তুমি দুর্গা (Durga Idol) দশপ্রহরণধারিণী। তুমি বাঙালির আইকন, তুমি মানুষের প্রহর গোনা, তুমি আনন্দের মূর্ছনা। সময় তোমায় ঘিরে আবর্তিত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতি। রথের রশিতে টান মানে দুর্গা প্রতিমার কাঠামোয় মাটি। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় মাটি পায় মায়ের অবয়ব। চোখে তুলির শেষ টানে ফোটে মায়ের দৃষ্টি। তুমি যেন বাংলার বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটি— বছরান্তে কোল জোড়া ছেলেমেয়ে নিয়ে মা-বাপের ঘর ভরাতে আসো কয়েকটা দিন। বৃদ্ধা দাইমা হোক বা পাড়ার এনসাইক্লোপিডিয়া কাকিমা, সবাই এসে খোঁজ নিয়ে যায়— হ্যাঁলা দুগ্গি এলি? ক’দিন থাকবি তো মা?
একটি চালচিত্র, তার মধ্যে দশ হাতে দশটি প্রহরণ বা অস্ত্র নিয়ে চার সন্তান-সহ এক মাতৃমূর্তি। সিংহের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করছেন পদপ্রান্তে অসুরের সাথে অথচ প্রশান্ত মুখমণ্ডল। এই রূপেই আমরা বাঙালি দুর্গাকে দেখে অভ্যস্ত। এটাকে আমরা সাবেক প্রতিমা বলি। যদিও আধুনিক দুর্গা (Durga Idol) প্রতিমা প্যান্ডেলে শিল্পীর কল্পনায় নানাভাবে তৈরি হচ্ছেন। কখনও হাতে অস্ত্রের বদলে বই (যেন লেখাপড়া শিখলেই অসুর পাল্টে যাবে!) ইত্যাদি। আজকের বর্তমানের প্রেক্ষাপটে যা সাবেক, গতকালের সাবেকের প্রেক্ষাপটে প্রতিমার সাবেকতর রূপ কেমন ছিল আর কীভাবেই বা হল মায়ের এই রূপকল্পনা? সেপিয়া রঙের পটভূমি কিংবা মালকোষের বিষণ্ণতা নয়, ধর্মের অতীত কিন্তু প্রকৃতির রঙের মতোই স্বভাব উজ্জ্বল।
আজকের মানুষ অতীতের বহুলক্ষ বছর আগের ভূমি তথা বৃক্ষচারী শিবাপিথেকাস থেকে দু’পায়ে চলে হোমোস্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স-এ আপাতত অবস্থান করছে। ‘পৃথিবীর সমস্ত জীবন তার উৎস থেকে একটি অবিচ্ছিন্ন শৃঙ্খলে সাধারণ পূর্বপুরুষদের থেকে বিবর্তিত হয়েছে।’ এটাই ডারউইনের বিবর্তনবাদের সংক্ষিপ্ত নীতি। অ্যামিবার একটা কোষেই লেখা হয়েছিল জীব বিবর্তনের ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদ, প্রাণী নিজেকে ক্রমাগত বদলেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে, টিকে থাকতে। তাকেই বিজ্ঞান বলে অভিযোজন। বিশাল এই পৃথিবীতে যারা ঠিকমতো অভিযোজিত হতে পেরেছে তারা টিকে গেছে। বাকিরা ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষ যখন নানা বিবর্তনের মধ্যে আজকের রূপ পেয়েছে তখন দেবতাই বা কেন অভিযোজনের পথে বিবর্তনের ইতিহাসের যোজন দূরত্ব অতিক্রম করবে না? নানা অভিযোজনের ফলেই মাতৃ ধর্ম টিকে যায়— ইন্দ্র বরুণ মিত্র থাকে ইতিহাসের পাতায়।
ভারতের সিন্ধু-সভ্যতা আবিষ্কারের পর স্পষ্টই বোঝা গেল এদেশে মাতৃ উপাসনার ইতিহাস কত প্রাচীন। কোলে শিশু, মা লালন পালন, শাসন করছেন, মায়ের গর্ভে সন্তান এমত প্রাকৃতিক শিক্ষা থেকে মানুষ মাতৃমূর্তি গড়েছে, পুজো করেছে। হরপ্পায় পাওয়া একটা সিলের উপর এক নারীমূর্তি খোদিত রয়েছে যার যোনিমুখ থেকে লতা গুল্মাদি নির্গত হচ্ছে— কসমিক ট্রি বুঝতে অসুবিধা হতে পারে কিন্তু প্রকৃতি যে বৃক্ষের জন্মদাত্রী একথা সহজেই বোঝা যায়। এটাই পরবর্তীতে দুর্গার নামের সঙ্গে শাকম্ভরী, অন্নপূর্ণা নাম যুক্ত হওয়া কিংবা নবপত্রিকা পুজো হিসেবে বিবর্তিত। লজ্জা গৌরীর বিবর্তিত রূপ অঞ্চল ভেদে পুত্তলিকা কিংবা স্বস্তিক চিহ্ন। হরপ্পা সভ্যতার সিলে দু’দিকে দুটি বাঘ বা সিংহকে প্রশমিত করছেন মাঝের মাতৃমূর্তি যাঁর মাথার পিছনে কিছু শিখা। আসলে বামদিকের সঙ্গে ডানদিকের সামঞ্জস্য একটি অন্যতম সনাতনী বৈশিষ্ট্য— হয়তো সুষুম্নার সঙ্গে ইরা, পিঙ্গলার সামঞ্জস্যের কথা ভেবেই। একটি অক্ষ এবং তার দু’পাশে সামঞ্জস্য বা সিমেট্রির ধারণা জন্ম দেয় কেন্দ্রীয় দেবতার চারপাশে অনুচরদের অবস্থানের। সময়ের বিবর্তনে অনুচর সন্তান হয়ে উঠতে অসুবিধা কী! মহিষকে শূল দিয়ে বিদ্ধ করার দৃশ্যও পাওয়া গেছে। সেই মহিষমেধ আজ বিবর্তনের পথে মহিষমর্দিনী থেকে মহিষাসুরমর্দিনী (Durga Idol)।
আরও পড়ুন- বাঘা যতীন
হিন্দু সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণে। বর্বর কিন্তু বিজয়ী জাতি যখন ইতিহাস লেখে তখন সাহায্য নেয় অনার্য গণদেবতার, কারণ তারা তো লিখতেই জানত না। হিন্দু সংস্কৃতির শতকরা পঁচাত্তর ভাগ প্রাচীন হরপ্পা সংস্কৃতি, বাকিটা আর্য মিশ্রণ এবং চলমান পথে বিবর্তন। বাঙালির ক্ষেত্রে এই হরপ্পা ধারা বড়ই বেশি প্রকট তার কারণ আর্যদের কাছে গায়ের জোরে না পেরে একদল সভ্য নগরবাসী পূর্বদিকে সরতে সরতে সরস্বতী ছেড়ে গঙ্গার অববাহিকা ধরে এগিয়ে চলে পাণ্ডু রাজার ঢিপি হয়ে খনা মিহিরের ঢিপিতে, উয়ারী-বটেশ্বরে, গঙ্গারিডাই সভ্যতা গড়ে তুলতে। একটা প্রমাণ আজও স্পষ্ট, আর্যাবর্তে আজও বাঙালি বিদ্বেষ প্রকট।
আর্য সভ্যতার মাতৃপূজা সেভাবে ছিল না। ঋগ্বেদে অল্পবিস্তর উষা,অদিতি, রাত্রির উল্লেখ থাকলেও তাদের নামে কোনও হোমযজ্ঞ হত না। পরবর্তীতে যা কিছু মাতৃ উপাসনা এসেছে সবই অভিযোজনের পথে— টিকে থাকতে গেলে যোগ্য হতে হবে যে। সেই অভিযোজনের পথেই মহাভারতে ভীষ্মপর্বে অর্জুনের দুর্গাস্তব, বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব কিংবা দেবীসূক্তে ‘অহম রাষ্ট্রী’। প্রসঙ্গত দেবীসূক্তে তিনি জল থেকে উদ্ভূত— হরপ্পা সভ্যতা থেকে আজ পর্যন্ত জল-ঘটের জলেই মূল পূজা হয়।
গঙ্গারিডাই সভ্যতার মাতৃকামূর্তিগুলিতে প্রধান মাতৃকা ও তাঁর দুইপাশের প্রধান দুই সহচরীর পক্ষ বা ডানা দেখা যায়। পাখি ডানা মেলে তার শাবককে রক্ষা করার মধ্যে থাকে মাতৃত্বের গরিমা। পাণ্ডু রাজার ঢিপি খননে পাওয়া গিয়েছে প্রভূত পক্ষীমাতৃকার মূর্তি। সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার একটি বিশেষত্ব হল গণরাষ্ট্রের ভাবনা; এই গণরাষ্ট্রে কোনও বিশেষ শ্রেণির চরম সমৃদ্ধির পরিবর্তে সমস্ত সমাজের মধ্যে এক অপূর্ব সাম্য ছিল। হয়তো সেজন্যই বাঙালির একা মাতৃকা তাঁর সহচরীদের সহাবস্থানেই পূর্ণতা লাভ করেছেন। চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া গঙ্গারিডাই সভ্যতার প্রধান মাতৃদেবী দশায়ুধা। চার সহচর সহ দেবীর খোঁপায় দশটি কাঁটা, দশটি অস্ত্রের মতো। কালের বিবর্তনে খোঁপার কাঁটা হাতে উঠে এসে তিনি এখন দশভুজা। গঙ্গারিডাই সভ্যতায় সন্তান কোলে মাতৃকামূর্তি পাওয়া গিয়েছে— সন্তানের মাথায় জটা। আবার বিষপানের পর শিবকে স্তন্য দানে তিনি বিশ্বমাতৃকা।
বিজ্ঞানে ধারণা অনুযায়ী যদি একটি কেন্দ্র হয় জীবনের উৎস আর সমগ্র মানব প্রজাতির উৎসকেন্দ্র যদি হয় মাইট্রোকনড্রিয়াল ইভ (আফ্রিকান ইভ) তাহলে জগৎ সৃষ্টির মূল যে একক তত্ত্ব তিনিই তো জগদ্কারণ, বিশ্ব মাতৃকা— আদ্যাশক্তি মহামায়া।
সিন্ধুসভ্যতা যুগে ঢাক বাজানো, পশুবলি ছিল পুজোর অঙ্গ। চন্দ্রকেতুগড়ের খননে একই প্রমাণ। বাংলায় পালযুগে দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল। সেনযুগেও। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রশক্তিতে ইসলাম ধর্মের প্রাধান্যের কারণে বহুল ও ব্যাপক অর্থে দুর্গাপুজোর ইতিহাস পাওয়া যায় না। অভিযোজনের পথে নানা ধর্মের সঙ্গে মাতৃধর্মকে কিছুটা হলেও বোঝাপড়া করতে হয়। বৈষ্ণব প্রভাবে দুর্গাপুজোর সঙ্গে একটু নারায়ণ পুজো। শক্তিশালী শৈব প্রভাবে শিবের সঙ্গে দুর্গার বিবাহকল্পনা। আসলে বিয়ে দিয়েই তো মেয়েদের শাসন করা একমাত্র সম্ভব। বিবাহের সঙ্গে সন্তানও অঙ্গাঙ্গী জড়িত। তাই সহচর-সহচরীগণ অচিরেই সন্তান হয়ে পাশে থাকার আলেখ্য তৈরি হয়। এভাবেই অন্য প্রদেশের অম্বা বা অম্বিকার সঙ্গে বাঙালি দুর্গা আলাদা হয়ে যান।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীস্তুতি (Durga Idol)। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মেধা ঋষির আশ্রমে দুর্গাপুজো করে কাঙ্ক্ষিত বরপ্রাপ্ত হন। তখন দেবী একাই মহিষাসুরমর্দিনী রূপে—‘‘একৈবাহং জগত্রত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’’। এই মার্কণ্ডেয় পুরাণের তৃতীয় থেকে দ্বাদশ অধ্যায় ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ নামে খ্যাত। বসন্তে হলেও ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র শ্লোকে আছে—‘‘শরৎকালে মহা পূজা ক্রিয়তে ইয়া চ বার্ষিকী’’। তাই কৃত্তিবাস ওঝার রামচন্দ্র কোন ফাঁকে শরতের অরুণ আলোতে অঞ্জলি দিয়ে গিয়ে অকালবোধন শুরু করে গেলেন ঠিক বোঝা গেল না।
তাহেরপুর রাজা কংসনারায়ণ ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে অনেক আড়ম্বরে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করেন। আধুনিক দুর্গাপূজার যে আড়ম্বর, তারই ভিত খোঁড়া হল যেন।
এরপর বাঙালির ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দুর্গাপুজো আসে বড় বড় জমিদার আর রাজাদের হাত ধরে। যতটা না ভক্তিতে তার চেয়ে ঢের বেশি জাঁকজমক আর আভিজাত্যের দেমাক দেখতে। ইংরেজদের কাছ থেকে রাজা বাহাদুর খেতাবের লোভে জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানানো হয় সাহেব, মেম, লাট, বড়লাটকে। আলোর রোশনাই-এর সঙ্গে রাতভর চলে শরাব আর বাইনাচের আসর। সেই দুর্গাপূজা ছিল একশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ! যে কেউ এসে বাড়ির পুজো দেখতে পেত না। দুর্গাপুজো বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়, পুজো সর্বজনীন হওয়ার পর। প্রথমে বাড়ির পুজো, তারপর এল বারোয়ারি পুজো, সবশেষে সর্বজনীন। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মূলত দেবী দুর্গাকে (Durga Idol) মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতার জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। সুভাষচন্দ্র বসু বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। এরপর বাঙালির হাত ধরে শারদীয়া দুর্গোৎসব ক্রমে বাংলার বাইরে এবং পরে দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এখন সর্বজনীন পূজায় ‘থিম’ বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ, প্রতিমা ও আলোকসজ্জার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। থিমগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে পুরস্কারও দেওয়া হয়।
বাঙালির দুর্গা বাংলার প্রাণভোমরা— বাঙালির আইকন। বাংলার জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, সাজ,পরিকল্পনা সবকিছুরই কেন্দ্রে থাকেন দুর্গা। বাংলার জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজো। যে যেভাবেই পুজো শুরু করুক, যে মন্ত্রতেই দেবতার বোধন হোক তাতে দেবতার যখন কোনও মাথাব্যথা নেই, ক্ষুদ্র মানবের প্রয়োজনই বা কী এত তত্ত্বে আর তথ্যে। একটা লোক উৎসব শুরু হয় কোনও হিসেব না কষে, তত্ত্ব না ভেবে। কৃষিভিত্তিক সমাজে শস্য ওঠার পর বা ভাল চাষ হলে মানুষ খুশি হয়। রবি শস্য ওঠার পর আর আমন চাষের পর উৎসব মনে আনন্দ নিয়ে আসে। তাতেই যদি বাসন্তী আর শারদীয়ার ইতিহাস লেখা হয় ক্ষতি কী? স্ট্রাগল ফর এগজিস্ট্যান্স যদি হয় টিকে থাকার যুদ্ধ তাহলে সেটা মানুষের সঙ্গে দেবতারও। যুগের চাহিদায় তাল মিলিয়ে তিনি বিবাহ করেছেন, সন্তান পাশে নিয়ে এক যোদ্ধা নারী হয়েছেন বাঙালি বিবাহিতা রমণী। দেবতার মানবায়নে মানুষের বড় সুখ।
জগদ্কারণ মাতৃকার থেকে উদ্ভূত জগৎ। তিনি তো সকলের মা, বিশ্বপ্রসবিনী। তিনি আদি শক্তি। শক্তি দৃশ্যমান নয়, শক্তির অস্তিত্ব শক্তির প্রকাশ। জগৎকে মায়া বলে ভাবতে সাহস লাগলেও ভাবা যায় কিন্তু শক্তিকে অস্বীকার করবে কে! তাই উৎস যাই হোক, প্রবাহ যে পথেই হোক, দুর্গা বছর বছর আসুক বাঙালির ঘরে, তাদের নিজের মেয়েটি হয়ে। আনন্দের ধারা বয়ে চলুক আনন্দময়ীর আগমনে।