। উপরোক্ত মাত্রা যদি ফাস্টিং-এ 126 mg/dL-এর বেশি এবং দুঘণ্টা পরে 200 mg/dL-এর বেশি আসে, তবে তাকে ওভার্ট ডায়াবেটিস বলে। উপরোক্ত পরীক্ষাটি দুটি স্তরেও করা যায়, একবার ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে যদি দেখা যায় 140 mg/dL-এর বেশি গ্লুকোজ মাত্রা আসছে রক্তে, সেক্ষেত্রে আবার ১০০ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে পরখ করা হয়।

আরও পড়ুন-ফের ধর্ষণ করে খুন উন্নাওতে, দলিত ছাত্রীর বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার

৩) গর্ভাবস্থায় ঠিক কোন সময়ে শুগার পরীক্ষা করা উচিত?
যখনই কোনও মা প্রথমবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে দেখাতে আসবেন, তখনই একবার শুগার টেস্ট করে নিতে হবে। যদি ফাস্টিং শুগার 92 mg/ dL-এর কম থাকে, কোনও ধরনের অন্যান্য বিপদসঙ্কেত বা রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকে, তাহলে আর শুগার পরীক্ষা জরুরি নয়। কিন্তু, যদি এই সময়ে মায়ের শুগার 92-এর বেশি আসে অথবা কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর থেকে থাকে, তাহলে আবার শুগার পরীক্ষা করতে হবে ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে। রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিম্নলিখিত: –
ক) BMI যদি 30 Kg/m2 বা তার বেশি হয়।
খ) আগের সন্তানের জন্মের সময়ের ওজন সাড়ে চার কেজি বা বেশি হয়।
গ) পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থেকে থাকে।
ঘ) আগের প্রেগনেন্সির সময়েও GDM হয়েছিল।
ঙ) পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা আছে।
চ) উচ্চরক্তচাপের সমস্যা আছে।
ছ) কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে ইত্যাদি।
প্রেগনেন্সির সময়ে শুগার বেশি থাকলে কী কী বিপদের সম্ভাবনা থাকছে?

আরও পড়ুন-ফের ধর্ষণ করে খুন উন্নাওতে, দলিত ছাত্রীর বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার

১) মায়ের রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্ল্যাসেন্টা পেরিয়ে পৌঁছে যায় ভ্রূণের রক্তে। এর ফলে ভ্রূণের শরীরে অতিরিক্ত ইনসুলিন বেরোয়। ইনসুলিন বিভিন্ন গ্রোথ ফ্যাক্টর নিঃসরণে বিশেষ ভূমিকা নেয়। তা ছাড়াও ভ্রূণের রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ ফ্যাটে পরিবর্তিত হয়ে জমতে থাকে শরীরে। ফলে শিশু আকারে বড় হয়ে যায়। আকারে খুব বড় শিশুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডেলিভারি করা কঠিন হয়। তখন সিজারিয়ান ডেলিভারির দরকার হয়। এ ছাড়া, এই শিশু, জন্মের পরেও অতিরিক্ত ইনসুলিন ক্ষরণ করতে থাকে। ফলে জন্মে অনতিবিলম্বে নবজাতক আক্রান্ত হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে কম গ্লুকোজ লেভেলে। খিঁচুনি, হাইপকসিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়।
২) মায়ের বর্ধিত শুগার শিশুর জন্মের পরেও পূর্বাবস্থায় নাও ফিরতে পারে এবং ওভার্ট ডায়াবেটিসে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে শুগারের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়।

আরও পড়ুন-এবার স্ক্রাব টাইফাস আতঙ্কে জলপাইগুড়ি

৩) একটি প্রেগনেন্সিতে GDM হলে, পরবর্তী প্রেগন্যান্সিতেও এটা হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৪) প্রি-ম্যাচিওর বা সময়ের আগে ডেলিভারি হওয়ার এবং মৃত বাচ্চা অর্থাৎ স্টিলবর্ন বেবি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৫) গর্ভের মধ্যে শিশুর কষ্ট বা যাকে ফিটাল ডিসট্রেস বলে সেটার ঘটনা বাড়ে।
৬) পরবর্তীকালে শিশুর টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর মধ্যে ভবিষ্যতে মোটা হওয়ার একটা প্রবণতাও থেকে যায়।
৭) মায়ের রক্তচাপ বৃদ্ধি, পা ফুলে যাওয়া, ইউরিনের সঙ্গে প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়া এবং ডেলিভারির সময়ে খিঁচুনি হতে পারে, যাকে যথাক্রমে Preeclampsia এবং Eclampsia বলে।
GDM হলে ভাল থাকার উপায় কী?
যদি রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে, শুগারের মাত্রা বেশি থাকে, উপযুক্ত ডাক্তার এবং নিউট্রিশন এক্সপার্টের নিয়মিত পরামর্শ নিয়ে চললে চিন্তার কিছু নেই। রইল, তেমন কিছু পরামর্শ:
১) ভয় না পেয়ে, মন ভাল রাখুন। মনে রাখুন, স্ট্রেস কিন্তু একইসঙ্গে শুগার বাড়িয়ে দেয় এবং স্ট্রেস হরমোনের প্রভাবে ভ্রূণের ক্ষতিও হতে পারে। বিপদ যেমন আছে, মুক্তির পথও আছে তার থেকে। জীবনশৈলী সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে জটিল থেকে জটিলতর রোগ নিরাময় সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন তিরিশ মিনিট করে হাঁটা বা সাঁতার কাটা, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে শুগারের মাত্রা।
২) ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে ডায়াবেটিক ডায়েট প্ল্যান এমনভাবে করতে হবে, যাতে কোনওভাবেই ভ্রূণের পুষ্টির অভাব না হয়।
৩) নিয়মিত শুগার, প্রেসার, পালস, ইডিমা ইত্যাদির পরীক্ষা করে যেতে হবে। উচ্চরক্তচাপ থাকলে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। শুগার জীবনশৈলীর নিয়ন্ত্রণে যদি না কমে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে উপযুক্ত ডোজে ইনসুলিন নিতে হবে। কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিলে, সেগুলোও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে অবশ্যই।

আরও পড়ুন-রাজীব গান্ধী হত্যা মামলা: ৬ অপরাধীকে মুক্তির নির্দেশ

৪) ডেলিভারির ছয় থেকে বারো সপ্তাহ পরে GDM রোগিণীর শুগার পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। তারপর প্রত্যেক এক বা তিন বছর অন্তর পরীক্ষা বজায় রাখা প্রয়োজন। যদি হাইশুগার ধরা পড়ে শিশুর জন্মের পর, তাহলে একে বলা হয় টাইপ টু ডায়াবেটিস। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। ভবিষ্যতে যদি শিশুর অস্বাভাবিক ওজন বাড়ে, তারও শুগার পরীক্ষা করে নিতে হবে।
যে সকল মহিলার উপরোক্ত রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর এক বা একাধিক ফ্যাক্টর আছে, তাঁদের প্রথম থেকেই জীবনশৈলী নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। উচ্চরক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, পলিসিস্টিক ওভারি, পারিবারের নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস, স্থূলতা এইগুলো থাকলে, গর্ভধারণের আগেই এগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলে বিপদের সম্ভাবনা ক মিয়ে আনা যায় অনেকটাই।

Latest article