দুর্গার ঘর-সংসার

সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কী করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দু’জনে মিলে একা।

Must read

আইভি চট্টোপাধ্যায়: সকালে এ-বাড়ির কাজে এসেই বুঝতে পেরেছে দুর্গা, একটা কিছু হয়েছে। গুমোট আবহাওয়া। দাদা জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে গেল, বউদি বোধহয় অফিস যাবে না। মোবাইল হাতে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কী করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দু’জনে মিলে একা।
পাড়ার সব বাড়িতেই এমন। হয় পড়া নিয়ে, নয় চাকরি নিয়ে ছেলেমেয়েরা সব বাইরে বাইরে। বাড়ি বলতে শুধু বুড়ো-বুড়ি। এরা অবশ্য বুড়ো-বুড়ি নয়, দুজনেই চাকরি করে। মেয়েটা এই দু’বছর হল পড়তে গেছে।
বউদি মোবাইলে কথা বলছে, গলার আওয়াজে বেশ ঝাঁজ। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করছে বোধহয়।
বলব না ভেবেও ডেকেই ফেলল দুর্গা, ‘‘অ বউদি, দাদা বাড়ি ফিরলে এসব কথা বোলো গো। ব্যাটাছেলে মানুষ, এমনিই মাথা গরম…তার ওপর রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা…’’
‘‘আমার মাথাটাও কম গরম নয়। মাথা গরম দেখাচ্ছে…’’ রাগ হলেও ফোন বন্ধ করেছে বউদি।
একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ আকাশ মেঘলা, বাইরেটা নরম, সবুজ সবুজ। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে নিচের রাস্তাটাও মায়া মায়া শান্ত। তবু বোধহয় বউদির মন শান্ত হল না। বাইরের ঘরের সোফায় বসল, আবার ঘরে গিয়ে ফোন হাতে খাটে শুয়ে পড়ল। খুব অস্থির।
‘‘না রে, আজ আসছি না’’, অফিসে ফোন করছে বোধহয়, ‘‘আর বলিস না। আমার তো শান্তিতে থাকার উপায় নেই। পিতৃভক্ত ছেলে, বউয়ের কথা, সংসারের কথা ভাবে না।’’

কেন যে ঘরের কথা বলে এমন! যতই একসঙ্গে কাজ করো, কেউ বন্ধু নয়। বিয়ের পর বাপের ঘরে গিয়েও সব কথা বলতে নেই। আর এ তো বন্ধু। তোমার সোয়ামিকে নিয়ে কথা অন্যের কাছে বলবে কেন? বস্তির ঘরে এমন হয়। তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, কত বড় বড় চাকরি করছ, এটুকু বোঝো না!
‘‘শ্বশুরমশাইয়ের চোখের অপারেশন। নিজের এত টাকাপয়সা, ওঁর টাকাই খায় কে? অথচ অপারেশনের খরচ ছেলে দেবেই। রীতিমতো ঝগড়া করল আমার সঙ্গে।’’
ফোনে ফোনে ভেতরের ঝাঁজ বেরিয়েছে খানিক। সোফায় এসে বসল বউদি, ‘‘হাত খালি হলে একটু চা করিস তো দুর্গা। মাথাটা ধরে আছে।’’

আরও পড়ুন-চুরি করা ‘খুকি মা’ বদলে দিয়েছিল দয়ালের জীবন

‘‘মাথার আর দোষ কী বউদি? এত রাগ করো, কী লাভ হয়? শুধু শুধু নিজের শান্তি নষ্ট।’’
‘‘যা বলেছিস। এত দায়িত্বজ্ঞান নিজের বাড়ির জন্যে…বিয়ে হয়ে থেকে একদিনের জন্যে শান্তি পেলাম না। একলা ছেলে তো নও, ভাই আছে, বড়লোক দিদিরা আছে…’’
‘‘দাদা মানুষটা ভাল যে। সবাই আছে, তবু নিজে উপস্থিত না হয়ে পারে না। ঘটের ওপর আম্রপল্লব যেমন। ওটুকু হলে তবে মনের আরাম। কম দিন তো দেখছি না দাদাকে।’’
‘‘থাম তো। ঘটের ওপর আম্রপল্লব! আম্রপল্লব না ছাই। সর্বঘটে কাঁটালি কলা। কেউ পাত্তা দেয় না, নিজে নিজে মোড়লি করে। আমার সংসারে যত অশান্তি। দুই মেয়ে অমন বড়ঘরে বিয়ে দিয়েছে, বাবার অসুখে তারা খরচ দিতে পারে না? আর ভাই? বিদেশে থাকে বলে অত ফুটুনি, সে ঝেড়ে কেশেছে একবারও?’’
‘‘দাদার মনটা যে নরম। দায়িত্বজ্ঞান খুব। সবার মন তো একরকম হয় না।’’
‘‘মন নিয়ে থাকলেই চলে না। হিসেব করতে হয়। কত মাইনে পাই? কত টাকা কেটে নেয়, জানিস?’’
‘‘টাকা কেটে নেয়? কেন বউদি? তোমার অনেক লোন আছে বুঝি?’’
তা ঠিক। এই ফ্ল্যাটবাড়ি, ফ্ল্যাটে এত জিনিস, নতুন আলমারি এল ক’দিন আগে…এরা আলমারি বলে না…ওয়ার্ডো না কি একটা বলে…নতুন চিমনি লাগল রান্নাঘরে, ক’মাস আগে নতুন গাড়ি এসেছে… লোন নিয়ে নিয়েই তো করে।
‘‘না রে, লোনের ইনস্টলমেন্ট সব তোর দাদা দেয়। দেবে না কেন? সংসার করেছে, দিতেই হবে। আমার টাকা কোথায়? পিএফ এতগুলো টাকা কেটে নেয়, তারপর ট্যাক্স। ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম,দু’টো আর-ডি, ক্রেডিট কার্ডের বিল, মোবাইলের বিল…রোজ অফিস যাতায়াত…কত থাকে হাতে?’’
বলতে বলতে উত্তেজিত বউদি। ইংরিজি কী সব বলল…মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনি দুর্গা…এটুকু বুঝল যে এত রোজগার, গোছানো, পরিপাটি সাজানো ঘরদোর…সাজগোজ, চাকচিক্য…কিন্তু বউদির হাতে টাকাপয়সা থাকে না।
এত কাণ্ড করে তাহলে চাকরি করতে যাওয়ার দরকার কী? নিত্যিনতুন শাড়ি, বাইরে বেরোতে না হলে এত কাপড় কেনার খরচও থাকবে না। মোবাইলেই বা এত খুটুর খুটুর করে খরচ বাড়াবার দরকার কী?

মুখে কিছু বলল না অবশ্য। এতক্ষণে বুঝেছে দুর্গা, আসলে নিজের সঙ্গেই কথা বলছে বউদি।
একটু দম নিয়ে শুরু করেছে আবার। ঝাঁজ নেই তেমন আর, দুঃখী দুঃখী গলা, ‘‘গত সপ্তাহে তোমার কলিগ মুখার্জিদার ছেলের বিয়েতে সতেরোশো টাকার শাড়ি দিলাম। তোমার ভাগ্নের পৈতেয় সোনার আংটি। তোমার মুখখানাই তো উঁচু হল, নাকি?’’
এবার বোধহয় আপনমনে দাদার সঙ্গে কথা বলছে।
‘‘মেয়েটার খরচ লাগে না? সেখানে থাকার খরচ দিয়েই তুমি হাত গুটিয়ে নাও, তার শখ-আহ্লাদ মেটানোর খরচ নেই? বন্ধুদের জন্মদিনের গিফট, বাইরে খেতে যাওয়া, ওদের জেনারেশন কি আমাদের মতো? তোমার বাবা-ভাই-বোনই সব? আমার মেয়েটা জলে ভেসে এসেছে? আর আমি নিজে? চাকরি না করলে তুমি একটা হাতখরচ তো দিতে। নাকি? চাকরি করি বলে নিজের সব খরচ আমার?’’
এই রে, এবার যে কান্নাকাটি শুরু করল। শান্ত না হলে ছুটির কথাটা বলে কী করে? বউদির মনটা একটু নরম করতে হবে।
ঘর মুছতে মুছতে মুখ তুলল দুর্গা, ‘‘সবই বুঝছি বউদি। তোমারও তো মা-ভাই আছে। সেখানেও তো দিতে-থুতে খরচ হয় কিছু। দাদা নিশ্চয়ই সবটা..’’
থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘‘দেখলি? তুই কেমন বুঝলি? এ লোকটা যদি বুঝত! আমি যদি আমার বাপের বাড়ি টেনে আনি? তবে, সত্যি কথা বলতে, ওদিকে আমার খরচা নেই। একেবারে ঝাড়া হাত-পা। মাকে বলেই দিয়েছি, পরগোত্তর করে দিয়েছ, আর আমাকে কিছু বোলো না। ভাইয়ের সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে থাকো, বউটাকে জ্বালিও না। হ্যাঁ, আমার আপন-পর নেই। পরের বাড়ির মেয়ে বলেই তাকে সব ঝামেলা নিতে হবে,তা যেন না হয়।’’

আরও পড়ুন-বিনা অনুমতিতে ৪৫ লক্ষ টাকার বেশি প্রকল্পে কাজ নয়, সতর্কবার্তা নবান্নের

কাজ শেষ করে দরজায় এসে দাঁড়াল দুর্গা।
বিছানায় উপুড় হয়ে মোবাইলে কী করছে বউদি। ছবি দেখছে, ছবি তুলছে। বিছানার পাশে জলখাবার পড়েছিল, দাদা না খেয়ে বেরিয়ে গেছে, সেটার ছবি তুলল। মোবাইলে সেই ছবিটা নিয়ে তুলে দিচ্ছে বোধহয়। এই ফেকবুক না কি বলে, সেখানে ছবিটা লাগাবে।

‘‘কিছু বলবি? বিকেলে তাড়াতাড়ি আসিস, আজ তো বাড়িতেই আছি।’’
‘‘ওই কথাই বলছিলাম বউদি। আজ বিকেলে একবার সোনারপুর যাব। ফিরতে রাত হবে। কাল সকাল সকাল চলে আসব।’’
‘‘কেন? তোর শাশুড়ি আবার ডেকেছে নাকি? মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এখন রোজগার করছিস বলে বারবার ডাক দিচ্ছে? নাকি তোর বর বেশি মা-মা করছে? নিজে তো রোজ ওসব খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দেয়…’’
‘‘না গো। আমার বর যদি একটু মা-মা করত, তাইলে ও এত খারাপ হতে পারত না। রোজ ওসব খেয়ে টাকা নষ্ট, শরীর নষ্ট…সে বোঝে? কতবার লক্ষ্মী-সরস্বতীর মাথায় হাত রেখে পোতিগ্গে করেছে…এমনিতে মেয়েদের খুব ভালবাসে..কিন্তু নেশার এমন জোর…’’
‘‘বাদ দে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়…এসব শোনার মন নেই আমার। কাল সকালে কামাই করবি না। আয় এখন, দরজা টেনে দিয়ে যাস।’’

প্রায় বেরিয়ে এসেছে, আবার ডাক দিল বউদি, ‘‘তোর ননদের কথাটা মনে আছে তো? আমার বন্ধুর বাড়ি বাচ্চা সামলাবার কাজের কথা? বাড়িতে বসে আছে, মাসে অতগুলো টাকা রোজগার হবে, একটা সুন্দর বাড়িতে থাকতে পারবে…বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতে পারিস তো, এবারই নিয়ে আসিস। শিপ্রাকে আমি প্রায় কথা দিয়েই ফেলেছি। তোর ভরসায়, তুই বলেছিলি। তোর মেয়ে দুটো তো কাজ করল না।’’
‘‘না বউদি, লক্ষ্মী আমাদের সংসারটা সামলায়। একাহাতে সব কাজ করে। আর আমার সরস্বতী ইস্কুলে পড়ছে না? বছর বছর ভাল পাশ দিচ্ছে। ওদের কাজে দেব না। আর হ্যাঁ, মিনুও আর কাজ করবে না। ওই কথা বলতেই যাচ্ছি আজ। আমাদের পাশের ঘরের তপন, চেনো তো ওকে? এ-বাড়িতেও ইলেকট্রিকের কাজ করতে এসেছে কতবার। তপন নিজের দোকান দিয়েছে গতমাসে। ওর সঙ্গে মিনুর বিয়ে ঠিক করেছি। পুজো কাটলেই বিয়ে। তপনের মা-বাবার মিনুকে পছন্দ। তাই শাশুড়িমাকে আর মিনুকে আনতে যাচ্ছি। বুড়ো মানুষটা একা একা থাকে, দ্যাওর-জা তো ফিরেও দেখে না। মিনুটাও শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে এবার। শাশুড়িমা আমার কাছেই থাকবে এখন থেকে। মিনুও চোখের সামনে থাকবে…বেশ ভাল হবে।’‘
‘‘তুই কি পাগল? ওই দজ্জাল শাশুড়ি। সামলাতে পারবি? নিজের চারটে ছেলেমেয়ে। তোর নিজের মা থাকে তোর কাছে। দুই বুড়িতে ঝগড়া করবে, আর তুই ভুগবি। আর তোদের সোনারপুরের ঘর ছেড়ে শাশুড়ি আসবেই বা কেন? ছোট ছেলের সঙ্গে ওই ঘর নিয়েই ঝামেলা না?’’
‘‘কী বলব বলো? আমার দ্যাওর-জা আলাদা হাঁড়ি করেছে। নিত্যি ঝগড়া বাড়িতে। তবু বাড়ি ছেড়ে আসতে চায় না। দেখি, বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসব। মিনুর বিয়ে। ঠিক চলে আসবে। এমনিতে আমার গণেশকে বড্ড ভালবাসে, ছোট নাতি বলে কথা…নাতির টানও আছে।’’
‘‘এত সব কথা মাথায় নিতে পারছি না আমি। যা ভাল বুঝিস, কর। পরে আমায় বলতে আসিস না। আর অত ঝামেলা নিয়ে কাজে কামাই করলেও শুনব না আমি।’’
‘‘না গো বউদি। কাজে কামাই করব না। এখন তো খরচ আরও বাড়ল। আমার কাত্তিক অবিশ্যি কাজ করছে আজকাল। সিকিউরিটি-গার্ডের কাজে লেগেছে। মায়ে-পোয়ে চালিয়ে নেব। কাজে গাফিলতি করব না। কাজ চলে গেলে অতগুলো পেট খাবে কী? আসলে…লোভে পড়েছি গো।’’

আরও পড়ুন-অক্টোবরের শেষেই ফল প্রকাশ

‘‘মানে? কিসের লোভ?’’ অবাক হয়ে মোবাইল থেকে মুখ তুলেছে বউদি।
‘‘মানে ওই বাসন্তী মাসি…মানে তপনের মায়ের একটা কথা। আমাকে বলেছে, মিনুকে যে আমরা বউ করে নিচ্ছি তা তোকে দেখে রে দুগ্গা। তোর নামখানা সাত্থক। চার ছেলেমেয়ে, লক্ষ্মী-সরস্বতী- কাত্তিক-গণেশ। মাতাল সোয়ামি, মা দুগ্গার বুড়ো শিবের মতো। বুড়ো মাকে এনে রেখেছিস, আবার অবলা ননদের জন্যেও ভাবনা। শাশুড়ি অত অত্যাচার করেছিল, সব ভুলে তাকে আশ্রয় দিচ্ছিস। বস্তির কুকুর-বিড়ালগুলোকে, কাক-শালিক-চড়াই সব্বাইকে দু’বেলা খেতে দিচ্ছিস। এত মায়া, সব্বার জন্যে এত ভাবনা…বাড়িখানা যে সত্যিই দুগ্গাবাড়ি করে ফেলেছিস। ঠিক যেন মা দুর্গার ঘর-সংসার। তাই তো মিনুকে…’’
চোখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকাল দুর্গা, তারপর মুখ ফেরাল, ‘‘এই লোভ বউদি। মা দুগ্গার মতো ঘর-সংসার করার লোভ। যদি সত্যিই একখান দুগ্গাবাড়ি গড়ে তুলতে পারি…’’ অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article