এবছরের মতো দুর্গোৎসব শেষ। উৎসবের আবহে ভিন্নমাত্রার উন্মোচন দেখল বাংলা। দুর্গা পুজোর রাজ্যে নারীর ক্ষমতায়নে জোর দিয়েছেন জননেত্রী। আর তাতেই বদল বাংলার পটচিত্রে। উৎসবের লগ্নে এবং তার পরেও। লিখছেন সাহানা নাগ চৌধুরী
দুর্গাপুজোর উৎসবের রেশ এখনও ছড়িয়ে আছে সারা বাংলায় । গতবছর করোনার ছোবলে বাংলায় কৈলাস থেকে মা আসলেও এখানে অন্তরীণই ছিলেন । করোনা গত বছর বহু পরিবারের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছিল। কাজ হারিয়ে ছিলেন বহু মানুষ। এক ঘোরতর অন্ধকার ছবি ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। সে সময় বাড়ির হাল ধরতে নেমে পড়েন বাংলার মা-মেয়েরা। গ্রাম বাংলায় দেখা গেছে গ্রামের বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত মহিলারা নিজেদের উৎসাহেই তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। ঘরের মেয়েরা নি:সঙ্কোচে পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এমন কাজে নিজেদের যুক্ত করেছেন যার থেকে পরিবারগুলো কিছুটা অন্তত অর্থের মুখ দেখতে পেরেছে। এইসব কাজের মধ্যে আছে জমিতে ধান চারা বসানোর কাজ , হাঁস- মুরগি পালন, মিড ডে মিল তৈরি , সেলাই করা ইত্যাদি । আর সেখান থেকে উপার্জন করা অর্থ দিয়েই মেয়েরা নিজেদের উদ্যোগে পরিবারগুলো কে বাঁচাতে পারলেন । এই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজ যদিও নারী -পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমাজে মেয়েদের একটা বড় অংশের মধ্যেই এর ইতিবাচক প্রভাব বেশি পড়েছে।
আরও পড়ুন-বিজয়ার অভিনন্দন, সঙ্গে কালীপুজো-দীপাবলির আগাম শুভেচ্ছা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
২০১৮ – ২০১৯ অর্থবর্ষে দেখা গেছে এই রাজ্য দেশের মধ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা সেল্ফ হেল্প গ্রুপ (SHG) সমবায়ের ক্ষেত্রে ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ করার ব্যাপারে অত্যন্ত সফল । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকার কারণেই এটা বাস্তবায়িত হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভলেপমেন্টের বা নাবার্ডের একটি রিপোর্ট বলছে, এই রাজ্য ইতিমধ্যেই ৯৭ হাজারের উপর স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ঋণ দেয় আর তারাও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তা পরিশোধও করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্হান হয়েছে। এরমধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। দেখা যাচ্ছে, ১০০ দিনের কাজের থেকেও এই প্রকল্পে যোগ দিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বেশি আগ্রহী। ১০০ দিনের কাজের অনিশ্চয়তার বিপরীতে এই প্রকল্পের অধীনে থাকা বিভিন্ন কাজে আয়ের নিশ্চয়তা অনেক বেশি। অনেক বেশি শ্রমের মর্যাদা। তাই মানুষের আগ্রহও বেশি ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মধ্যে নানা ধরণের কাজের ট্রেনিং দেওয়া হয় । গ্রামের ব্লক লেভেল থেকে শুরু করে উপরতলা অবধি বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামে এখন এই রাজ্যের বহু মহিলাই অংশগ্রহণ করেন। রাজ্যের ‘সবলা ‘ মেলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এক বড় সাফল্য। এসব কারণেই সময়ের নিরিখে দক্ষিণ ভারতের পর স্বনির্ভর গোষ্ঠী সংক্রান্ত উদ্যোগ এরাজ্যে শুরু হলেও সাফল্যের নিরিখে এগিয়ে বাংলা।
তৃতীয় তৃণমূল সরকার গঠনের পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন । এতদিন এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল পুরোপুরি পন্চায়েত দপ্তরের অধীনে । এখন এটি একটি নতুন দপ্তর হিসাবে গণ্য হচ্ছে । দপ্তরটির নাম পশ্চিমবঙ্গ স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও ক্ষমতায়ন দপ্তর । মহিলাদের উন্নতির জন্য এখানে যে সব প্রকল্পের উপর জোর দেওয়া হয়েছে সেগুলি হল, পশ্চিমবঙ্গ মানবিক প্রকল্প স্কিম ( শারীরিক প্রতিবন্ধীরা মাসে ১০০০ টাকা পেনশন পাবেন ) , স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্হান প্রকল্প ইত্যাদি । এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে গ্রামীণ মহিলাদের ঋণদান বা পাড়ায় পাড়ায় সমাধান মুখ্যমন্ত্রীর দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরেছে। এই রাজ্য এমন এক জননেত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীরূপে পেয়েছে যিনি মহিলা ক্ষমতায়নের ব্যাপারে সদা সদর্থক ভূমিকা পালনে তৎপর । তার ফলশ্রুতি হিসেবে দেখলাম এ বছর বহু গ্রামেই পুজোর সময় মহিলারা উদ্যোগী হয়ে দুর্গাপুজার আয়োজন করছে । উত্তরবঙ্গের একটি গ্রামের মহিলারা করোনাকালে পুরুষদের চাকরি চলে গেলেও এতটুকু না দমে চাষের কাজ করছে, স্কুল চালাচ্ছে। আবার দক্ষিণবঙ্গের সাগরদ্বীপের মায়েরা তৈরি করছেন ওই দ্বীপের লোধাগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য পুজোর জামা। এছাড়াও এসব অঞ্চলে ভূমিক্ষয় রোধে ম্যানগ্রোভ বসানো, প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন লোকের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ প্রভৃতি চালু আছে। উদাহরণস্বরূপ যদিও রাজ্যের দুটি এলাকার কথা উল্লিখিত হল, আসলে সারা রাজ্য জুড়েই স্বনির্ভর প্রকল্পের নানাবিধ কাজ চলছে । বর্তমানে রাজ্যের প্রতিটি ব্লক স্তর, গ্রামীণ উন্নয়ন দপ্তরের মধ্যে দিয়ে যেভাবে মহিলারা নিজেদের ক্ষমতায়নের দিকে ঝুঁকেছে তাতে নিশ্চিত এই রাজ্য এক শক্তপোক্ত ও উপার্জনক্ষম মহিলা ব্রিগেড তৈরি করার পথে এগোচ্ছে । শুধু গ্রামই নয় এখন শহরেও এর ঢেউ লেগেছে । বহু অসরকারি সংস্থার (এনজিও) মারফত শহরেও নানা ধরনের কাজ শুরু হয়েছে। শারদোৎসবের শুরুতেই এবছর গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলেন পুজোকে ঘিরে নানারকম প্রোজেক্ট নিয়ে।
আরও পড়ুন-ঘরে-বাইরে চাপ, রাহুলকে আড়ালে সামনে সোনিয়াই
পরিশেষে একটা কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। বামফ্রন্ট আমলে যে পঞ্চায়েত-রাজ তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হত, তা পরবর্তীতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়টা সেখানে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। আর, এবারের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মহিলা-ব্রিগেড যে দু হাতে আশীর্বাদ করে মা – মাটি – মানুষের সরকারকে তৃতীয়বারের জন্য ফিরিয়ে আনল তার অন্যতম কারণ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সাফল্য।
দেবী দুর্গার পুজো যে রাজ্যের প্রধান উৎসব, সে রাজ্যে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।