গানের প্রথাগত তালিম ছিল না। তা সত্ত্বেও কিশোর কুমার জয় করেছিলেন দেশ-বিদেশের শ্রোতাদের হৃদয়। ছোটবেলা থেকেই গাইতে ভালবাসতেন। গলা ছেড়ে। প্রাণ খুলে। ছিলেন হলিউডের সঙ্গীত শিল্পী ড্যানি কায়ির অনুরাগী। অনুসরণ করতেন কে এল সায়গলকে। দাদা অশোক কুমার সেই সময়ের বলিউড ইন্ডাস্ট্রির বড় স্টার। তাঁর ইচ্ছা ছিল ভাই কিশোর অভিনেতা হবে। কিন্তু কিশোরের মন বেছে নিয়েছিল সুরের পথ। বলিউডে তাঁর কেরিয়ার শুরু হয় ‘বম্বে টকিজ’-এ কোরাস সিঙ্গার হিসেবে। তবে হতাশ করেননি দাদামণিকে। গায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জনের আগে ও পরে অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি ছবিতে। তারমধ্যে কয়েকটি পেয়েছে ক্লাসিক মর্যাদা। কিশোর কুমার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হল:
শিকারি
১৯৪৬ সালের ছবি ‘শিকারি’। এই ছবির মাধ্যমেই কিশোর কুমার অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দাদামণি অশোক কুমার। জানা যায়, অশোক কুমার একপ্রকার জোর করেই কিশোর কুমারকে এই ছবিতে অভিনয় করিয়েছিলেন।
আন্দোলন
১৯৫১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘আন্দোলন’। সামাজিক ছবি। এই ছবিতেই কিশোর কুমার প্রথমবার একক নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। পরিচালনা করেছিলেন গত শতকের চারের দশকের চলচ্চিত্র নির্মাতা ফণী মজুমদার। কিশোর কুমারের অভিনয় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-আর্জেন্টিনাকে হারাল ফ্রান্স
লুকোচুরি
মাত্র ৪টি বাংলা ছবিতেই তাঁকে দেখা গিয়েছিল। ‘লুকোচুরি’ অন্যতম ছবি। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। কিশোর কুমারের অভিনয় হয়েছিল প্রশংসিত। দ্বৈত ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তাঁর বিপরীতে ছিলেন মালা সিনহা এবং অনিতা গুহ। কিশোর কুমার ফিল্মসের ব্যানারে তৈরি হওয়া এই ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন কমল মজুমদার। সুরারোপ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই ছবির গান ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ ও ‘এই যে হেথায় কুঞ্জছায়ায়’ আজও জনপ্রিয়।
নৌকরি
১৯৫৪ সালে দর্শকের দরবারে এসেছিল ‘নৌকরি’। এই ছবিতে কিশোর কুমার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর বিপরীতে ছিলেন শেইলা রমানি। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন বিমল রয়। অভিনেতা কিশোর কুমার এই ছবির জন্যই মানুষের মনে প্রথমবার প্রভাব ফেলেন। বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা।
চলতি কা নাম গাড়ি
১৯৫৮ সালে দর্শকদের সামনে আসে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’। এই ছবির কথা না বললে কিশোর কুমারের বলিউড কেরিয়ারকে ব্যাখ্যা করা একেবারে অনৈতিক কাজ হবে। ছবিতে তিন ভাই, অশোক কুমার, কিশোর কুমার এবং অনুপ কুমারকে দেখা গিয়েছে। সত্যেন বসুর পরিচালনায় কিশোর কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মধুবালা। ছবির গানও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
দূর গগন কি ছাঁও মে
১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘দূর গগন কি ছাঁও মে’। ‘দ্য প্রাউড রেবেল’ ছবির অনুকরণে তৈরি হয়েছিল। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন কিশোর কুমার স্বয়ং। পরিচালক ও প্রযোজক সবই ছিলেন কিশোর কুমার। পাশাপাশি পালন করেছিলেন সুরকারের ভূমিকা। এই হিন্দি ছবিতে শিশু শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁর ছেলে অমিত কুমার। এছাড়াও ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। হিন্দির পাশাপাশি মুক্তি পেয়েছিল তামিল, তেলুগু, মালায়লমে। ছবিটি সাফল্য পায়নি।
আরও পড়ুন-এখনও অস্থায়ী উপাচার্যরা আসছেন কেন : শিক্ষামন্ত্রী
পড়োসন
১৯৬৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘পড়োসন’। দেশের সেরা রোম্যান্টিক কমেডির তালিকায় সবসময় থাকবে ছবিটি। যেমন ছবির গান, তেমন ভাবনা। বাংলা ছবি ‘পাশের বাড়ি’র অনুকরণে তৈরি হয়েছিল এই ছবি। কিশোর কুমারের অভিনয় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, শায়রা বানু, মেহেমুদ। ‘মেরে সামনেবালি খিড়কি মে’, ‘কহেনা হ্যায়’, ‘এক চতুর নার’ প্রভৃতি ছবির গানগুলো আজও একইরকম জনপ্রিয়। সুর করেছিলেন রাহুল দেব বর্মন।
বড়তি কা নাম দাড়ি
১৯৭৪ সালে কিশোর কুমার পরিচালিত কমেডি ছবি ‘বড়তি কা নাম দাড়ি’। এই ছবিতে ক্যামেরার সামনে অভিষেক হয়েছিল বাপ্পি লাহিড়ীর। তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছিলেন কিশোর কুমার এবং অমিত কুমার। গানগুলোয় কিশোর কুমার দিয়েছিলেন সুর।
দূর কা রাহি
১৯৭১ সালের ছবি ‘দূর কা রাহি’। নিঃসন্দেহে, কিশোর কুমারের অন্যতম পরিপক্ক এবং আবেগপূর্ণ ছবি। নিজের লেখা ছবিটি তিনি পরিচালনা করেছিলেন। সুর দিয়েছিলেন গানে। সেইসঙ্গে করেছিলেন অভিনয়। ছবিতে রয়েছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা।
শ্রীমঞ্জি
১৯৬৮ সালের কমেডি ছবি ‘শ্রীমঞ্জি’। যদিও ছবিটির কথা খুব বেশি মানুষ জানেন না। ছবিতে কিশোর কুমারের অভিনয় আলাদা মাত্রায় পৌঁছেছিল। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা করেছেন ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা।
শাবাশ ড্যাডি
১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘শাবাশ ড্যাডি’। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন কিশোর কুমার। ছিলেন পুত্র অমিত কুমার এবং যোগিতা বালি। কিশোর কুমার এবং অমিত কুমার বাবা-ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি বক্স অফিসে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছিল।
মিস্টার এক্স ইন বোম্বে
১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘মিস্টার এক্স ইন বোম্বে’।
অনবদ্য একটি ছবি। ভারতে সাই-ফাই জনারকে জীবন্ত করে তুলেছিল। ছবিতে একজন অদৃশ্য নায়ককে দেখানো হয়েছিল। তিনিই কিশোর কুমার। ছবিটি পেয়েছিল দর্শকদের প্রশংসা।
হাফ-টিকিট
১৯৬২ সালের ছবি ‘হাফ-টিকিট’। কিশোর কুমার এবং মধুবালা অভিনীত দম ফাটানো হাসির ছবি। কিশোর কুমারকে শিশুর মতো দেখানো হয়েছে, যাতে তিনি অর্ধেক টিকিটে বোম্বে ভ্রমণ করতে পারেন। মুক্তির পর ছবিটি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
ঝুমরু
একটি মিউজিক্যাল রোমান্টিক কমেডি ‘ঝুমরু’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬১ সালে। কিশোর কুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন মধুবালা। দেখানো হয়েছিল একটি আদর্শবান দরিদ্র যুবকের সঙ্গে একজন ধনী মেয়ের প্রেম।
দিল্লি কা ঠগ
১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় ‘দিল্লি কা ঠগ’। এটা একটা বিশুদ্ধ রোমান্টিক কমেডি। ছবিতে কিশোর কুমার দিল্লির একজন ঠকবাজ প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেন। যে শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে লুট করে। পর্দায় অভিনেত্রী নূতনের সঙ্গে কিশোর কুমারের রসায়ন ছিল দেখার মতো।
মুসাফির
১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় পরিচালক হিসাবে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ‘মুসাফির’ দেখানো হয়েছে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের গল্প। কিশোর কুমার অভিনয় করেন একজন তরুণ উপার্জনকারীর ভূমিকায়। তিনি হাসিখুশি মানুষ। তাঁর দুঃখী বোনকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গুরুতর নাটকীয়তার পাশাপাশি রয়েছে সূক্ষ্ম হাস্যরস।
আরও পড়ুন-গতকাল ভাসল অন্ডাল, আজ দমদম বিমানবন্দর
নিউ দিল্লি
১৯৫৬ সালের ছবি। জুটি বেঁধেছিলেন কিশোর কুমার এবং বৈজয়ন্তীমালা। এই রোমান্টিক কমেডি উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক বিভাজন নিয়ে তৈরি। কিশোর কুমার একজন পাঞ্জাবি ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি সেইসময় বক্স অফিসে সাড়া জাগিয়েছিল।
বহুমুখী প্রতিভা
কিশোর কুমার ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গান গেয়েছেন, অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি গানে সুর দিয়েছেন, ছবির গল্প লিখেছেন, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। বলা যায়, তিনি ছিলেন ওয়ান ম্যান আর্মি।
চারটি সিনেমায় কিশোরকুমারকে এতগুলো ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। সেগুলি হল, ‘শাবাশ ড্যাডি’, ‘দূর কা রাহি’, ‘দূর গগন কি ছাঁও মে’ এবং ‘বড়তি কা নাম দাড়ি’।
‘দূর গগন কি ছাঁও মে’ ছবিতে সুর করার পাশাপাশি গান লিখেছিলেন কিশোর কুমার। নিজে গেয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর সুরে গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে। জনপ্রিয় হয়েছিল কিশোর কুমারের কণ্ঠে ‘আ চলকে তুঝে’ গানটি।
‘বড়তি কা নাম দাড়ি’ ছবিতে নিজের সুরে গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। এছাড়াও তাঁর সুরে গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি, মান্না দে, আশা ভোঁসলে, অমিত কুমার, বাপ্পি লাহিড়ী, ভূপিন্দর সিং, আই এস জোহর। গানগুলো হয়েছিল জনপ্রিয়।
‘দূর কা রাহি’ ছবিতে সুর করার পাশাপাশি কয়েকটি গান লিখেছিলেন কিশোর কুমার। পাশাপাশি গেয়েছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সুলক্ষণা পণ্ডিত, অমিত গঙ্গোপাধ্যায়। গানের মধ্যেও টুকরো টুকরো অভিনয়ের অংশ মিশিয়ে দিতেন কিশোর কুমার। প্রেম, বিরহ, মজার গানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম ছিল না। তবু বেশকিছু অন্যরকম গান তিনি গেয়েছেন।
আরও পড়ুন-রোহিত ঝড়েও টাই প্রেমদাসায়
ভারতীয় গানে প্রথমবার ইউডলিং-এর ব্যবহার করেন কিশোর কুমার। জানা যায়, সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মনের কথাতেই এই ইওডেলিং স্টাইলটি রপ্ত করেন কিশোর কুমার। শচীন দেব বর্মন সুরারোপিত ৪৩টি ছবিতে গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে গেয়েছেন ১৬৪টি ছবিতে।
বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া এবং উর্দু। সিনেমার গানের পাশাপাশি গেয়েছেন বেসিক গান। বিশেষত তাঁর বাংলায় গাওয়া গানগুলো সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাঁর গান ছাড়া দুর্গাপুজো ভাবাই যায় না। কেরিয়ারে আটবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘আরাধনা’র ‘রূপ তেরা মস্তানা’ দিয়ে শুরু। শেষ পুরস্কার ‘সাগর’ ছবির ‘সাগর কিনারে’ গানের জন্য। আজ পর্যন্ত কোনও গায়ক এই রেকর্ড ভাঙতে পারেননি।
শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মনের পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, শংকর-জয়কিশন, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, বাপ্পি লাহিড়ী, রাজেশ রোশন, অজয় দাস, স্বপন চক্রবর্তী, স্বপন জগমোহন, অনু মালিক, নাদিম-শ্রাবণ প্রমুখ সুরকারদের সুরে। রাজেশ খান্না, দেব আনন্দ, উত্তম কুমার, অমিতাভ বচ্চন প্রমুখ নায়কের জন্য গেয়েছেন অসংখ্য গান।
মজাদার মানুষ ছিলেন। যেখানে যেতেন, আসর জমিয়ে রাখতেন। তবে সেটা বাইরে। ভিতরে ভিতরে ছিলেন বড়ই একা। সম্পর্কে জড়িয়েছেন। সম্পর্ক ভেঙেছেন। দাম্পত্য জীবনে বিশেষ সুখী ছিলেন না। কিশোর কুমারকে নিয়েই মেতে ছিল সারা দুনিয়া। আভাসকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের খবর কেউ রাখেনি। তাই সুরের জগৎ থেকে বড় অসময়ে চলে যেতে হয়েছে তাঁকে।