পৃথিবী যে পথে সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সেটা একেবারে বৃত্তাকার বা গোলাকার পথ নয়, সে-পথ অনেকটা ডিমের মতো, ওই পথের বিশেষ নাম রয়েছে, উপবৃত্তাকার পথ। ওর নির্দিষ্ট কোনও কেন্দ্র নেই, বদলে রয়েছে দুটো কেন্দ্র। সে দুটোর নাম নাভি, ইংরেজিতে ‘ফোকাস’। সূর্য থাকে ওইরকম একটা নাভি-তে, আর পৃথিবী ঘুরে চলে উপবৃত্তাকার পথে। তাই পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সবসময় সমান থাকে না। এখন আমরা পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বলতে যে মাপের কথা বলি, সেটা বিভিন্ন দূরত্বের একটা গড় মাপ। সেই মাপটা হল প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবে জানা গিয়েছে এই দূরত্বের মাপ।
আরও পড়ুন-দিনভর উৎসব, সমর্থক-কর্তা-ফুটবলারের মেলবন্ধন তাঁবুতে
লম্বন পদ্ধতি
প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকেরা প্রথম সূর্য বা চাঁদের মতো বড় মাপের উজ্জ্বল মহাজাগতিক বস্তুদের দূরত্ব মাপবার চেষ্টা চালিয়েছিল। এঁদেরই একজন, হিপারকাস, খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় দুশো বছর আগে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে (এর নাম ‘লম্বন পদ্ধতি’, ইংরেজিতে ‘প্যারালাক্স মেথড’) চাঁদের দূরত্ব প্রথম মেপেছিলেন। তাঁর দেখানো পদ্ধতি মেনেই আর এক দার্শনিক অ্যারিস্টারকাস সূর্যের দূরত্ব মাপার চেষ্টা শুরু করেন। খেয়াল রাখা দরকার, তখন দূরবিনের মতো কোনও যন্ত্রই আবিষ্কৃত হয়নি, তাঁদের যা-কিছু কাজ, সবই ছিল খালি চোখে দেখে, আর নানারকম হিসেব কষে। কিন্তু তাঁর মাপ মোটেই এখনকার মাপের ধারে-কাছেও আসেনি। ফলে তাঁর চেষ্টায় ফল মেলেনি। ওই ঘটনার পরবর্তী প্রায় আঠারোশো বছরেও এই মাপ আর কেউই ঠিকঠাক মেপে বের করতে পারেননি।
পৃথিবী থেকে শুক্রের দূরত্ব
তবে আঠারোর দশকে মানুষ আগেকার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলবার ফলে। তখন জোহানেস কেপলার বা আইজ্যাক নিউটন আসরে নেমে গিয়েছেন, তাঁরা গ্রহদের ঘুরবার পথ সংক্রান্ত নানা নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, গ্যালিলিও আবিষ্কার করেছেন গ্রহের উপগ্রহ নিয়ে নানা তথ্য। নিউটনেরই সমসাময়িক এক বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস-ও অ্যারিস্টারকাস-এর দেখানো পথ অনুসরণ করে পৃথিবী আর সূর্যের দূরত্ব মেপেছিলেন ১৬৫৩ সালে। এরকমই একটা গ্রহ হল শুক্র, সূর্য থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধের পরেই এর অবস্থান। এই গ্রহ সূর্যের সামনে দিয়ে যখন যায়, তখন সূর্যের গায়ে একটা অন্ধকার কালো ছোট্ট ফুটকির মতো জিনিসকে সরে যেতে দেখা যায়। ওটাকেই বলে শুক্রের চলন, বা ‘ট্রানজিট অভ ভেনাস’। এই ঘটনাটাকেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখলে কিছুটা অন্যরকম লাগে, কখনও সে সূর্যের একদম মাঝ-বরাবর বড় পথ অতিক্রম করে, কখনও ওপরের দিকে বা নিচের দিকের অপেক্ষাকৃত ছোট পথ বরাবর যায়। আর সেই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়েই জেমস গ্রেগরি আর এডমন্ড হ্যালি নামে দুই জ্যোতির্বিদ হিসেব করে ফেলেন পৃথিবী থেকে শুক্রের দূরত্ব। আর সেই দূরত্বের মাপ কাজে লাগিয়ে বের করা সম্ভব হয় সূর্যের দূরত্বও। কাজটা বলতে যতটা সহজ, করবার বেলা মোটেই অতটা সহজ ছিল না। কারণ শুক্রের এই চলন ব্যাপারটা ঘটে খুবই কম, একজন মানুষের গোটা জীবনে হয়তো একবারই (আসলে দু’বার কারণ প্রতিবার শুক্র-চলন ব্যাপারটা ঘটে আট বছর অন্তর দু’বার, মানে একবার দেখতে না পেলেও আর একটা সুযোগ মেলে) দেখবার সৌভাগ্য হয়।
আরও পড়ুন-জ্বলল অমরজ্যোতি
পৃথিবী থেকে সূর্য
এই চলন ব্যাপারটা ঘটবার সময় পৃথিবীর বুকে খুব দূরের দুটো জায়গায় গিয়ে পরীক্ষাটা করতে পারলে চলনের পার্থক্য মাপাটা বেশি ভাল হয়। আর একাধিক জায়গায় দক্ষ মানুষকে পাঠানো দরকার, কারণ কোনও একটা জায়গায় ওইদিন ওই বিশেষ সময়ে আকাশ মেঘলা থাকলে সব মাটি হতে পারে। হ্যালি সাহেবরা এই কারণে পৃথিবীর নানা স্থানে একাধিক দলবল পাঠিয়েছিলেন, যাতে কোনওভাবেই ঘটনাটা মিস না হয়। অবশেষে সব বাধা জয় করে, ১৭৬১ সাল আর ১৭৬৯ সালের দুটো চলন থেকে (হ্যাঁ, শুধু ওই ১৭৬১ সালেই নয়, ওর আরও আট বছর পরেও একটা শুক্র-চলন ঘটেছিল, সেবারেও জোগাড় করা হয়েছিল আরও কিছু তথ্য) যতগুলো সম্ভব বেশি জায়গা থেকে জোগাড় করা তথ্য একত্রিত করেন হ্যালি আর তাঁর সহকারীরা, সেই সঙ্গে ছিলেন এক ফরাসি বিজ্ঞানী জেরোম লালান্ডে-ও, মিলেমিশে বের করে ফেললেন পৃথিবী আর সূর্যের দূরত্ব, সেই মাপ আজকের দিনের জানা মাপের একদম কাছাকাছি! তবে আজকের দিনে অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, রেডার-এর সাহায্যে তরঙ্গ সিগন্যাল পাঠিয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবেই দূরত্ব মেপে ফেলা যায়।
আরও পড়ুন-কেজরির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল সিবিআইয়ের
আলোকবর্ষের একক
পৃথিবী থেকে খুব দূরের কোনও মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব এমনিতে মাপা হয় ‘আলোকবর্ষ’ এককে। এই এককের হিসেব কষা খুব সহজ, আলো একটা গোটা বছরে যে দূরত্ব যায় সেটাই এক আলোকবর্ষ। এই আলোকবর্ষের চেয়েও আরও একটা বড় মাপের একককে কাজে লাগানো হয় অনেক দূরের বস্তুদের মধ্যেকার দূরত্ব মাপার সময়, সেটার নাম ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট’, বা সংক্ষেপে AU। আর এটাই হল পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের ওই গড় মাপ। মানে এই দূরত্ব যা, সেটাকেই এক AU ধরে নিয়ে অন্য তারাদের মধ্যের দূরত্বকে এই একক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যদি দুটো তারার মধ্যের দূরত্বকে লেখা হয় ২.৫ AU, এর অর্থ হল ওই দুটো তারার মধ্যের দূরত্ব হল পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব, সেটার আড়াই গুণ। ঠিকঠাকভাবে বললে এক AU-এর মাপ হল ১৪৯,৫৯৭,৮৭১ কিলোমিটার, যাকে সংক্ষেপে প্রায় দেড় কোটি কিলোমিটার বলে ভাবা যায়। এই দূরত্ব যেতে আলো সময় নেয় আট মিনিট কুড়ি সেকেন্ড, হিসেবটা খুব সহজেই করে দেখে নেওয়া যেতে পারে। আর তাই AU আর আলোকবর্ষের সম্পর্ক হল ১ AU = ৮.৩ আলোক-মিনিট। খুব ছোট্ট কোনও তথ্য জানবার জন্যেও বিজ্ঞানীরা কত কষ্ট করেন, হ্যালি-দের ওই পরীক্ষার ঘটনা সেরকম একটা উদাহরণ।