ভারতের নির্বাচন কমিশন মর্যাদাপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। পার্লামেন্ট বা রাজ্য আইনসভার দ্বারা এই প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। ভারতীয় সংবিধান এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টিকর্তা। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার বা কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন কমিশন দায়বদ্ধ নয়। সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা ও তত্ত্বাবধান করা কমিশনের মূল কাজ। আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যাবহুল দেশে লোকসভা নির্বাচন, বিধানসভা নির্বাচন, রাজ্যসভা নির্বাচন, বিধান পরিষদ নির্বাচন প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এর জন্য সহস্র সহস্র কর্মচারী প্রয়োজন। কিন্তু সামান্য কয়েকজন আধিকারিক ছাড়া নির্বাচন কমিশনের লোকবল নেই। ফলে নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী, রাজ্য সরকারের কর্মচারী, ব্যাঙ্ক, এলআইসি প্রমুখ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বশাসিত কংস্থার কর্মচারী, পুরসভার কর্মচারী, স্কুলের শিক্ষক, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর নির্ভর করতে হয়। এই সমস্ত কর্মচারী ও আধিকারিকরা তাঁদের নিয়োগ কর্তার অধীনে কাজ করেন। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এবং রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে চাকরি করেন। এই কর্মচারীরা যখন নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ করেন, তখন তাঁরা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে ডেপুটেশনে আছেন গণ্য করা হয়। এখানেই সমস্যার সূত্রপাত ও সমস্যাটির রাজনীতিকরণ হয়ে থাকে। এটা স্বীকৃত, নির্বাচন ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তি সরাসরি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসেন। তাঁদের উপর কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার বা তাঁদের নিয়োগকর্তার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এই সময়ে কমিশন কর্তব্যে গাফিলতির জন্য বহু আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে—যেমন নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া, বদলি করা, সাসপেন্ড বা সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদি। এমনকী স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক পদমর্যাদার আধিকারিকদের মুহূর্তের মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। সেটাও মেনে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-আমেরিকার শুল্কনীতির জেরে কর্মহীন ভারতের ৬ লক্ষ পোশাক শ্রমিক
কিন্তু সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন কমিশনের একটা নির্দেশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষকদের মতে অভাবনীয় বলা চলে। ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের চারজন আধিকারিককে অগাস্ট (২০২৫) মাসে নির্বাচন কমিশন শাস্তির নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে দু’জন রাজ্য সিভিল সার্ভিস (এগজিকিউটিভ) পদমর্যাদার আধিকারিক, একজন ইলেক্টোরেল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (ইআরও), অপরজন সহকারী ইলেক্টোরেল রেজিস্ট্রেশন অফিসার (এইআরও)। নির্দেশে বলা হল, তাঁদের তৎক্ষণাৎ সাসপেন্ড করতে হবে এবং এফআইআর করতে হবে। সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ কমিশনকে জানিয়েছিলেন, অভ্যন্তরীণ একটি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষ হলে কমিশনকে রিপোর্ট পাঠানো হবে। কিন্তু নাছোড়বান্দা কমিশন। ক্ষুব্ধ নির্বাচন কমিশন মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে ডেকে পাঠায় এবং ২১ অগাস্টের (২০২৫) মধ্যে আগের নির্দেশ কার্যকর করার হুকুমনামা জারি করে অর্থাৎ সাসপেন্ড করতে হবে ও এফআইআর করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আধিকারিকদের সাসপেন্ড করা হল। অবশ্য এফআইআর করা হয়নি শুনেছি।
আগেই বলা হয়েছে, নির্বাচন ঘোষণার সময় থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের অবাধ ক্ষমতাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন নির্বাচন থাকে না, তখনও কি নির্বাচন কমিশনের এই ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকতে পারে? একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৯০-এর দশকে (কোন সাল ঠিক মনে নেই) ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব সরকারের কয়েকজন প্রশাসনিক ও পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। খবরটি জানাজানি হয়ে যায়। ত্রিপুরাতে তখন কংগ্রেস সরকার। নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হল। তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ত্রিপুরা সরকারকে নির্দেশ দেন। রাজ্য সরকার উক্ত নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। ত্রিপুরা সরকারের বক্তব্য ছিল, নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্বাচন কমিশনের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কমিশনের কোনও বক্তব্য বা পর্যবেক্ষণ থাকলে, কমিশন রাজ্য সরকারকে জানাবে। রাজ্য সরকার বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকারের মতকে সমর্থন করেছিল। নির্বাচন কমিশন আর অগ্রসর হয়নি। ভারতের নির্বাচন সংস্কারে সেশন সাহেবের অবদান অপরিসীম। অত্যন্ত সাহসী এবং বিদগ্ধ আধিকারিক ছিলেন। সেশন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন, ত্রিপুরা সরকারকে তাঁর প্রশাসনিক নির্দেশ বাস্তবসম্মত নয়।
আরও পড়ুন-দিল্লিতে সাংসদদের আবাসনে আগুন
সংবাদপত্রে দেখলাম, নির্বাচন কমিশন বলছে, যখন কোনও ব্যক্তি কমিশনের কাজ করেন, তখন ধরে নিতে হবে তিনি নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং কমিশনের কাজে ডেপুটেশনে আছেন। প্রায় সারা বছর নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ চলে। সাধারণ প্রশাসনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, মহকুমা এবং ব্লক প্রশাসনের বিভিন্ন পদমর্যাদার অসংখ্য আধিকারিক নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। তবে কি সারা বছর এই সমস্ত কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে থাকবেন? তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের দরকার কী? রাজ্য সরকারের দরকার কী? কেন্দ্র ও রাজ্যের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা কোথায়? সমস্ত ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যাক। অবাস্তব যুক্তি।
কেন্দ্রীয় সরকারকে তার বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতে হবে, যেমন নরসিমা রাওয়ের সরকার বলেছিল। এছাড়া আরও একটি দিক আছে। কিছু নির্দিষ্ট রাজ্যকে নির্বাচন কমিশনের চমকানো, ধমকানো, হুমকির নীতি। বাঙালির বিদ্রোহী চেতনাকে এনারা চেনেন না। বেশি চমকালে চমকাইতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য হল, বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে ত্রাস ও আতঙ্কের সৃষ্টি করা। জেলা, মহকুমা ও ব্লকস্তরে সরকারি অফিসারদের নানা ধরনের সরকারি কাজ করতে হয়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন করতে হয়। ফলে তাঁদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকতে হয়। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ইচ্ছাকৃত ভুল বা অপরাধ করলে প্রতিবিধানের জন্য জেলাশাসক আছেন, যিনি পদাধিকারবলে জেলার নির্বাচন আধিকারিক। এছাড়া রাজ্যস্তরে মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক রয়েছেন। তার পরিবর্তে একেবারে দিল্লি থেকে যুদ্ধঘোষণা! একটি সংবাদ দৈনিকে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনের জনৈক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ভোটার তালিকায় কার কার নাম কেন বাদ, কমিশন জানাতে বাধ্য নয়। কোন গ্রহ থেকে এসেছেন? দেশের শীর্ষতম আদালত তার রায়ে তথ্য-যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেন।
মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়েছে। এখন সমস্ত লাজ-লজ্জা, শিষ্টতা বিসর্জন দিয়ে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের বড় দুর্দিন।