স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত কোন পথে চলবে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। অবশেষে আধুনিক গণতান্ত্রিক (Indian democracy) ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করা হল। ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হল বেশ খানিকটা। সেই সময় চার্চিল যা বলেছিলেন তার অর্থ ছিল, জাত-পাত, ধর্ম ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত এবং লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা এত কম, সেই আদিম মানুষের দেশে গণতন্ত্রের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ভারতীয় গণতন্ত্রপন্থীরা চার্চিলের এই ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে গণতান্ত্রিক ভারতের প্রতিষ্ঠা করেন। আগে গণতন্ত্রের জন্য বাস্তবে যোগ্য হতে হবে তারপর গণতন্ত্র আসবে— কিন্তু ভারতের বিপুল দারিদ্র্য এবং অশিক্ষিত জনগণ— ঠিক করেছিলেন তাঁরা গণতন্ত্রের মধ্যদিয়েই বস্তুগত যোগ্যতা অর্জন করবেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ভারতের নয়া প্রজাতন্ত্র তার সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে সাফল্যের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডকে ভারত বলে চিহ্নিত করে। এরই সঙ্গে প্রস্তুত করে উল্লেখযোগ্য এক লিখিত সংবিধান। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দেশভাগের ঝড় ও তার নরকযন্ত্রণা সহ্য করেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। নতুন লিখিত সংবিধান গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের। এই আম্বেদকরেরা ‘উই দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’ দিয়ে এই সংবিধানের শুরু।
এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৫১-‘৫২) ছ’মাস ধরে সংগঠিত হয়। সাফল্যের সঙ্গে বিপুল জনসংখ্যার দেশে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা পেল ‘দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষের দেশে’। সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাধ্য করা হল মহিলাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য বুথে বুথে যাওয়াটাকে মেনে নিতে। এই ব্যবস্থারই বিস্তার ঘটেছে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা-সহ সাংবিধানিক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠা হল সব ক’টি ধর্মের রাজনৈতিক সমান অধিকার। যাকে বলা যায় ভারতীয় গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি।
ভারতীয় গণতান্ত্রিক (Indian democracy) ব্যবস্থার ভাল দিকগুলির পাশাপাশি মন্দ দিকগুলিও অবজ্ঞা করার মতো নয়। সেই মন্দ দিকগুলির মধ্যে ছিল শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে সেই অগণতান্ত্রিক মন্দ প্রক্রিয়া স্বৈরাচারের রূপ নেয়। জরুরি অবস্থার দিনগুলি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বিরাট ধাক্কা দেয়। জরুরি অবস্থায় বিরোধী দলগুলির নেতারা গ্রেফতার হন। সংবাদপত্রের ব্যাপক সেন্সর ব্যবস্থা চালু হয়। শত শত সাংবাদিক গ্রেফতার হন। এমনকী বিদেশি করেসপন্ডেন্টদেরও দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। একমাত্র কেন্দ্র হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর অফিস। ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধী সংসদবহির্ভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে স্বৈরাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
জরুরি অবস্থা টিকে ছিল ২১ মাস। মানুষ প্রতিবাদে পথে নামে এবং জরুরি অবস্থার অবসানে নির্বাচন ঘোষিত হয়। মানুষ দেখিয়ে দেয় গণতন্ত্রের শক্তিকে। ইন্দিরাকেও নির্বাচনে পরাস্ত করে রাতারাতি গড়ে ওঠা জনতা পার্টি সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই।
আরও পড়ুন: বাংলার বকেয়া, মূল্যবৃদ্ধি, আদানি ইস্যু: সাধারণ মানুষের দাবিতে সংসদে সরব হবে দল
ইন্দিরা গান্ধী দল ও সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে স্বৈরাচারের পথ সুগম করেছিলেন। তাঁর আমলেই গণতান্ত্রকে সঙ্কুচিত করে কেবল নির্বাচনের মধ্যে তাকে অবদ্ধ করা হয়। তিনি কংগ্রেসকে নির্বাচনে জেতার মেশিনে পরিণত করেন। নির্বাচনী-গণতন্ত্র পরিণত হয়। নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর অঘোষিত জরুরি অবস্থা শুরু হয়েছে। যার মাধ্যমে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ চরম বিপদের মুখে। এটা কেবল বিরোধী রাজনীতির লোকেরাই বলছেন না। বিদ্বৎ- সমাজও বলছে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ যিনি একসময় ভারতকে ৫০-৫০ গণতন্ত্র-এর দেশ বলেছিলেন, এখন তিনি গণতন্ত্রের অধঃপতন দেখে সেই ভারতের ৩০-৭০-এর গণতন্ত্র বলছেন। রাজনৈতিক ভাষ্যকার প্রতাপ ভানু মেহতা বলেছেন, মোদির বিজেপি মোদিকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিপুজো করে চলেছে এবং বিরোধীদের দম বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতার ব্যবহার করছে। আর সবকিছুকে স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন করছে। ভোট-বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব যোগেন্দ্র যাদব মনে করেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য এবং উন্নয়নের উপর একযোগে এরকম আক্রমণ এর আগে কখনও ঘটেনি। ২০১৯ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ভারতকে ‘ব্যর্থ গণতন্ত্রের (Indian democracy) দেশ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৬৭টি দেশের মধ্যে গণতন্ত্রের বিচারে ভারত ৫১তম স্থানে এসেছে। ভারতকে বলা হয়েছে সব থেকে দুর্বল মুক্ত গণতন্ত্রের দেশ। বলেছে ফিসেস ইন দি ওয়ার্ল্ড ২০২০ রিপোর্ট। সুইডেনের ভি ডেম ইনস্টিটিউট বলেছে, ভারত একটা ‘নির্বাচনী সৌরতন্ত্র’-এ পরিণত হয়েছে। এই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধঃপতন এমন পর্যায়ে গিয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমবর্ধমান শারীরিক আক্রমণ। সরকার শিক্ষা জগতের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে সাংবাদিকদের এবং ইন্টারনেট ব্লক করে দিচ্ছে। যা কিনা বিশ্বের সর্বোচ্চ। এক সুপ্রিম নেতা দল এবং সরকারের ওপর লৌহ কঠিন নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করে এক সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ভারতকে। সিভিল সার্ভিসের জায়গা নিচ্ছে দলতন্ত্র। সৈন্যবাহিনী খুশি হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের জন্য। বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমান শাসকদের পক্ষে। গণতন্ত্রের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভারত এখন বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ থেকে বৃহত্তম বিপন্ন গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে। জীবনযাত্রা সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র না থাকলে, কেবল ভোট দেওয়ার গণতন্ত্র আসলে নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়।
ভারতে আজ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে মেরে ফেলা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজবোধ ধ্বংস করা হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। এই দুঃস্থ অবস্থার মধ্যে পড়ে গোটা দেশ আজ গণতন্ত্রের পুনর্জীবনের পথ চেয়ে অপেক্ষমাণ। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে পৌঁছেছি আমরা। আর বিলম্বে ধ্বংস হবে দেশ। এই বোধ ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। জনগণমনে ঝড় উঠুক। বর্তমান জামানাকে পর্যুদস্ত করে এগিয়ে চলুক ভারতভূমি।