চিকিৎসকদের আন্দোলন কয়েকটি ছবি, কিছু প্রশ্ন

আরজি কর-কাণ্ডের বিচার চেয়ে যে তীব্রতায় জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি, তার সমান কিংবা অধিক আগ্রহে দরিদ্র মুমূর্ষুদের পরিষেবা প্রদান কি কাম্য ছিল না? প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন প্রবীর ঘোষাল

Must read

নামী এক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার প্রয়োজনে দিনকয়েক আগে গিয়েছিলাম। আমার পূর্ব-পরিচিত চিকিৎসক নার্সিংহোমে নিজের চেম্বারে বসে কথা বলছিলেন। মোবাইল বেজে উঠল। কানে ধরলেন। আরজি কর-কাণ্ড নিয়েই ফোনে কথা হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধেই বুঝলাম, আন্দোলনকারী কোনও জুনিয়র চিকিৎসক ফোন করেছেন। চিকিৎসকমশাই তাঁকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।

আরও পড়ুন-মানবতার স্বার্থে ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুক ভারত, প্রাক্তন আমলা, শিক্ষাবিদদের আর্জি সুপ্রিম কোর্টে

মোবাইলে তিনি বলছিলেন, ‘তোরা দুটো জিনিস খেয়াল রাখিস। রোগীদের পরিষেবা দেওয়া যেন চালু থাকে। আর আন্দোলনের লাগাম কোনওভাবেই যেন রাজনীতির কারবারিদের হাতে চলে না যায়।’ কেবল পরামর্শ নয়, নামী চিকিৎসক আন্দোলনকারীদের সাবধান করে দেন এই বলে, ‘যে দুটো জিনিস বললাম যদি তোদের মাথায় না থাকে, তাহলে ডুববি। সাধারণ মানুষ আর আন্দোলনের পাশে থাকবে না।’
১ মাস হয়ে গেল কলকাতার বড় বড় হাসপাতালগুলি কার্যত অচল হয়ে রয়েছে। অপারেশন থেকে আউটডোর কার্যত অচল। অন্য সময় যে কোনও সকালে সরকারি হাসপাতালে গেলে জনারণ্য চোখে পড়ত। কিন্তু চিকিৎসকদের আন্দোলনের পর থেকে এই একমাস কলকাতার বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলি বস্তুত জনশূন্য হয়ে গিয়েছে। দেশের অধিকাংশ গরিব মানুষেরই নার্সিংহোমে চিকিৎসা করার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। তাঁরা কোথায় যাবেন? বিনা চিকিৎসায় গরিব রোগীরা মৃত্যুবরণ করবেন? এটা কোন বিচার?
৯ অগাস্ট আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া একজন মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুন নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। নৃশংস এই ঘটনার বিচার এবং অপরাধীর ফাঁসি চেয়ে সবচেয়ে আগে সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ নানাভাবে এই নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন। দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
তদন্তের জন্য ১ মাস অপেক্ষার প্রহর চলেছে। মানুষের ধৈর্যচ্যুতিও হচ্ছে। আমরা সবাই চাই আরজি কর হাসপাতাল-কাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

আরও পড়ুন-এবার কি তবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আমেরিকাকে দিচ্ছে বাংলাদেশ?

কিন্তু রিষড়ার রাজীব দেব কিংবা কোন্নগরের বিক্রম ভট্টাচার্যের অকালমৃত্যুর কী বিচার হবে! তাঁদের মায়েদের কোল যে শূন্য হল সেই ক্ষতি কি আন্দোলনে মত্ত চিকিৎসকেরা পূরণ করতে পারবেন? রাজীবের বয়স ৩৩। বিক্রমের বয়স ২৮। তাঁদের পরিবারও তো অপরাধীদের শাস্তি চাইছে। রিষড়ার রাজীবের বাবা স্বপনবাবুর বয়ানে শুনুন তাঁর পুত্রের মৃত্যুর মর্মান্তিক কাহিনি। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে রাজীবের কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিল সফলভাবে। তাঁর একটি কিডনি বাদ যায়। পুত্রের সুস্থতার স্বার্থে কিডনি দেন মা সীমা পাল।
মাঝেমাঝে পেট ফুলে, যন্ত্রণার কারণে রাজীবকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল। গত ২ অগাস্ট পিজি হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। প্রথম দিকে ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছিল। দ্রুত উন্নতিও দেখা দিয়েছিল রোগীর। কিন্তু আরজি কর-কাণ্ডের জেরে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকদের আন্দোলন শুরু হতেই, সব গোলমাল হয়ে যায়। দিনের পর দিন বিনা চিকিৎসায় রাজীবের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যায়।
স্বপনবাবু বলতে থাকেন— ‘পর পর চিকিৎসকদের অনুরোধ করি, কিন্তু বড় ডাক্তারবাবু মাঝেমধ্যে দেখে গেলেও, চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। দায়িত্ব এড়াতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত রোগীকে মেডিসিন থেকে নেফ্রোলজি বিভাগে ট্রান্সফার করে। রোগীর পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যায়। পেট ফুলে ওঠে। ৪ সেপ্টেম্বর যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে রাজীব। তাকে ক্যাথেটার লাগাতেও কেউ আসেনি। শেষ পর্যন্ত চিরঘুমে চলে যায় সে।
কোন্নগরের বিক্রমও চিকিৎসায় অবহেলার বলি। তাঁর মা কবিতাদেবীর কথায়, বৃহস্পতিবার সকালে জিটি রোডে একটি ডাম্পার ছেলের পা দুটি দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে চলে যায় সঙ্গে সঙ্গে বিক্রমকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, রোগীর আঘাত গুরুতর। আরজি কর হাসপাতালে রেফার করে তাঁরা। একই অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়া হয় আরজি করে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ছেলেকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে এমার্জেন্সিতে শুইয়ে রেখে ডাক্তাবাবুদের হাতে-পায়ে ধরি। প্রায় তিন ঘণ্টা চোখের সামনে ছেলের মৃত্যুযন্ত্রণা মা হিসাবে প্রত্যক্ষ করি। বিনা চিকিৎসায় অবশেষে ২৮ বছরের বিক্রম মৃত্যুর কোলে মাথা রাখে।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণ দলিত নাবালিকাকে

রাজীবের বাবা স্বপন দেব এবং বিক্রমের মা কবিতাদেবী দুজনেই কান্নাভেজা গলায় বলেন, ‘আরজি কর-কাণ্ডের বিচার আমরাও চাই। কিন্তু আমাদের যে সন্তানরা চলে গেল, তার বিচার পাব না? অপরাধীদের শাস্তি হবে না?’ কোন্নগর এবং রিষড়ার নাগরিক এই দুই তরুণের অকালমৃত্যু নিয়ে সরব হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু পরিষেবা বন্ধ করে নয়। একের পর এক বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।’
একমাসে কতজন রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গিয়েছে তা কেউ জানে না। কলকাতার এক-একটা সরকারি হাসপাতালে দৈনন্দিন চিকিৎসার কী বেহাল অবস্থা এই একমাসে হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না। আন্দোলনের ২৭ দিনের মাথায় আরজি কর হাসপাতালে সার্জারির একটা হিসাব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৯ অগাস্ট সেখানে ৮৪টি অপারেশনের কাজ হয়েছিল। আর ১০ অগাস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপারেশন হয়েছে মাত্র ১৮৪টি। ১৬, ১৭ এবং ১৮ অগাস্ট একটিও অপারেশন হয়নি। এই তথ্য পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, চিকিৎসকদের কর্মবিরতি সরকারি হাসপাতালগুলিতে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একজন চিকিৎসকের কাছে রোগীর পরিষেবা সবচেয়ে বড় ধর্ম। আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় রোগীর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।

Latest article