বর্ষার অসুখ বিসুখ

বর্ষার (Monsoon) আবহাওয়া মানেই অনেক রোগের বাড়বাড়ন্ত । সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, ডায়ারিয়া, জন্ডিস— কত কী! বর্ষাকালের বিভিন্ন অসুখবিসুখ নিয়ে আলোচনায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অরুণাংশু তালুকদার। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রোগ কখনও এমনি হয় না। রোগের বাহক হয় ভাইরাস না-হয় ব্যাকটেরিয়া আর না-হয় পতঙ্গবাহিত। পতঙ্গ অর্থাৎ মশা-মাছি ইত্যাদি থেকে হয়। আর বর্ষাকাল হল এই প্রতিটা কারণের জন্য আদর্শ সময় যাকে বলে। মূলত গ্রীষ্ম এবং বর্ষায় রোগের প্রকোপ বাড়ে। বর্ষায় ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। প্রত্যেকেই বংশবিস্তার করে আর এমনটা করে বলেই আমাদের শরীর আক্রান্ত হয়। তাই তুলনামূলকভাবে দেখা যায় শীতে রোগের প্রকোপ কম হয়।
বর্ষার রোগবাদ্যি
বর্ষায় মশাবাহিত রোগ মানেই ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গি। এরপর যে রোগটি খুব হয় সেটা সর্দিগর্মি জ্বর। এটাকে আমরা বলি ইনফ্লুয়েঞ্জা আবার কেউ কেউ বলেন ভাইরাল ফিভার। আবহাওয়ার তারতম্যে কখনও প্রবল গরম, ঘাম, কখনও ঠান্ডা অর্থাৎ সর্দিগর্মি থেকে যেটা হয়। এরপরেই বর্ষায় যে রোগটা হয় সেটা জলবাহিত রোগ। বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে অনেক সময় নোংরা জল ভাল জলের সঙ্গে মিশে যায় বা ম্যানহোল খুলে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। জলের থেকে দেখা দেয় ডায়ারিয়া, ডিসেন্ট্রি এবং হেপাটাইটিস। বর্ষাকাল এবং বর্ষা এই ভ্যাপসা গরমের সন্ধিক্ষণ পর্বে এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। কাজেই রোগ হলে চিকিৎসা তো করতেই হবে কিন্তু এর জন্য জরুরি উপসর্গ বুঝে আগাম সতর্কতা।

আরও পড়ুন-গেরুয়া রাজ্যেই সম্ভব! ট্রেন চালানোর আবদার মদ্যপের, বিপাকে যাত্রীরা

উপসর্গ
ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি দুটোই মশার কামড় থেকে হয়। বর্ষায় যার প্রকোপ অনেকটা বাড়ে। ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে যে উপসর্গগুলো থাকে সেগুলো হল খুব কাঁপুনি দিয়ে জ্বর তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে যায়। দিনে একবার বা দুবার জ্বর আসতে পারে।
ডেঙ্গির জ্বর খুব বেশি হয়, উচ্চমাত্রার, সারাদিন জ্বর থাকে। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হয় এবং গা-হাত-পায়ে এতটাই যন্ত্রণা হয় যে মনে হবে কেউ খুব জোরে পিটিয়েছে। এর সঙ্গে গায়ে লাল লাল রক্তের ছোপের মতো হয়। রক্ত ভিতরে ভিতরে বেরতে পারে। এটা সবার ক্ষেত্রে না হলেও কমবেশি হয়। বেঁহুশ হয়ে যেতে পারে। বেঁহুশ হয়ে যাওয়াটা ডেঙ্গির খুব সিভিয়র স্টেজে হয়।
ভাইরাল জ্বরের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে জ্বর আসে, খুব শীত করে, সর্দি-কাশি, গলায় প্রচণ্ড ব্যথা, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হওয়া, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক ধরনের ভাইরাস থেকে এই জ্বরটা আসতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, রোটা ভাইরাস, কোভিড ভাইরাস সব ভাইরাসের ক্ষেত্রেই নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি, চোখ চুলকানো, গলা ধরে যাওয়া— এগুলো তিন থেকে চারদিন চলতেই থাকে এবং এটা খুব সংক্রামক। অর্থাৎ একজনের থেকে আর একজনে ছড়ায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে পাশে যে রয়েছে তার হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
জলবাহিত রোগ অর্থাৎ দূষিত জল যদি কোনওভাবে পানীয় জলের সঙ্গে মিশে যায় তখন যে ধরনের রোগ হয় যেমন— ডায়ারিয়া, ডিসেন্ট্রি, জন্ডিস অর্থাৎ হেপাটাইটিস এ, ই। ডায়ারিয়ার লক্ষণ হল হঠাৎ অল্প জ্বর, পেটে ব্যথা, বারবার মলত্যাগ, বমি-বমি ভাব বা বমি-হওয়া।
ডিসেন্ট্রির ক্ষেত্রে পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা প্রচণ্ড বেশি হয় এবং মলের সঙ্গে রক্ত বেরয়। ক্র্যাম্প ধরে থাকে। আমাশার মতো একটা লক্ষণ থাকবে, মলের বেগ আসবে কিন্তু সবসময় হবে না।
জন্ডিসের লক্ষণ হল প্রথমদিকে একটু গা-হাত-পা ব্যথা হয়, জ্বর-জ্বর ভাব, তারপর চোখটা হলদেটে দেখায়, বমি-বমি ভাব, পেটে হালকা ব্যথা, ইউরিন হলুদ হয়, ভীষণ দুর্বলতা, খাবারে খুব অরুচি।

আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে এটাই আসল চিত্র

সতর্কতা
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির ক্ষেত্রে রাতে মশারি টাঙিয়ে শোওয়া উচিত। বাড়ির আশপাশে বিশেষ করে বর্ষাকালে জল জমতে না দেওয়া। বাড়ির ভিতরেও একভাবে রাখা রয়েছে এমন জমা জল ফেলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। মাঝে মাঝে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করতে হবে। তবেই মশা বংশবিস্তার করতে পারবে না।
ভাইরাল জ্বরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সতর্কতা হল মুখে মাস্ক পরে থাকা। যার হয়েছে সেও পরবে আর যার হয়নি অথচ তিনি সেই ভাইরাল জ্বরের রোগীর আশপাশেই রয়েছেন তাঁকেও মাস্ক পরতে হবে। ছোট বাচ্চা হোক বা বয়স্ক মানুষ, দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে বা ডায়াবেটিসের রোগী তাঁদের সতর্ক থাকতে হবে ভীষণ রকম। বাড়িতে বড়দের হলে বাচ্চাদের দূরে রাখতে হবে। ছোটদের হলে তাদের স্কুলে না পাঠানোই ভাল কারণ স্কুলে অন্য শিশুদের মধ্যে দ্রুত সংক্রমণ হবে। বাইরে বেরলে ফুলহাতা বা গা-ঢাকা জামা পরে বেরনো উচিত। ছোটদের বিকেলে খেলার মাঠে নিয়ে গেলে গা-ঢাকা জামাকাপড় পরানো দরকার। সজাগ থাকুন।
জলবাহিত রোগের ক্ষেত্রে জল একমাত্র দায়ী তাই যে জল বাড়িতে খাচ্ছেন তা বিশুদ্ধতার মাপকাঠি মেনে খান যদি না পারেন জল ফুটিয়ে খান বিশেষ করে বর্ষাকালে। রান্না, খাওয়াদাওয়া করার আগে হাত খুব ভাল করে ধুয়ে নিন। বাইরে থেকে ফিরে হাত ধোয়া অভ্যেস করা খুব জরুরি।
বাড়ির খাবার এবং রান্নার জলে সরাসরি হাত না ছোঁয়ানোই ভাল। বাইরে যেখানে-সেখানে জল না খেয়ে সঙ্গে জলের বোতল নিয়ে বেরবেন। কোনও খাবার খাওয়ার আগে ভাল করে হাত ধুয়ে খান। ওয়াটার পিউরিফায়ার থাকলে তার ফিল্টার সময় সময় চেক করে নেওয়া জরুরি কারণ, ওর মধ্যে থেকেও ভাইরাস আসতে পারে। যদি জ্বরজারি বা পেটখারাপের বাড়াবাড়ি হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ সঠিক সময় চিকিৎসা না হলে সিভিয়ার হয়ে যেতে পারে।

Latest article