নতুন এক কাকের পালক কালাপানির কেচ্ছায়।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলা-ভাষীদের ওপর আক্রমণ, নির্যাতন অব্যাহত। চলছে দিকে দিকে ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান।
সেই আবহেই বাঙালি অস্মিতায় গোবর লেপার আয়োজন। বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস মুছে ফেলার উদ্যোগ।
আন্দামানে সেলুলার জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে গ্যালারি রয়েছে সেখানে অম্বিকা চক্রবর্তীর নামই নেই। চট্টগ্রাম অভিযানে যুক্ত বিপ্লবীদের নিয়ে সেখানে পৃথক গ্যালারি করার কোনও পরিকল্পনাও নেই এই বিজেপি সরকারের। মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত নিজে সংসদে জানিয়েছেন সেই তথ্য। আসলে বিজেপির এই কর্মকাণ্ডের পেছনে আছে ঘৃণার ও বিদ্বেষের তিনটি পরস্পর সংলগ্ন পরিসর।
এক, বাংলা ও বাঙালির প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা। বারবার বাংলা জয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উপায় খুঁজে নেওয়া।
দুই, বাংলার সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস মুছে না দিলে সাভারকরদের মতো ব্রিটিশ পদলেহীদের গৌরবান্বিত করা যাবে না যে! একযোগে বিপ্লব আর আপসের পুজো তো সম্ভব নয়। তাই, সাভারকরকে পুজো করতে হলে অম্বিকা চক্রবর্তীদের মুছে ফেলতে হয়।
আরও পড়ুন-উৎসবের বাকি একমাস, তুঙ্গে কুমোরটুলির প্রস্তুতি
তিন, ইতিহাস বিকৃতি প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণের জন্যই চট্টগ্রাম অভিযানের মতো অগ্নিযুগের বৈপ্লবিক কাণ্ডের গুরুত্ব জনমানসে কমিয়ে আনা দরকার। প্রতিবাদী মানসিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল বাংলার সশস্ত্র আন্দোলনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। মা কালীর বোমা যাঁরা বানিয়েছিলেন, তাঁরা মুসলমান সংহারের ভাবনা দ্বারা তাড়িত হননি। একথা যত কম কম করে প্রচারিত হবে, বিজেপির পক্ষে তত ভাল। কারণ, বিজেপি সেই হিন্দুত্বের কথা ছড়াতে চায়, যে হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্বের মূলগত বৈশিষ্ট্য হল মুসলমান বিদ্বেষ। অসহনশীল ধর্মচরণকে যা প্রশ্রয় দেয়। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যাকে পুষ্ট করে।
এমতাবস্থায় বাদ পড়া অম্বিকা চক্রবর্তীর পরিচয়টা সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
কে এই অম্বিকা চক্রবর্তী না বুঝলে কেন তাঁর নাম মোছা দেশদ্রোহিতার পরিচয়, সেটা অনুভূত হবে না।
১৯১১ সাল। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স। সমস্ত সদস্যরা জান লড়িয়ে দিচ্ছেন প্রস্তুতির জন্য। পাশেই কর্ণফুলি নদী। ওপার থেকে ১০-১২ জনের একটি দল আসছিল চট্টগ্রামে, কনফারেন্সে যোগ দিতে। হঠাৎই, প্রবল দুর্যোগ! কর্ণফুলি রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠল। এরই মধ্যে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। চট্টগ্রামে যে দলটি আসছিল, তাঁদের নৌকাটি ডুবে যায়। যাত্রীরা কে কোথায়, কেউ জানেন না। এমন সময় ছুটে এল এক বছর কুড়ির তরুণ। কোনও কিছুর পরোয়া না করে, জামাটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওই উত্তাল নদীতে। এ কী করছে ছেলেটা! কিন্তু একাই সব যাত্রীকে উদ্ধার করে ডাঙায় নিয়ে আসেন ওই তরুণ। হাওয়ায় কথা ছড়ায়। সব জায়গায় ছড়িয়ে গেল এই সাহসিকতার কথা। চট্টগ্রামের কনফারেন্সে এই কথা শুনলেন স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে ডেকে নিলেন ওই বছর কুড়ির তরুণ, অম্বিকা চক্রবর্তীকে। নিজের পকেটঘড়ি তুলে দেন অম্বিকার হাতে।
সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। একদিকে সমরাঙ্গনে ব্রিটিশ সেনা, অনদিকে ভারতে তৈরি হচ্ছে বিপ্লবের মহামঞ্চ। এই মঞ্চে যোগ দেন অম্বিকা চক্রবর্তীও। ১৯১৬-এর শেষদিকে প্রথমবার গ্রেফতার হন। ছাড়াও পেয়ে যান দুই বছর পর। ততদিনে অঙ্কের শিক্ষক মাস্টারদা সূর্য সেনকে পেয়ে গেছেন পাশে।
১৯২৩ সালের নাগরখানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধে আহত হলেন সূর্য সেন আর অম্বিকা চক্রবর্তী। জেলে গেলেন দুজনেই। ১৯৩০ সালে জেল থেকে একে একে ছাড়া পান সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহরা। পরিকল্পনা চলতে থাকে আসল উদ্যোগের। চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে হবে। অস্ত্রাগার দখল করতে হবে। ’৩০-এর ১৮ এপ্রিল। ৬৫ জন বিপ্লবীকে নিয়ে শুরু হল অভিযান। দুটো দলে ভাগ হয়ে যায় সবাই। একটির নেতৃত্বে থাকেন সূর্য সেন, অন্যটির দায়িত্বে অম্বিকা চক্রবর্তী। মাস্টারদার পরেই চট্টগ্রামের ওই বিপ্লবী সংগঠনের কার্যত সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে শহরের সমস্ত টেলিগ্রাম ও টেলিফোন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়। একপ্রকার বিচ্ছিন্নই করে রাখা হয় চট্টগ্রামকে। তার পরের অধ্যায়টা আমাদের সকলেরই জানা। স্বাধীনতার আগেই, অন্তত চারদিন চট্টগ্রামের ব্রিটিশ মুক্ত হয়ে যাওয়া।
অভুক্ত, ক্লান্ত সঙ্গীদের সঙ্গে অম্বিকাও আশ্রয় গ্রহণ করলেন কাছের জালালাবাদ পাহাড়ে। । এমন সময় ব্রিটিশ পুলিশ ঘিরে ফেলল পাহাড়। শুরু হল গুলির লড়াই। গুরুতর আহত হলেন অম্বিকা চক্রবর্তী। ধরাও পড়েন পরবর্তীতে। প্রথমে ফাঁসির হুকুম দেওয়া হলেও, পরে সেটা বদলে হয়ে যায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। ঠিকানা আন্দামানের সেলুলার জেল।
আরও পড়ুন-নবান্নে ‘ডিজিটাল কন্ট্রোল রুম’, পুলিশের নজরদারি ২৪x৭
গেরুয়া জমানায় সেই সেলুলার জেলের ইতিহাস বদলে দিতে, বাংলার দ্রোহ কালকে চেপে দিতে, বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম মুছে ফেলতে তৎপর হয় বিজেপি। কারণ, বাঙালিরা যখন আন্দোলনে আগুনে ফেটে পড়ছিলেন, তখন বিজেপির আদর্শ পুরুষ সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ছাড়া পেলে দলবল-সহ তাঁরা যে ইংরেজদের সাহায্য করবেন, তার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদারের বইয়ে আমরা পড়েছি সেখানে সেলুলার জেল বন্দি ৯৬৬ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামের তালিকা ছিল। প্রায় ছ’শো-সাতশো’র মতো বাঙালি বিপ্লবীদের নাম ছিল সেখানে। আনুমানিক ২০১৫ সাল বা তার আগেই মূলত বাঙালি বিপ্লবীদের নাম কেটে তালিকাভুক্ত বিপ্লবীদের সংখ্যা ৩৮৪ তে নামিয়ে আনা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, অম্বিকা চক্রবর্তীর নামও কাটা গিয়েছে।
আর এসবের মধ্যেই ২০১৫ সালেই এই সেলুলার জেলের পুনর্নবীকরণের কাজ হয়। সেলুলার জেলের নামকরণ করা হয় দামোদর সাভারকারের নামে।
চাবুকের ঘা আর সিগারেটের ছ্যাঁকায় দেশপ্রেমের যে ইতিহাস লিখেছিল সেলুলার জেল, সেটা বদলে দিচ্ছে বিজেপি। বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাদের প্রেম ও শ্রদ্ধা সত্যিই অপূর্ব রূপে প্রকাশিত!