এই ভারতবর্ষকে বিজেপি চেনে? খোঁজ রাখে ওরা ভারতের অন্তরাত্মার?

বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষকে ঐক্যের নামে একবর্ণ রঞ্জিত করতে চাইছে। আর ভারতবর্ষ তেমনটা চাইছে না। তাই রাজ্যে-রাজ্যে তৈরি হচ্ছে সাংস্কৃতিক সংঘাত বিন্দু। বিরোধিতার ভূগোল ক্রমপ্রসারমান। লিখছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান;
দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান জগজন মানিবে বিস্ময়, জগজন মানিবে বিস্ময়।

আরও পড়ুন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কর্মশালা

ভারতবর্ষকে এভাবেই চিনেছিলেন, চিনিয়েওছিলেন, এক বাঙালি কবি। অতুলপ্রসাদ সেন।
তাঁর চোখে ভারতবর্ষ কোনও রাষ্ট্রের নাম নয়। ভারতবর্ষ কোনও দেশের নাম নয়। ভারতবর্ষ কোনও সভ্যতার নাম নয়। ভারতবর্ষ মহাজাগতিক এক ম্যাজিকের নাম। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাদুকর ভারতবাসী। প্রবল পারস্পরিক পার্থক্য, ভেদাভেদ, আচার ব্যবহার, ভাষা, খাদ্য, ধর্ম-উপধর্মের বিপুল প্রভেদ। সেসব সত্ত্বেও ভারতবর্ষের একটি অঙ্গও বিচ্ছিন্ন হয়নি গত ৭৯ বছরে, আজও।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ব্রিটিশ সরকার যে ভারতবর্ষকে ভৌগোলিকভাবে রেখে গিয়েছে, আজও অবিকল সেই সীমানাই রয়ে গিয়েছে। কেউ বিচ্ছিন্ন হয়নি। কেউ স্বাধীন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেনি।
এহেন নিরবচ্ছিন্ন সংহতি প্রবাহের কৃতিত্ব কোনও সরকার কোনও নেতা-নেত্রী কোনও রাষ্ট্র প্রশাসনের নয়। এই কৃতিত্ব ভারতবাসী নামক একটি অত্যাশ্চার্য জনসমষ্টির। যাদের সিংহভাগ কোনওদিন পড়েনি যে, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ নামক একটি বাক্য এক বিখ্যাত গ্রন্থে লেখা হয়েছিল, যার নাম সংবিধান। অথচ জেনে অথবা না জেনে ঠিক সেই ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ তারা পালন করে চলেছে বছরের পর বছর, দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা, দারিদ্র ও বৈষম্যকে জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্যের মতো সঙ্গী করে।
চার্চিল মনে করতেন, যদি ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে আসে, তাহলে জনপরিষেবার গোটা কাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রেলওয়ে, সড়ক, সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। ভারত কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে আবার অসভ্য বর্বর মধ্যযুগে ফিরে যাবে!
কিন্তু বাস্তবে সেসব কিছুই হয়নি। ভারতের স্বাধীনতার ৭৯ তম বর্ষে এসে বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছে ব্রিটেনের জিডিপি আজ ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি ডলার। ভারতের জিডিপি ৩ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি ডলার। ভারত ব্রিটেনকে ছাপিয়ে হয়েছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। পক্ষান্তরে ব্রিটেন ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছে আর্থিক সংকটে।
১৯৫১-৫২ সালের স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় ভোটারের সংখ্যা ছিল ২৩ কোটি। ২০২৪ সালের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৭ কোটি। যে ভূমিখণ্ড ধর্মের কারণে এই মহান ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল ১৯৪৭ সালে, তারা ক্রমেই আজ ভুলে গিয়েছে যে, স্বচ্ছ, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোটপ্রক্রিয়া একটি দেশে ঠিক কেমন দেখতে হয়। তাদের জীবনের সিংহভাগ কেটে গিয়েছে সামরিক শাসন অথবা রাষ্ট্রপতি শাসনে কিংবা অনির্বাচিত সরকারের অধীনে। তাদের দেশগুলিতে যখন তখন সেনা অভ্যুত্থান হয়। সরকারের পতন ঘটে। যখন তখন জনতার বিপ্লবের নামে নৈরাজ্য হয়। প্রধানমন্ত্রীরা বিদেশে পালিয়ে যান বারংবার। সরকারের পতন ঘটে।
পক্ষান্তরে, ৭৯ বছরের স্বাধীন ভারত মাথা উঁচু করে গণতন্ত্রের উৎসব পালন করে। নিয়ম করে ১৯৫২ সালের পর থেকে প্রতি ৫ বছর অন্তর নির্বাচন হয়। একবারও একদিনের জন্যও কোনও সামরিক শাসন কায়েম হয়নি। নির্বাচন যখনই কেউ ব্যাহত করেছেন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে, ঠিক দেড় বছর পর তিনি চরম শিক্ষা পেয়েছেন নিজেই নির্বাচন ঘোষণা করে। ৭৯ বছর ধরে এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, আক্রমণ, যুদ্ধ, দাঙ্গা, সংঘাত, দারিদ্র সহ্য করেও ভারতবর্ষ নামক ম্যাজিক পিছিয়ে যাচ্ছে না।
ভারত এত ভিন্নতা সত্ত্বেও অটুট রইল। এত প্ররোচনা সত্ত্বেও গৃহযুদ্ধ বাধেনি এই দেশে। গণতন্ত্রের জোরালো স্তম্ভকে ধূলিসাৎ করা যায়নি কিছুতেই।
কারণ, অসংখ্য মহান আত্মবলিদানের শক্তি ভারতবর্ষ নামক জাদুভূমিতে মিশে রয়েছে! সেই অলৌকিক শক্তিগুলি দিয়েই তো তৈরি হয়েছে একটি প্রতিজ্ঞামন্ত্র। ‘উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া’। ‘আমরা ভারতের জনগণ’।

আরও পড়ুন-ফরাক্কা চুক্তির পুনর্নবীকরণ জরুরি মুখ্যমন্ত্রীর মতামত

আর এইটাই বুঝতে পারছে না মোদি জমানায় বিজেপি।
তারা জানেই না, এদেশে যেখানে জগন্নাথ পূজিত হন, সেই ওড়িশাতেই কালাপাহাড়ও পুজো পায়। যুধিষ্ঠির তো ধর্মরাজ ছিলেন, সত্যের পূজারি ছিলেন। তিনি তো পূজাও পান। দুর্যোধন কিন্তু নিয়ম করে দেবতা হিসেবেই পূজিত হন কেরল থেকে উত্তরাখণ্ডের গ্রামে গ্রামে। কেরলের কোল্লাম জেলায় এই মন্দিরে আগত ভক্তরা বিশ্বাস করেন আপ্পোপাম দুর্যোধন তাঁদের নানাবিধ বিপদ থেকে রক্ষা করেন। উত্তরাখণ্ডের নেতাওয়ার থেকে ওসলা পর্যন্ত বিস্তৃত গ্রামগুলির বিশ্বাস, তমসা নদীর জন্ম হয়েছে দুর্যোধনকে অন্যায়ভাবে হত্যার ফলে জনসমাজের সম্মিলিত অশ্রু থেকে। দুর্যোধনের মন্দির রয়েছে ওসলা নদী উপত্যকায়।
বিজয়া দশমীর সময় দশেরা উৎসবে প্রধানত উত্তর এবং মধ্যভারত জুড়ে যখন পালিত হয় রাবণসংহার পর্ব, তখন সেই দশেরাতেই ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রের গোন্দ উপজাতিভুক্ত মানুষ রাবণকে সম্মান জানিয়ে বন্দনাগীতি এবং উৎসব পালন করে। উত্তরপ্রদেশের বিশরাখ গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে তাদের গ্রামই রাবণের জন্মস্থান।
এসব বোঝার দায় বিজেপির নেই।
আর নেই বলেই একরঙা করতে চাইছে তারা ভারতবর্ষকে। আর ভারতবর্ষ তেমনটা হতে চাইছে না।
সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু সেটাই।

Latest article