হিমেল পরশ নিয়ে শীত আসছে
সবে মাত্র পৌষ মাস পড়েছে আর এরমধ্যেই শীত তার মিষ্টি কামড় বসাতে শুরু করে দিয়েছে। প্রতিটি বাড়ির আলমারির মধ্যে সযত্নে রাখা ন্যাপথলিন দেওয়া শীত পোশাক আর লেপ-কম্বল বাইরে বের হয়ে তাদের শীতকালীন কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। কবিগুরুর কথায়, আমলকির ডালে ডালে শীতের নাচন শুরু হয়ে গিয়েছে।
শীতের সকালে লেপের তলা থেকে বার হওয়া কিন্তু সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু শীতকালে লেপের ভেতরে বসে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়াটা যেন এক স্বর্গীয় সুখ। শীত মানেই ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়া, বেড়াতে যাওয়া। কেউ কেউ তো আবার এই সময়ে পাহাড়ে বেড়াতে যায় বরফের খোঁজে। শীত মানেই বাড়ির ছাদে পিকনিক। অথবা দল বেঁধে কাছাকাছি কোথাও বনভোজনের যাওয়া। চারিদিকে নানান ধরনের মেলা, কনকনে ঠান্ডায় মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে কমলালেবু খাওয়া। শীত যেন রংবেরঙের আনন্দে মোড়া একটা দারুণ সময়, যে সময় মনটা স্বপ্নের রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়।
আরও পড়ুন-আজ রাত পোহালেই মকরস্নান, নয়া রেকর্ড
গ্রামের শীত শহরের শীত
আমাদের শহরে মানুষদের কাছে শীতটা যেন একটু কম সময়ই সঙ্গ দিতে আসে। শীতের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের গলাগলি একটু বেশি। আমাদের দেশে শহরের শীতের সঙ্গে গ্রামের শীতের কিন্তু প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। শহরের থেকে কিন্তু গ্রামে শীত জাকিয়ে পড়ে। শহরের শীতে অন্য ধরনের এক আমেজ আছে। শহরের শীতে কুয়াশার সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শহর মানেই ব্যস্ততা আর তাই যেন শহরের শীতের অনুভূতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুভূতিহীন হয়। শহরে শীত যেমন হুট করে আসে ঠিক তেমনি আবার হুট করে চলে যায়। শহুরে শীতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বোলানো থাকে কিন্তু সেখানে কোনও শিশির ভেজা মেঠো রাস্তা থাকে না, থাকে না ভাটিয়ালি সুর অথবা পিঠেপুলির গন্ধ। গ্রামে শীতের প্রকোপ তীব্র হয়। আর সূর্যদেবও যেন সোনার হরিণের মতো দুর্লভ হয়ে ওঠে, কোনও কোনও দিন তার দেখা পাওয়াও দুষ্কর হয় আর সেই কারণেই গ্রামের মানুষ উনুনের পাশে বসে অথবা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে সেই তাপটা দিয়ে তাদের শীত নিবারণ করে। তবে হিমশীতল গ্রামবাংলায় খুশি এবং আনন্দের আয়োজনও প্রচুর থাকে।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, ২০ দেশের অংশগ্রহণ উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী
গ্রামের শীতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস, নলেন গুড়। আমরা শহুরে লোকেরা যে নলেন গুড়ের আস্বাদ গ্রহণ করি সেটা কিন্তু এই শীতকালে গ্রামেই তৈরি হয়। শীতের সন্ধ্যায় রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় খেজুর গাছে। সারারাত খেজুর গাছ থেকে টুপ টুপ করে রস পড়ে সেই হাঁড়িতে জমা হয়। সকালবেলায় সূর্য ওঠার আগেই খেজুর গাছ থেকে সেই হাঁড়ি নামিয়ে আনা হয়। এই টাটকা খেজুরের রস খেতে হলে শহর নয়, গ্রামেই যেতে হবে। আর এই খেজুর রসই জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় নলেন গুড় অর্থাৎ খেজুরের গুড় এবং পাটালি। শীতের সকালে শহরে সৃষ্টি হয় ধোঁয়া আর কুয়াশার মিলিত রূপ ধোঁয়াশার কিন্তু গ্রামকে কুয়াশা ঘিরে রাখে তার আদুরে চাদরে। শীতকাল মানেই শহরের বুকে নানান ধরনের মেলার হাতছানি। সেই মেলায় অনেক কিছুর সঙ্গেই পিঠেপুলিও পাওয়া যায়, আর শহুরে মানুষজন মেলার থেকে কেনা পিঠেপুলি খেয়েই মন ভরায়। তবে গ্রামগঞ্জে শীত মানেই পিঠে পুলির উৎসব। এখনও গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পিঠেপুলি তৈরির রেওয়াজ আছে। আসলে গ্রামের শীতের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে খেজুরের রস,পাটালি গুড়, পিঠে পায়েস, জড়িয়ে রয়েছে খড় পাতা দিয়ে জ্বালানো আগুনে হাত সেঁকে নেওয়া। শীতকালে গ্রামের প্রকৃতি হয় অসাধারণ। মাঠ জুড়ে হলুদ সরষে ফুল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। মেঠোপথে মটরশুঁটির লতানো গাছ দু’পা জড়িয়ে ধরে। ফুলকপি,বাঁধাকপি, সিম-সহ ইত্যাদি নানা ধরনের ফসলে পরিপূর্ণ থাকে গ্রামের জমিগুলো। এই শীতকালগুলোতেই গ্রামের মাঠে যাত্রা, সার্কাস হয় আর শহরের বড় বড় হলগুলিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসে।
আরও পড়ুন-মনন চিন্তন কল্পনার উৎসব
শহরে আজকাল লেপের ব্যবহার সেভাবে না দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে আজও ছড়িয়ে আছে লেপ-কম্বলের উত্তাপ। আর এইসব কিছু নিয়েই যেন গড়ে উঠেছে গ্রামের শীতকাল। তবে শীত এলেই বাজার ছেয়ে যায় লাল লেপে। লেপের তুলো লাল শালুতে মোড়ানো থাকে। আর এর পেছনেও একটি গল্প লুকিয়ে আছে।
লাল লেপের গল্প
শীতকালে লেপের সঙ্গে আমাদের যেন একটা হৃদয়ের যোগ আছে। আজকাল শহরাঞ্চলে লেপের ব্যবহার সেরকম ভাবে না দেখা গেলেও মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে আজও কিন্তু লেপ তার উষ্ণতা ছড়ায়। বলা যেতে পারে উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ সদর দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে শীত। প্রায় প্রতিটা বাড়ির আলমারি থেকে আসতে আসতে বের হচ্ছে শীতের পোশাক। উত্তুরে হাওয়াও বইতে শুরু হয়েছে। তার সাথে সাথে শুরু হয়েছে লেপ বানানোর ধুম। কারণ বাঙালিদের শীতের সঙ্গে লেপের একটা দারুণ সখ্য আছে। ঘরে একটাও লেপ মজুত নেই এরকম বাঙালি পরিবার খুঁজে পাওয়া কিন্তু বড্ড কঠিন। লেপ বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তুলোয় মোড়া লাল রঙের কাপড়। কারণ শীতের সময় দোকানগুলোতেও এই লাল রঙের লেপের কাপড়ে ছেয়ে যায়। কিন্তু কেন এই লেপে লাল কাপড় ব্যবহার করা হয় সেটা জানতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছুটা সময় আগে মুর্শিদাবাদের নবাব আমলে।
একটা সময় এই লেপ তৈরির কাজ শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সময় মুর্শিদাবাদের লম্বা কার্পাস তুলোর চাষ হত। লম্বা আঁশের কার্পাস তুলোর বীজ ছাড়িয়ে লাল রঙে চুবিয়ে সেটা শুকিয়ে নেওয়া হত আর সুগন্ধের জন্য তার সঙ্গে আতর মেশানো হত। এই সুগন্ধ যুক্ত লাল কাপাস তুলো মোলায়েম সিল্ক বা মখমলের মাঝখানে পুরে দিয়ে বানানো হত গায়ে দেওয়ার লেপ। লেপগুলো যে মখমলের কাপড় দিয়ে বানানো হত তার রং ছিল লাল। অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর আমল থেকেই রীতি অনুযায়ী এই লাল কাপড় ব্যবহার করে লেপ বানানো শুরু করা হয়েছিল। তখন মখমলের কাপড় ব্যবহার করা হলেও নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের জামাই নবাব সুজাউদ্দিন লেপ বানানোর জন্য মখমলের পরিবর্তে সিল্ক কাপড় ব্যবহার শুরু করেছিলেন। আর মনে করা হয় এরপর থেকেই লেপ বানাতে লাল কাপড় ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে মখমল বা সিল্ক কোনও কাপড়ই লেপ তৈরি করার জন্য ব্যবহার না করলেও লাল কাপড় দিয়ে লেপ তৈরির প্রথা চালু রয়েছে আজও। আর এটাই অলিখিত একটি নিয়ম যেটা মেনে লেপ কারিগররা লাল কাপড় দিয়েই লেপ বানিয়ে থাকেন। তবে অনেকেই মনে করেন লেপের তুলো লাল কাপড়ে মোড়ানোর রীতি বা নিয়ম বলে কিছুই নেই। আসলে তুলো দিয়ে বানানো লেপ ধোয়া যায় না, আর সেই কারণেই লাল রঙের কাপড় লেপ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, কারণ এতে ময়লা কম দেখা যায়। এছাড়াও অনেকেই মনে করেন যে দূর থেকে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই লেপ বানাতে লাল কাপড় ব্যবহার করা হয়। আজকাল অবশ্য আমরা লেপের সঙ্গে কম্বল, বালাপোশ ইত্যাদিও গায়ে দিয়ে থাকি।
আরও পড়ুন-কে বেশি হিংস্র, বাঘ না মানুষ?
শীত মানেই আনন্দ উৎসবে চারদিকে ভরিয়ে তোলা একটি অসাধারণ সময়। প্রায় সব সাহিত্যিকই তাঁদের সাহিত্যে শীতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন। তাঁদের লেখায় শীতের আয়োজনে জড়িয়ে থাকে শীতের শুরুতে লেপের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসা শুকনো নিম পাতার গন্ধ, জড়িয়ে থাকে মটরশুঁটি পোড়ানো আর পিঠে পুলির গন্ধ, কনকনে ঠান্ডায় খড়কুটো কাঠ জ্বালিয়ে আগুন পোহানো রাত। শীত এসেছে, কান পাতলে শুকনো পাতার ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যায়, আজকাল সুয্যি মামাও ঘুম থেকে দেরি করে উঠছে, জানান দিচ্ছে শীত এসেছে।
কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল, শিশির ভেজা ঘাস
মাটির সোঁদা গন্ধ, প্রাণ ভরে নাও শ্বাস।