বউ ছত্তর আঁকতে পুরো পাঁচপো
চাল ভিজিয়ে দিয়েছেন নন্দরানি। বড় উঠোনটায় আলপনা আঁকতে গেলে একসের পাঁচপো চাল না ভিজোলে চলবে না—
‘দুধে আলতার প্রকাণ্ড পাথর বসিয়ে তাকে কেন্দ্র করে আর ঘিরে ঘিরে দ্রুত হস্তে ফুল লতা শাঁখ পদ্ম এঁকে চলছেন নন্দরানী। বিয়েতে যজ্ঞের আয়োজন না করলেই নয়, দিকে দিকে লোক ছুটিয়ে দিয়েছেন, জনাইতে মনোহরার বায়না গেছে, বর্ধমানে মিহিদানার। তুষ্টু গোয়ালাকে ভার দেওয়া হয়েছে দৈ এর। আর ভীমে জেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন মাছের ব্যবস্থা করতে। কোন পুকুরে জাল ফেলবে ক মণ তোলা হবে সেই সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন রামকালী।’
সেকালের বিবাহযাত্রা
সেকালের বিয়ে মানেই এইরকম চিত্র কমবেশি সব পরিবারেই দেখা যেত। বাঙালি বিয়ে চিরকালই এক আনন্দ ঐতিহ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন।
আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুধু দুটি মানুষ নয়, দুটি পরিবার, পাড়াপড়শিও এক হয়ে যেত। সাদামাটা শাড়ি, কলাপাতা সাজানো উঠোন পরিবারের লোকজনদের আমোদ আহ্লাদ একটা একত্রিত উৎসব, যা ছিল বিয়ের প্রাণ।
বিয়ের অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান গায়ে হলুদ। একসময় বাঙালি পরিবারের গভীর সংস্কৃতির ঐতিহ্য ছিল গায়ে হলুদ। পরিবারের সদস্যরাই নন, গায়ে হলুদ যা শুধু একটি আচার নয় পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক ছিল।
মাটির ছোট পাত্রে রাখা হলুদ, একপাশে জ্বলত মাটির প্রদীপ আর কলাপাতার মঞ্চ তৈরি হত। সে এক অন্যরকমের আবহ। বিয়েতে থাকত লোকগান। ঠাকুমা-দিদিমারা গাইতেন ‘ও ছুঁড়ি তোর বিয়া লেগেছে’ অথবা ‘লীলাবালী লীলাবালী ভর যুবতী সই মোর কি দিয়া সাজাইমু তোরে’…
আরও পড়ুন-বিয়ে যখন সম্বন্ধের
সেকালে বিয়ের গান
দারুণ দারুণ সব গান। এই সমস্ত গান দিয়ে উৎসবের মেতে ওঠা সবাই মিলে যা ছিল আত্মিক আনন্দ আর পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক এবং আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আলপনা আশীর্বাদ ও পাটিপত্র
শুধু গায়ে হলুদ বা বিয়ের গানই নয়। নানারকম প্রথা ছিল সেই সময়। বাড়িতে বিয়ে লাগলেই বাড়ির মেয়ে-বউরা মিলে আলপনা দিতেন। সুন্দর সুচারু সব আলপনায় সেজে উঠত বিবাহ মণ্ডপ। আশীর্বাদেরও একটা বিরাট পর্ব থাকত সে-সময়।
ছেলের বাড়ির সমস্ত আত্মীয়-স্বজন মিলে মেয়ের বাড়ি আসত। মেয়ের বাড়িতে সাজ-সাজ রব পড়ে যেত। আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে গমগম করত বাড়ি-ঘর। কোন কোন পরিবারে আশীর্বাদের দিনই অনুষ্ঠিত হত পাটিপত্রের অনুষ্ঠান। কত সহজ সরল বিশ্বাস, কোনও আইনি সিলমোহর নয়। কেবলমাত্র দু’পক্ষের গুরুজনদের উপস্থিতিতে আশীর্বাদ ও বিশ্বাস নিয়ে একটা খাতায় টাকা ও সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে পাত্র-পাত্রীর নাম ও উভয়পক্ষের গুরুজনদের নাম, গোত্র-বিবাহের দিনক্ষণ লিখে রাখা হত। পাটিপত্রের আগের কালের কথা যদি ধরি সে সময়ে সমাজজনিত কারণে কোনও সই-সাবুদ নয়, মানুষের স্মরণ-সাক্ষ্যই ছিল দলিল। তা সেই স্মরণ সাক্ষ্যকে বিশেষ ভাবে ধরে রাখার জন্যই সেসময় তৎকালীন গ্রাম বা সমাজের মানুষজনকে একদিন ডেকে এনে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকত।
তা ছাড়া বাঁড়ুয্যেদের মেয়ে যে চাটুয্যেদের পরিবারভুক্ত হল তার স্বীকৃতিটাও তো দিতে হবে। তাই বউভাতে যোগ দিতে নতুন বউয়ের হাত দিয়ে ভাত পরিবেশন করিয়ে, জ্ঞাতি-কুটুম্বের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি নেওয়া। অনেক পরিবারে এটাকে বলে জ্ঞাতি কুটুম্বদের ঘি-ভাত দেওয়া।
সেকালের পুরোহিত বনাম ঘটক
এ-ছাড়াও আগে গ্রামে গ্রামে মূলত পুরোহিতরা বা একটা সম্প্রদায় ঘটকালির কাজ করতেন। তাঁরা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতেন। পাত্র কিংবা পাত্রীর খোঁজ-খবর থাকত তাঁদের নখদর্পণে। পাত্রপক্ষ বা পাত্রীপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী তারা জোগাড় করে দিতেন। নাপিতের ছড়া ছিল সেখানে বিয়ের একটা অপরিহার্য অঙ্গ। বিয়ের হাতবন্ধনের মালাবদল সিদ্ধান্ত এবং বিয়ের শেষে উভয় পক্ষের নাপিত বিবাহ আসরে মজার মজার ছড়া কাটত এবং শুধু মজার ছাড়াই নয়, সঙ্গে আদিরসাত্মক ছড়াও চলত। শুধু নিয়মরক্ষা নয়, বিনোদন হিসেবেও এইসব ছড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। একটা সময় পর্যন্ত বিয়ে বাড়িতে বরযাত্রীরা এলে তাঁরা সকলে থেকে যেতেন এবং খুব উপভোগ করতেন বিয়ের এই সমস্ত রীতি অনুষ্ঠান।
শুনুন শুনুন মহাশয়,
শুনুন দিয়া মন
হর পার্বতীর বিবাহকথা
বহুল বচন
আদ্য ঋষি প্রাচীন গান্ধর্ব্য মতে
শকুন্তলার বিয়ে হয়েছিল
দুষ্মন্তের সঙ্গে।
বেশ কিছু বছর আগেও বাড়িতে বিয়ে কিংবা অনুষ্ঠান হলে মাসখানেক আগে থেকেই রীতিমতো পরিকল্পনা শুরু হয়ে যেত কোথায় খাওয়ানো হবে, কোথায় ছাঁদনাতলা বাঁধা হবে, নিমন্ত্রিতদের রাত্রিবাসের জন্য কোন প্রতিবেশীকে বলা হবে, বর কার বাড়িতে বসবে, এই নিয়ে দফায় দফায় কথা চলত বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তো বটেই, পাড়া-প্রতিবেশীও বাদ যেত না সেই অন্তরঙ্গ আলোচনায়।
আরও পড়ুন-ফাইনালে আরও সমর্থন চান রশিদরা, আজ মোহনবাগানে যোগ দিচ্ছেন দিমিত্রি
সিঁদুরদান
বিয়ের সব অনুষ্ঠানের মধ্যে মূল আকর্ষণ হল সিঁদুরদান পদ্ধতি। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী সিঁদুর হল বিবাহিত মহিলার প্রতীক। মনে করা হয় যে স্ত্রীর সিঁদুর স্বামীকে যে কোনও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকেই বিয়ের সময় সিঁদুরদানের প্রচলন হয়। আর এই সিঁদুরদান প্রথা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুবিবাহ প্রথা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। একবার সিঁদুরদান হয়ে গেলে কোনও মহিলা দ্বিতীয়বার বিয়েতে রাজি হতেন না। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী সিঁদুরদান আর আগুনকে সাক্ষী রেখেই সাত পাকে বাঁধা পড়েছিলেন রাম-সীতা।
ভিয়েন বনাম ক্যাটারার
তবে ইতিহাস সব সময় পরিবর্তনের কথাই বলে। সেই পরিবর্তনের হাত ধরেই বাঙালির বিয়েতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগে ছোট করে হলেও যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়িতেই বসাতেন ভিয়েন। এখন অর্থ ক্ষমতার গৌরব আর অণু-পরিবারের কৌলীন্যে বাঙালির জীবনের এসেছে ক্যাটারার। এটা সেকালে ভাবনার অতীত ছিল! ‘যজ্ঞের জন্য ছানাবড়া ভাজা হচ্ছে, ভিয়েনের চালায় বড় বড় কাঠের অনুন জ্বেলে কারিগররা লেগে গেছে ভোর থেকে, প্রথমেই বোঁদে ভেজে স্তূপাকার করে রেখেছে কাঠের বারকোশে-বারকোশে, এখন শুরু হয়েছে ছানাবড়া। প্রচুর পরিমাণে না করলেও তো চলবে না। নিমন্ত্রিতদের পেট উপচে খাওয়ানোর পর আবার সরা ভর্তি ছাঁদা দিতে হবে তো।’
কন্যা সম্প্রদান নয়
খাওয়াদাওয়া বাদ দিলেও বিয়ের রীতিতেও নানারকম পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের যুগে এখনের মেয়েরা আর কন্যাসম্প্রদান, সিঁদুর দান এগুলো মেনে নিতে চাইছেন না। সম্প্রদানকে অত্যন্ত হীন বলে মনে করছেন তাঁরা। কারণ সম্প্রদান প্রথার মধ্যে বরের হাঁটু ধরে কন্যার বাবা কন্যাকে দান করেন।
সেই জন্য মেয়েদের বা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদেরও মনে হচ্ছে এই প্রথাটি নারীদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর।
ব্যতিক্রমী অনেক নারী সিঁদুরদানেও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বিশেষ হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, সিঁদুরদান ছাড়াও বিয়ে করা যায়। বিবাহ প্রথায় এই ব্যবস্থায় কোনও বাধা নেই, এমনটাও নব্য নারীরা করে দেখিয়েছেন। এটা অবশ্য খুবই ব্যতিক্রম। তবু পরিবর্তন হয়েই চলেছে। প্রথাগত ধারণাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন-বিগ-বি এবার ঝাঁসির ভোটার তালিকায়!
ভাবনার আমূল পরিবর্তন
এছাড়াও সেভাবে এখন যেহেতু মেয়েরা বেশিরভাগই কর্মরতা এবং কর্মসূত্রে ঘরের বাইরে দূর বিদেশেও থাকেন। তাই তাঁদের পক্ষে পাটিপত্র, আশীর্বাদ, কনে দেখা, পাকা কথা— এগুলো ভাগে ভাগে করার সময় বা ফুরসত কোনওটাই থাকে না। জেট যুগে তাঁরা হয়তো এক সপ্তাহে ছুটি নিয়ে বিয়ের আসরেই আশীর্বাদের ব্যবস্থা করে বিয়েটা সারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধুনা প্রেমজ বিয়ে, এছাড়া পরিবার থেকে দেখাশোনা করে হলেও বেশির ভাগই ফোন মারফত ফটো দেখে পাত্র-পাত্রী নির্বাচিত করেন। সময়-সুযোগমতো তাঁরা দেখা-সাক্ষাৎ করেন।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা সুনিপুণ দক্ষতায় গোটা বিয়ের আয়োজন করে। খাওয়া দাওয়ার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে কন্টিনেন্টাল থেকে দেশি— সবকিছুতেই একটা প্রতিযোগিতা চলে। দেখনদারির প্রতিযোগিতা চলে যে, কার বিয়ে কত উন্নত ও আধুনিক হতে পারে। সে কার্ড, বিয়ের আসর থেকে শুরু করে একেবারে কন্যা বিদায় অবধি।
আর এই গতির যুগে কোনও কিছুই অধরা নয়। সশরীরে উপস্থিত না থেকেও হয় পাত্র-পাত্রী দু’জনেই বাইরে চাকরি করেন তাই সবটাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সারা যায়।
আরও একটা কথা, যেটা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটা হল, এখন শুধু কন্যারা যে বিদায় নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায় তেমনটা নয়। কারণ বেশিরভাগ ছেলেরা বা পাত্ররাই কর্মসূত্রে রাজ্য বা দেশের বাইরে থাকেন। তো তাঁরাও তো মায়ের কাছে আর থাকছেন না। তাঁরাও তো বাইরে চলে যাচ্ছেন। এবং অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় ছেলেটি হয়তো কলকাতা নিবাসী। বাবা-মা যেখানে থাকেন সেখানে আছেন। কিন্তু কন্যার অর্থাৎ পাত্রীর কর্মক্ষেত্র বাইরে। সুতরাং পাত্র স্ব-ইচ্ছে এবং সানন্দে বাইরে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছেন পাত্রীর কর্মস্থলে। এমন আধুনিকতাও কিন্তু এখন দেখা যায়। এবং পরিবারের লোকেরা কিন্তু মেনে নিচ্ছে বিনা দ্বিধায়।
তাই এখন যে শুধুমাত্র মেয়েরাই শ্বশুরবাড়ি যায় এমন বস্তাপচা ধারণার বদল ঘটেছে এমন কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। মাঘ মাসে শীতের পিঠে পুলির সুবাসের সঙ্গে বাতাসে ভাসে সানাইয়ের সুর। তবে এখন শুধু যে তথাকথিত বিয়ের মাসেই বিয়ে হয় সেই একপেশে ধারণারও বদল ঘটেছে। এখন অনেক আধুনিক ও নব্য প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের কর্মক্ষেত্র, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা দেখে যেকোনও মাসেই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। সেকালের বিয়ে এবং একালের বিয়ের মধ্যে বিস্তার ফারাক ঘটেছে এবং ঘটবে।
মহিলা পুরোহিত
পুরোহিতের ক্ষেত্রেও ঘটেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। আগে আমরা জানতাম বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন বা যেকোনও শুভকাজে পুজো-পাঠে কেবলমাত্র পুরুষরাই অংশগ্রহণ করবেন। মহিলাদের সেই অধিকার একেবারেই ছিল না। বলা ভাল মহিলাদের এই পেশায় কোনও সময়ই দেখা যেত না।
কিন্তু বহু মহিলা পুরোহিত বিবাহ আসরে বসে স্ব-সম্মানে স্ব-মর্যাদায় বিয়ে দিচ্ছেন। আবহমান কালের এই ধ্যান-ধারণার ইতি ঘটেছে একালে। তাঁদের মতে, বৈদিক যুগে ঋষিদের সঙ্গে ঋষিকারাও পুজো করতেন। যজ্ঞের কাজও করতেন। বিয়ের বৈদিক মন্ত্রগুলো সূর্যা নামে এক নারীর রচনা। তাই এতে নারীর অধিকার নেই, এ কথা ঠিক নয়।
বৈদিক বিয়ের এই প্রথায় কন্যা সম্প্রদান হয় না। এছাড়া লজ্জাবস্ত্র, পানপাতা দিয়ে মুখ ঢাকা, গাঁটছড়া— এই নিয়মগুলো বিয়েতে পালন করা হয় না। এই সময়ের মহিলা পুরোহিতেরা সুন্দর বৈদিক মন্ত্র এবং রবীন্দ্রগানের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান পালন করেন। এবং সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলায় প্রতিটি মন্ত্রের ব্যাখ্যা থাকে যাতে পাত্র-পাত্রী বিয়ের বিষয়টা অনুধাবন করতে পারে, অন্তরে নিতে পারে। ঐতিহ্যবাহী পুরনো রীতিনীতির বদলে আধুনিক ও প্রগতিশীল ব্যবস্থাপনা কালের হিসেবেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

