শিশুসাহিত্যচর্চায় উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে ঠাকুর এবং রায়চৌধুরী পরিবারের। এই দুই পরিবারের প্রায় সকলেই ছোটদের জন্য কলম ধরেছেন। দুটি পরিবার থেকেই প্রকাশিত হয়েছে শিশুসাহিত্যের পত্রিকা। তবে ঠাকুর পরিবার এবং রায়চৌধুরী পরিবারের ঘেরাটোপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বাংলা ভাষার ছোটদের সাহিত্য। দিনে দিনে হয়েছে বিস্তৃত। প্রাণময়তায় প্রসারিত। আবির্ভাব ঘটেছে বহু কৃতী লেখকের। তাঁদের অনেকেই আজ বিস্মৃতপ্রায়। নানা কারণে থেকে গেছেন পাঠকের অগোচরে।
সম্প্রতি শিশুসাহিত্যের এক বর্ণময় অধ্যায় গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে। তিনি অসামান্য দক্ষতায় বিভিন্ন লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিশুসাহিত্যের প্রবহমানতা, গতি-প্রকৃতি। রচনা করেছেন ‘শিশুসাহিত্যের সোনালি অধ্যায়’। হাতে এসেছে বইটি। স্মরণীয়-অবিস্মরণীয় নানাজনের কথা রয়েছে এই বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধে। সেইসঙ্গে তাঁদের আশ্চর্য সৃষ্টি সম্ভারের বিচার-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন। কী কী রয়েছে পাতায় পাতায়?
আরও পড়ুন-পাশে বজরং-সাক্ষী-সহ অনেকেই, বিমানবন্দরে মানুষের ঢল
বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার আগে কিছু উপন্যাস জাতীয় রচনার চেষ্টা হয়েছে। সবই বড়দের কথা ভেবে। ছোটদের কথা ভেবে প্রথম মৌলিক উপন্যাস লেখেন প্রমদাচরণ সেন। নিজের সম্পাদিত ‘সখা’ পত্রিকায়। ধারাবাহিকভাবে। উপন্যাসের নাম ‘ভীমের কপাল’। এই উপন্যাস এবং তার লেখকের উপর চমৎকার একটি প্রবন্ধ রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে।
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন অসাধারণ এক কবি। তিনি রাখতেন ছোটদের মনের খবর। বর্তমানে তাঁর পরিচিতি মূলত পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ তিনি পেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা। তাঁকে নিয়ে রয়েছে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ।
‘সহজ হয়েও সহজ-পাঠ নয়’ একটি মূল্যবান রচনা। আলোচনা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যের উপর। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটদের সাহিত্যও তরল সহজপাচ্য নয়। গভীর অনুভবের, প্রগাঢ় উপলব্ধির। তাঁর ছোটদের লেখাতেও মনন-বৈদগ্ধ্যের ঘাটতি নেই।’
প্রমদাচরণ সেনের কাছে সম্পাদনার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। নিজে লেখার পাশাপাশি অন্যদের দিয়ে লিখিয়েছেন। পরিবার পরিজনকে করে তুলেছেন সাহিত্যমুখী। জানা যায় বইয়ের ‘বহুমুখী উপেন্দ্রকিশোর’ রচনাটি পড়ে।
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কিছু লেখার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটেছে। তার বাইরে থেকে গেছে বিপুল অংশ। ‘হাসিখুশি’র স্রষ্টাকে নিয়ে ‘অনালোকিত যোগীন্দ্রনাথ’ উপহার দিয়েছেন প্রাবন্ধিক।
ছবিতে যেমন বড়, তেমনি লেখাতেও। আঁকিয়ে অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে লিখিয়ে অবনীন্দ্রনাথের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিশ্লেষণ করা হয়েছে একটি প্রবন্ধে।
স্বল্পায়ু ছিলেন সুকুমার রায়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শুধুমাত্র ছড়া নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর ছড়ার উপর আলোচনা করা হয়েছে ‘সুকুমারের ছড়া : বৈচিত্র্যে অনন্য’ রচনায়। বলা হয়েছে, ‘সুকুমার রায়ের ছড়ায় হাস্যরসের আড়ালে গম্ভীর বক্তব্যের চোরাস্রোত, সমাজসচেতনতা প্রায়শই নজর পড়ে।’ প্রাবন্ধিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। সুকুমার রায়ের মণ্ডা ক্লাব নিয়েও রয়েছে একটি মূল্যবান লেখা।
আরও পড়ুন-আরজি কর ভাঙচুর-কাণ্ড: তলব মীনাক্ষী-সহ ৭ বাম ছাত্র-যুব নেতাকে
নরেন্দ্রবালা দেবী ছিলেন বাংলা ভাষায় ছোটদের প্রথম বিজ্ঞান লেখিকা। তাঁকে নিয়ে রয়েছে একটি অনবদ্য প্রবন্ধ। গোয়েন্দা সাহিত্যে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অবদান সম্পর্কেও একটি লেখায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।
বিদ্রোহী কবি হিসেবেই পরিচিতি কাজী নজরুল ইসলামের। শিশুসাহিত্যে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এই বিষয়ে রয়েছে একটি লেখা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতি মূলত ব্যোমকেশ-কেন্দ্রিক। তার বাইরেও তিনি ছোটদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন। সেগুলো যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানের। সমাজের আলো-অন্ধকার সবই তিনি ছোটদের সামনে মেলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁকে নিয়ে রয়েছে একটি অনবদ্য রচনা।
এছাড়াও বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে সুনির্মল বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, সত্যজিৎ রায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের ছোটদের জন্য সাহিত্যকর্ম। আছে আরও কয়েকটি প্রবন্ধ। বিশেষ রচনা, পত্রিকা, প্রকাশন সংস্থার উপর আলোচনা। সবমিলিয়ে ‘শিশুসাহিত্যের সোনালি অধ্যায়’ গুরুত্ব সহকারে উন্মোচিত হয়েছে পাঠকের সামনে। সমস্তকিছু যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা নয়, তবে যতটুকু হয়েছে, কম নয় সেটাও। হয়তো আগামী দিনে এর বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হবে। অথবা দ্বিতীয় ভাগ। সেই দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেইসঙ্গে লেখককে ভরিয়ে দিলাম অকুণ্ঠ প্রশংসায়। সাহিত্যলোক প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদশিল্পী কৃষ্ণেন্দু চাকী। দাম ৩০০ টাকা।