অতিরিক্ত ঘাম কমাতে

গরমে ঘাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার কি অতিরিক্ত ঘাম হয়? পাখার তলায় বসেও ঘামেন? এমনকী এসি-তেও! তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মাত্রাতিরিক্ত ঘাম ভাল নয়। কেন বেশি হয় ঘাম? এটা কি কোনও অসুখ? এর থেকে মুক্তির উপায় কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গ্রীষ্মকালে ঘাম তো হবেই কিন্তু অতিরিক্ত ঘাম বড় কোনও রোগের লক্ষণ হতে পারে। আবার কোনও কারণ ছাড়াই আপনি পাখার তলায় বসেও ঘামেন, আবার এসিতেও? শরীরের কোনও নির্দিষ্ট জায়গা যেমন আন্ডার আর্ম, হাত বা পায়ের তালুতে অতিরিক্ত ঘাম (Sweat) হয়। হাতে পেন-পেনসিল কিছুই ধরতে পারেন না। এই সমস্যাকে হাইপারহাইড্রোসিস বলে। তবে এই রোগ ছাড়াও অনেকেই নানা কারণেও বেশি ঘামেন।

যাঁরা বেশি ঘামেন
অতিরিক্ত ঘাম হলে শরীরের জল ও নুন বেরিয়ে যায়। ফলে তাপমাত্রা নেমে যায়। রক্তে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হয়। এতে খুব দুর্বল লাগে, মাথা ঘুরতে পারে, অনেক সময় ব্যক্তি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
হার্টের সমস্যা, থাইরয়েড, ব্রেন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, মেনোপজ, জ্বর, নার্ভাসনেস থেকেও অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
ওবেসিটি বা শরীরের ওজন বেশি হলে কারণে-অকারণে খুব ঘাম হয়।
যাঁরা খুব মাছ, মাংস, তৈলাক্ত, রিচ খাবারদাবার খেয়ে অভ্যস্ত বা প্রচুর খেয়ে ফেলেন তাঁদের খুব ঘাম হয়।

আরও পড়ুন: মোদির প্রতি বিদ্রুপের তির কল্যাণের, দেড় বছরেই সাফ হবে এনডিএ

হাইপারহাইড্রোসিসের কারণ
হাইপারহাইড্রোসিসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি প্রাইমারি অপরটি সেকেন্ডারি।
সাধারণত প্রাইমারি হাইপার হাইড্রোসিস হওয়ার পিছনে পরিবার বা বংশগত কারণ থাকতে পারে। আবার সরাসরি কোনও কারণ নাও থাকতে পারে।
সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস অনেক সময় অত্যধিক সক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের কারণে হতে পারে। কারণ স্নায়ুতন্ত্রই আমাদের ঘর্মগ্রন্থিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা বেশি সক্রিয় হলেই ঘাম বাড়তে থাকে।
অতিরিক্ত থাইরয়েড, অটোইমিউন ডিজর্ডার, মেনোপজ থেকেও সেকেন্ডারি হাইপার হাইড্রোসিস হয়। তবে সবটাই পরীক্ষাসাপেক্ষ কারণ বেশি ঘামছেন মানেই হাইপারহাইড্রোসিস এমনটা নয়।
মানসিক চাপ এবং ভীষণ উদ্বেগ হাইপারহাইড্রোসিসকে ট্রিগার করে।
হাইপারহাইড্রোসিস রয়েছে এমন ব্যক্তি যদি ওবেসিটির শিকার হন তবে আরও বিপদ। ঘাম অনেকটাই বেশি নিঃসরণ হবে এক্ষেত্রে।
মেনোপজের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। কারণ এমনিতেই কোনও মহিলার মেনোপজের পরে ঘাম নিঃসরণ বেড়ে যায় কারণ হট ফ্লাশ হয়। হাইপারহাইড্রোসিস থাকলে তাঁর আরও বিপদ।
কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ভীষণ ঘাম বেড়ে যায়। অ্যান্টি ডিপ্রেশন্ট, অ্যান্টিকোলিনার্জিকস ড্রাগসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সেকেন্ডারি হাইপারড্রোসিসের ঝুঁকি বাড়ে।
কিছু ধরনের ক্যানসার, ডায়াবেটিস, রক্তে কম শর্করা অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া থাকলেও হাইপারহাইড্রোসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

হাইপারহাইড্রোসিসের জটিলতা
অতিরিক্ত ঘামতে (Sweat) থাকা ব্যক্তি ভিড়ভাট্টা বা অন্য সামাজিক ক্ষেত্রে বিব্রত বোধ করেন।
পাখার তলাতে বসলেও ঘাম হচ্ছে। এসির মধ্যে বসেও ঘামতে থাকেন। পোশাক ভিজে যায়। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি কাজ করে।
অতিরিক্ত ঘামের ফলে ব্যাকটেরিয়াল এবং ত্বকের সংক্রমণ হতে পারে।
যখন ব্যাকটেরিয়া ঘামের সংস্পর্শে আসে তখন শরীর থেকে একটি দুর্গন্ধ বেরয়, একে বলে ব্রোমহাইড্রোসিস। এটি প্রাথমিকভাবে বগলে, যৌনাঙ্গে, আঙুলের ফাঁকে এবং পায়ে হয়।
অত্যধিক ঘামের কারণে দৈনন্দিন কাজগুলি করাও কঠিন হতে পারে, যেমন একটি স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখা, হাত নাড়ানো, পেন্সিল বা পেন ধরে রাখা।
ক্রমাগত ভিজে ভাব থাকার জন্য পায়ে ছত্রাকের সংক্রমণ হয় যাকে বলে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন।
হাইপারহাইড্রোসিসের চিকিৎসা
ঘাম সারাদিনে কতটা পরিমাণে ইত্যাদি মেডিক্যাল হিস্ট্রি জেনে কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসক কারণ নির্ণয় করেন।
ব্লাড এবং ইউরিন টেস্ট ছাড়াও ঘামের পরীক্ষা যেমন আয়োডিন স্টার্চ টেস্ট, থার্মোরেগুলেটরি সোয়েড টেস্ট এবং স্কিন কনডাকট্যান্স টেস্ট ইত্যাদি কিছু টেস্ট করা হয়।
বড় কোনও শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়েছে কি না সেটা দেখা খুব জরুরি সেই কারণে সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই দুটোই করতে বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
হাইপোহাইড্রোসিসের ক্ষেত্রে বোটক্স ইঞ্জেকশন বা সার্জারি কার্যকরী চিকিৎসা। ঘর্মগ্রন্থি অপসারণ করতে সাকশন পদ্ধতি রয়েছে। সার্জারি করে অতিরিক্ত ঘাম উৎপাদনকারী স্নায়ুর বিশেষ অংশ কেটে ফেলে দেওয়া হয়। তবে এই পদ্ধতিটি তেমন সুবিধার নয়। কারণ অপারেশনের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত এবং অপারেশন-পরবর্তী ওষুধে যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের জীবনের ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়া মেডিকেশনের মাধ্যমেও চিকিৎসা হয়।

অতিরিক্ত ঘাম কমাতে
অনেকে এমনিতেই বেশিই ঘামেন (Sweat)। সেজেগুজে বেরিয়ে ঘেমে-নেয়ে একসা। মেক-আপ ঘেঁটে ঘ, হাঁটতে গিয়ে ঘাম, সিঁড়ি ভাঙতে ঘাম, ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দরদরিয়ে ঘাম— অনেক সময় শারীরিক দুর্বলতা থেকে ঘাম হয়। তাই পুষ্টিকর খাবার খান। শাকসবজি, ফল খান নিয়মিত।
আয়োডিনযুক্ত খাবার বেশি খাবেন না যেমন— এসপারাগাস, ব্রকোলি, টার্কি, মাংস, যকৃৎ, সাদা পেঁয়াজ, খাবার নুন ইত্যাদি খেলে ঘাম বেড়ে যায়।
চা-তে রয়েছে ট্যানিন যা প্রাকৃতিক ঘাম-বিরোধী ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাই দেড় লিটার জলের মধ্যে পাঁচটি টি-ব্যাগ মিশিয়ে তার মধ্যে ১০-১৫ মিনিট হাত-পা ভিজিয়ে রাখুন। তাছাড়া সবুজ চা পান করুন। এতে উপকার পাবেন।
পাউডার জাতীয় জিনিস মাখবেন না এতে ঘাম নিঃসরণ অনেকটা বেড়ে যায়। রোমকূপ বন্ধ হয়ে ঘামাচিও হতে পারে।
ভিটামিন বি-১২-এর অভাবে হাইপারহাইড্রোসিস হয়। তাই ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খান। যেমন কলা, ডিম, দুধ, গাজর, টম্যাটো, সবুজ শাক, মাছ, কাঠবাদাম ইত্যাদি।
ভিটামিন বি-ফ্যামিলির সদস্য যেমন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫-যুক্ত খাবার খান। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন বি ট্যাবলেট খান।
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন কফি, ধূমপান ইত্যাদি যত কম ঘামও ততই কম। ক্যাফেইন আর তামাক ঘাম নিঃসরণ বাড়ায়।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খান। বারবার মুখ-হাত-পা ধুয়ে ফেলুন। ত্বক শুকনো রাখুন।
অতিরিক্ত ঘাম (Sweat) থেকে রক্ষা পেতে সাময়িক উপশমকারী ড্রাইসল বা অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাড্রেট অ্যালকোহলিক সলিউশনজাতীয় (ড্রাইসল) ওষুধ কার্যকর।

Latest article