দুর্গাপুজো। বাঙালির প্রাণের উৎসব। ধর্মীয় সীমা পেরিয়ে আজ এই উৎসব হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। সারা পৃথিবীতে যেখানে বাঙালি, সেখানেই দুর্গাপুজো। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই মুখিয়ে থাকেন এই কয়েকটা আনন্দমুখর দিনের জন্য। সাহিত্যে, সংগীতে, চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময় এসেছে দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ। কয়েকটি বাংলা ছবির উপর আলোকপাত করা যাক, যেখানে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে দুর্গাপুজোর পরিবেশ।
পথের পাঁচালী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী। আর যে-কাহিনীর শরীরে মিশে রয়েছে দুর্গা নামের একটি মেয়ে, সেখানে তো দুর্গাপুজো থাকবেই। পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবিতেই অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন শরৎকালের অপরূপ রূপ। কাশফুলের জঙ্গল পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখার জন্য অপু-দুর্গার পাঁইপাঁই দৌড়, পর্দাজুড়ে সাদাকালো মহাকাব্য রচনা করেছিল। দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য সহবাস হরিহর-সর্বজয়ার। তবু দুর্গাপুজোর দিনে তাঁরা দুই সন্তানকে সাজিয়ে তোলেন নতুন পোশাকে। সেজেগুজে ভাই-বোন হাসিমুখে হাজির হয় দুর্গা দালালে। দেবীদর্শনের পর হাত পাতে পুজোর প্রসাদের জন্য। এই দৃশ্য শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্রের নয়, চিরচেনা বাংলার। তাই তো সহজেই আপন হয়ে ওঠে।
জয়বাবা ফেলুনাথ
ছবির প্রেক্ষাপট বারাণসী। উত্তরপ্রদেশের গঙ্গাতীরবর্তী শহর। এই শহরে বহু বছর ধরে বসবাস করেন একটি বাঙালি পরিবার। যাঁদের আছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। বাড়িতে তাঁরা দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। বিরাট ঠাকুরদালালে মৃৎশিল্পী গড়েন প্রতিমা। রহস্যে মোড়া এই ছবির কাহিনী। ফেলুদা তাঁর দুই সঙ্গী তোপসে এবং জটায়ুকে নিয়ে আসেন রহস্যের জট ছাড়াতে। ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মূল কাহিনীর পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালির দুর্গাপুজোর মুহূর্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
উৎসব
জীবনে আছে নানা সমস্যা। খুঁজে নিতে হয় সমাধানের পথ। যাকে আপাতভাবে সুখী মনে হয়, তার ভিতরে হয়তো জমাট বেঁধে রয়েছে দুঃখের পাহাড়। সেই খবর কে রাখে? এই ছবিতে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ দেখিয়েছেন একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারকে। যাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। সেই পুজোকে কেন্দ্র করে এক জায়গায় জড়ো হন বাড়ির সবাই। মেতে ওঠেন আনন্দে। কিন্তু হাসি দিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় না মনের কষ্টগুলো। ঠিকরে বেরিয়ে পড়ে। আসলে আলো-অন্ধকার নিয়েই তো জীবন। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে তৈরি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা অভিনীত ছবিটি এককথায় অসাধারণ।
আরও পড়ুন: পুরোনো বইয়ের গন্ধ
হীরের আংটি
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী। ছবিটি তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। অভিনয়ে অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। রহস্যে মোড়া এই ছবির কাহিনীজুড়ে রয়েছে বাঙালির প্রিয় উৎসব দুর্গাপুজো। প্রাচীন ঠাকুরদালানে মূর্তি গড়া, দেবীর পুজো, সবমিলিয়ে ছোটোদের মনের মতো একটি ছবি। শেষে হয়েছে সত্যের জয়, অসত্যের পরাজয়।
অনুসন্ধান
শক্তিপদ রাজগুরুর গল্প নিয়ে ছবিটি তৈরি করেছিলেন শক্তি সামন্ত। এই বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। ছিলেন আমজাদ খানও। ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলের অনাড়ম্বর দুর্গাপুজোর ছিমছাম পরিবেশ। পুজো প্রাঙ্গণে ঢাক-ঢোলের লড়াইয়ে মেতে ওঠেন নায়ক এবং খলনায়ক। উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ বাজি মারেন নায়কই।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি
মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত ছবি। হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন ফিরিঙ্গি কবিয়াল অ্যান্টনি। ছবির কেন্দ্রে তিনিই। বাংলার বিভিন্ন আসরে কবিগান গেয়ে নাম কুড়োনোর পর তিনি দশভুজার আরাধনায় ব্রতী হন। যদিও গোঁড়া হিন্দু সমাজ বিষয়টি মেনে নেয় না। হুমকি দেওয়া হয়। মাতব্বরদের চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে মা দুর্গার পুজোর আয়োজন করেন অ্যান্টনি। এর ফলে তাঁকে হতে হয় প্রতিহিংসার শিকার।
পরাণ যায় জ্বলিয়া রে
রবি কিনাগী পরিচালিত ছবি। এই ছবির কাহিনীতেও জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির দুর্গাপুজো। পুজোকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক মেলামেশা, চিরচেনা আড্ডা। উৎসবমুখর এই পুজোর আসরে জনপ্রিয় গান ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’র সঙ্গে ফাটিয়ে নাচতে দেখা গেছে অভিনেতা দেব-কে। ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়।