চিকিৎসক পিঁপড়েরা

তাঁরা কোনও ডিগ্রিধারী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক নন তবুও শারীরবিজ্ঞানে তাঁদের জ্ঞানের নাড়ি টনটনে। করতে পারে চিকিৎসা এমনকী শল্য চিকিৎসাও। এনারা হলেন পিঁপড়ে! আজ এঁদের এই গুণপনার আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

শল্যচিকিৎসায় পারদর্শী পিঁপড়ে
ঘরের আনাচে-কানাচে প্রায়শই দেখা মেলে তাদের, কখনও খাবারের টুকরোর খোঁজে আবার কখনও খাবারের টুকরো বয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে সারিবদ্ধভাবে যাতায়াত করে তারা। তাদের ওই যাত্রাপথের রেখা দেখা যায় মূলত রান্নাঘরে, ভাঁড়ার ঘরের কোনায়। এতক্ষণে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আমি কাকে নিয়ে কথা বলতে চলেছি— পিঁপড়ে, খুদে এই জীবটি যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তাকে খুদে বলিয়া একদমই অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। কারণ হল এদের শল্যচিকিৎসার গুণ। শুধু মানুষ নয়, শল্যচিকিৎসায় পিছিয়ে নেই এই খুদেগুলোও।

আরও পড়ুন-সিবিআই তদন্ত খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট

প্রলেপ চিকিৎসায় খুদেরা
গত ১১ বছর ধরে পিঁপড়ের গতিপ্রকৃতি ও আচরণ অধ্যয়ন করার সময়, জীববিজ্ঞানী এরিক ফ্রাঙ্ক এবং উরজবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সহকর্মীদের চোখে ধরা পড়ে পিঁপড়েদের এক অদ্ভুত আচরণ যা তাঁরা তাঁদের কল্পনাতেও মনে হয় ভেবে উঠতে পারেননি। আসলে তাঁরা ফ্লোরিডা কার্পেন্টার পিঁপড়েদের জার্মানিতে তাঁদের ল্যাবে নিয়ে আসেন এটা পরীক্ষা করার জন্য যে পিঁপড়েরা কীভাবে তাদের দেহের কোনও আঘাতের প্রতিক্রিয়া জানায়। বেশিরভাগ পিঁপড়ে প্রজাতিতেই এটা লক্ষ্য করা যায় যে একটি পিঁপড়ের আহত বা বিচ্ছিন্ন অঙ্গকে বাকি পিঁপড়েরা একটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল চটচটে বস্তু দিয়ে প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করে। কিন্তু লালচে-বাদামি কার্পেন্টার পিঁপড়েরা আঘাতের স্থান চিকিৎসার জন্য একটি ভিন্ন প্রকৌশল ব্যবহার করে, এই পিঁপড়েরা আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গের বাকি অংশ কামড়ে কেটে ফেলে।
তারা দক্ষ শল্যচিকিৎসক
অন্যান্য প্রাণী, যেমন টিকটিকি— শিকারিদের থেকে বাঁচতে তাদের নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ত্যাগ করে, কিন্তু ফ্র্যাঙ্কের মতে এটিই প্রথম যে কোনও পোকা জীবন বাঁচাতে তার নিজের সদস্যদেরই পা বা হাত কেটে দিচ্ছে। পিঁপড়ে ছাড়া একমাত্র অন্য প্রজাতি যারা এটি করে তা হল মানুষ। যদিও ফ্রাঙ্ক এই উক্তি করার আগে তা নিজেও খুব একটা বিশ্বাস করতে চাননি ব্যাপারটা যে পিঁপড়েরাও শল্যচিকিৎসা করতে পারে। তাই তিনি এই পরীক্ষাটি একটানা চারবার করেছিলেন।
বেশিরভাগ পিঁপড়ে প্রজাতির একধরনের গ্রন্থি থাকে যা তাদের ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগ নিঃসৃত করে, এই যৌগ সাধারণত ক্ষতের মাধ্যমেই তাদের শরীরে প্রবেশ করে। কিন্তু মাত্র এক সেন্টিমিটার-লম্বা ফ্লোরিডা কার্পেন্টার পিঁপড়ে (ক্যাম্পোনোটাস ফ্লোরিডানাস) দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় বিবর্তনীয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রন্থিটি হারায়। তাই এই প্রজাতিটি কীভাবে নিজেকে রক্ষা করে তা বোঝার জন্যই, ফ্র্যাঙ্কের দল এই পিঁপড়ের ফিমার অংশে একটি ক্ষত করেন এবং ক্ষতটিকে সিউডোমোনাস অ্যারুগিনোসায় নামক ব্যাকটেরিয়া-যুক্ত স্থানে উন্মুক্ত করেন, এখানে বলে রাখা দরকার যে উক্ত ব্যাকটেরিয়াটি একটি এমন ব্যাকটেরিয়া যা সাধারণত মাটিতে পাওয়া যায়। এরপর ফ্রাঙ্ক কিছু পিঁপড়েকে তাদের কলোনিতে ফিরিয়ে দেন আর কিছু পিঁপড়েকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে দেন।

আরও পড়ুন-তৃণমূল কংগ্রেসে জোর শৃঙ্খলায়, সুসংহত প্রচার ও জনসংযোগ, কর্মসমিতি থেকে একগুচ্ছ কর্মসূচি

দেখা যায় যে পিঁপড়েগুলো তাদের কলোনিতে ফিরে এসেছিল, কলোনির বাকি সদস্যরা দ্রুত এক বা দু’জন ওই আহত পিঁপড়ের কাছে এসে তাদের ফিমারের ওপরের অংশটি সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলেছিল। প্রমাণ বলে এই ‘সার্জারি’ করা পিঁপড়ের নব্বই শতাংশই বেঁচে যায়। বিপরীতে, যারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা পড়ে ছিল তাদের মধ্যে মাত্র চল্লিশ শতাংশই বেঁচে ছিল। এরপর গবেষকরা এক জোড়া মাইক্রোসিসরের সাহায্যে পিঁপড়ের পায়ের নিচের দিকে, টিবিয়াতে কতকগুলি ক্ষতের সৃষ্টি করেন এবং তাদের বাকি সদস্যদের সঙ্গে ছেড়ে দেন। এই সময় তাঁরা লক্ষ্য করেন, বাকি সদস্যরা তাদের আহত সদস্যের পা কেটে না দিয়ে পরিবর্তে, তারা কেবল তাদের জিভ দিয়ে ওই ক্ষতস্থানের ব্যাকটেরিয়া অপসারণের জন্য ক্ষতটিকে চাটছে। তবে এক্ষেত্রেও যে পিঁপড়েগুলিকে তাদের অন্য সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি তাদের নব্বই শতাংশ মারা গিয়েছিল, কিন্তু যাদের তার সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের পঁচাত্তর শতাংশ বেঁচে ছিল।
বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন এবং মত
পিঁপড়েদের চিকিৎসায় এরকম দ্বিচারিতা কেন? কখনও তারা উপাঙ্গ কেটে বাদ দেয় আবার কখনও তারা স্রেফ চেটে ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করে। উত্তর লুকিয়ে আছে এদের শারীরবৃত্তীয় গঠনে। উচ্চ-রেজোলিউশন মাইক্রোস্কোপি প্রকাশ করেছে যে ফ্লোরিডা কার্পেন্টার পিঁপড়ের ফিমারে বেশ কয়েকটি পেশি রয়েছে যা হিমোলিম্ফ (পতঙ্গে থাকা রক্ত) সঞ্চালনকে বাধা দেয়, ফলে ব্যাকটেরিয়া ক্ষতস্থান থেকে দ্রুত শরীরে প্রবেশে বাধা পায়। ফলস্বরূপ, পিঁপড়েরা ফিমারের আঘাতগুলি সহজেই কেটে ফেলতে পারে। এই কাজ করতে তাদের সময় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট আর এই প্রয়োজনীয় সময় তারা পেয়ে যায় যদি আঘাতটি ফিমারের হয়। রকফেলার ইউনিভার্সিটির একজন বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল ক্রোনার এটি ব্যাখ্যা করেন। বিপরীতে, টিবিয়াতে হেমোলিম্ফ বন্ধ করার জন্য কম-পেশি থাকায় তা রক্ত সঞ্চালনকে দ্রুত করে ফলস্বরূপ ব্যাকটেরিয়াকে দ্রুত প্রবেশে সাহায্য করে। তাই টিবিয়ার আঘাত, আরও দ্রুত চিকিত্সা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।
টিবিয়ার ক্ষতের পরে অঙ্গচ্ছেদ, সংক্রমণ বন্ধ করতে কার্যকর কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য, ফ্র্যাঙ্ক ও তার দলবল পিঁপড়ের পা কেটে দেন। তবে পিঁপড়ের দেহের ডিএনএ-এর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ফিমারের ক্ষতের পর তাদের অঙ্গচ্ছেদন আসলেই তাদের রক্তে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে থামিয়ে দেয়, তবে টিবিয়ার ক্ষতে করা অঙ্গচ্ছেদনে এরকম কিছু ঘটেনি। এই পরীক্ষার পর গবেষকরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে পিঁপড়েরা এটি খুব ভাল করেই জানে যে কোন অঙ্গের ক্ষতের প্রেক্ষিতে কোন কৌশল অবলম্বন করলে তারা বেঁচে থাকতে পারবে। এমনকী তাদের শারীরবিজ্ঞান সম্বন্ধেও তাদের স্পষ্ট ধারণা আছে ঠিক একজন দক্ষ ডাক্তারের মতো।

আরও পড়ুন-মঙ্গলে বড় মা দর্শনে মুখ্যমন্ত্রী

বিজ্ঞানী ক্রোনাউয়ার বলেছেন, আশ্চর্যজনক উপায়ে এই খুদে প্রাণীগুলি মানুষের মতো এরকম ‘অত্যাধুনিক আচরণ’ রপ্ত করেছে। এই আচরণের সঙ্গে তিনি ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত সৈন্যদের পুনরুদ্ধার করার এবং তারপর তাদের চিকিত্সা করার’ মিল খুঁজে পেয়েছেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার পুল বলেছেন, এই ফলাফলগুলি পিঁপড়ে সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন করতে পারে। তারা শুধু সৈন্য নয় যারা শুধুমাত্র রানির জন্য কাজ করে তারা একে অপরকে সাহায্য করার জন্য চরম পর্যায়ে যায়।
এই সূত্র ধরেই বলা যায় এতদিন মানুষ পিঁপড়েদের চিনত সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে, অবাক হত এটা জেনে যে কীভাবে এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলি বিপদে-আপদে সর্বদা একে অপরের পাশে থাকে, যা মানুষ এতদিনেও শিখে উঠতে পারেনি। মানুষ এতদিন বড়াই করত তাদের বুদ্ধিমত্তার ক্যারিশমা নিয়ে, তবে সেই অহংকারও বোধহয় এখন যেতে বসেছে যবে থেকে তারা জেনেছে, যে ডাক্তারি তারা বছরের পর বছর পড়ে আয়ত্ত করে তা এই খুদেগুলোও জানে কোনওরকম ট্রেনিং ছাড়া!

Latest article