মহানিষ্ক্রমণ

১৯৪০-এর ক্রিসমাসের দিন বাবাকে সুভাষ বললেন, গাড়িটা চালিয়ে বর্ধমান অবধি যাও। সেখানে লাঞ্চ খেয়ে আবার ফিরে এসো। সেটা হল একটা ট্রায়াল।

Must read

১৯৪১-এর আজকের রাতে কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। সেটাই ছিল তাঁর নেতাজি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রথম ধাপ। আজ থেকে আট দশক আগেকার সেই ঐতিহাসিক লগ্নের ইতিবৃত্ত। লিখছেন প্রাক্তন সাংসদ অধ্যাপক সুগত বসু

৮১ বছর আগে আমার বাবা ডা. শিশির কুমার বসু তাঁর রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি থেকে। সেটাই নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের প্রথম পর্ব। এর পর দেশের বাইরে গিয়ে নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান, সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন।

আরও পড়ুন-মধ্যরাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে একরত্তি শিশুর প্রাণ বাঁচালেন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা

১৯৪০-এর জুলাই মাসের গোড়া থেকে সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি ছিলেন। নভেম্বর মাসে শুরু করলেন আমরণ অনশন। ইংরেজরা খুবই ঘাবড়ে গিয়ে ৫ ডিসেম্বর তাঁকে পাঠিয়ে দিল এলগিন রোডের বাড়িতে। সুভাষচন্দ্র চিঠিতে লিখেছিলেন, “Release me or I shall die so that the nation may live. Today I must die so that India may live and may win freedom and glory.” ইরেজরা অবশ্যই চায়নি জেলে সুভাষচন্দ্রের কিছু হোক। তাই তদানীন্তন বাংলার গভর্নর জন হার্বাট ভাইসরয় লিনলিথগোকে জানিয়েছিলেন যে তাঁরা একটা cat and mouse নীতি গ্রহণ করবেন সুভাষচন্দ্রের বিষয়ে। যে-ই তিনি একটু ভাল হয়ে উঠবেন অমনি তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।

সেই যে ৫ ডিসেম্বর তিনি পৌঁছলেন সেই বাড়িতে যেটি আজকের নেতাজি ভবন, সেদিনই আমার বাবা শিশির কুমার বসুকে পাশে বসিয়ে তাঁর হাতটা ধরে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। তারপর ৮ ডিসেম্বর ডেকে পাঠালেন আবার বাবাকে, দুপুরবেলা। বাবা উডবার্ন পার্কের বাড়ি থেকে হেঁটে চলে এলেন এলগিন রোডের বাড়িতে। সেখানে বিছানার ডান পাশে বসিয়ে তাঁর রাঙাকাকাবাবু তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার একটা কাজ করতে পারবে?

আরও পড়ুন-ভোট পিছলেও চলবে প্রচার

কাজটা ছিল, পরিকল্পনা করে কীভাবে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের ব্যবস্থা করা যায়। এরপর প্রায় একমাস ধরে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যেবেলা তাঁদের এই নিয়ে আলোচনা চলত। নেতাজি চেয়েছিলেন একটা ‘ফুলপ্রুফ এসকেপ প্ল্যান’ তৈরি করতে যাতে কোনও ভুলচুক থাকবে না।

সে সময় দুটি গাড়ির কথা বিবেচনা করা হয়। একটি ছিল আমেরিকান গাড়ি স্টুডি বেকার প্রেসিডেন্ট। আর একটি ওয়াণ্ডারার। জার্মান গাড়ি। রেজিস্ট্রি করা ছিল আমার বাবার নামে। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সালের ওই ওয়াল্ডারার গাড়িটি ব্যবহার করা হবে বলে ঠিক হল।

ইতিমধ্যে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে নেতাজির এক সহযোগী মিঞা আকবর শাহ এলেন কলকাতায়। সুভাষচন্দ্র শিশিরের সঙ্গে আকবরের আলাপ করিয়ে দিলেন। দুজনে গেলেন মধ্য কলকাতার ওয়াচেল মোল্লার দোকানে। সেখানে সুভাষচন্দ্রের ছদ্মবেশের জন্য বেশ কিছু কেনাকাটা হল। ঠিক হয়েছিল, সুভাষ মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ ধারণ করবেন। এরপর আকবর শাহ পেশোয়ারে ফিরে যান। তাঁকে বলা হল, সুভাষ পেশোয়ারে পৌঁছে তাঁকে বার্তা পাঠাবেন। তখন তিনি আবার সুভাষের সঙ্গে মিলিত হবেন।

আরও পড়ুন-হেডের সেঞ্চুরি লড়াইয়ে রাখল অস্ট্রেলিয়াকে

এখানে একটা কথা বলা দরকার। শিশির কুমারের সঙ্গে আকবর শাহের দেখা হয় ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে। ১৯৪৭-এ দেশভাগ। এরপর ৪০ বছরের বেশি সময় দুজনের আর দেখা হয়নি। ১৯৮৩-তে আমি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলো, তখন আমি আমার বাবা-মা দুজনকেই বার্মিংহামের কাছে ওয়ালসহলে ড্রাইভ করে নিয়ে যাই। সেখানে মিঞা আকবর শাহ তাঁর ছেলের কাছে এসেছিলেন। ৪০ বছর পর দুজন দুজনকে দেখে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।

১৯৪০-এর ক্রিসমাসের দিন বাবাকে সুভাষ বললেন, গাড়িটা চালিয়ে বর্ধমান অবধি যাও। সেখানে লাঞ্চ খেয়ে আবার ফিরে এসো। সেটা হল একটা ট্রায়াল।

ইতিমধ্যে ডিসেম্বর ২৯, ১৯৪০-এ মহাত্মা গান্ধি সুভাষচন্দ্রকে একটি চিঠিতে লিখলেন, “You are lrrepressible whether ill or well. Do get well before going in for fivework.”

ততদিনে ভাইপো শিশিরের সঙ্গে firework-এর ব্যবস্থা করে ফেলেছেন সুভাষ। শরৎচন্দ্র বসু কলকাতার বাইরে ছিলেন। তিনি ফেরা মাত্র তাঁকে এই পরিকল্পনার কথা জানান হল।

আরও পড়ুন-

একদিন সন্ধ্যায় বাবা শিশির বসু তাঁর বোন ইলাকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গেলেন যাতে মা কালীর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।

শেষ পর্যন্ত ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যেবেলা সুভাষ ঘোষণা করলেন, তিনি কিছুদিন তাঁর ঘরের ভেতরেই থাকবেন। তাঁকে যেন বিরক্ত না করা হয়, ইংরেজদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তাঁকে তাঁর বৃদ্ধা মা-সহ গোটা পরিবারের চোখে ধুলো দিতে হয়েছিল।

পরবর্তীকালে আমি ব্রিটিশ আর্কাইভে দেখেছি, প্রায় ১৪ জন ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট এলগিন রোডের বাড়িটা ঘিরে রেখেছিল। তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছিল, সুভাষ ডিনারে কীসের স্যুপ খেলেন। কিন্তু আসল পরিকল্পনার কথা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

১৬ জানুয়ারি রাতে ১টা ৩৫ মিনিটে সুভাষচন্দ্র বসু জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন তাঁর ঘর থেকে। পুরো বারান্দাটা হেঁটে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। সেখানে শিশির ওয়াল্ডারার গাড়িটি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

আরও পড়ুন-মন্ত্রী নৃত্যের তালে তালে

সুভাষ বসলেন পেছনের সিটের বাঁদিকে। শিশির বসু চালকের আসনে। গাড়ি চলতে শুরু করল। প্রথমে এলগিন রোডের ডানদিক। তারপর আবার ডানদিকে বেঁকলেন, অ্যালেনবি রোডের দিকে। তারপর ঘুরে এসে পড়লেন ল্যান্সডাউন রোডে। এখন সেটা শরৎ বোস রোড। সারা রাত গাড়ি চলল গ্রাণ্ড ট্রাংক রোড ধরে হাওড়া, চন্দননগর, বর্ধমান, দুর্গাপুরের জঙ্গল পেরিয়ে পরদিন রাতে পৌঁছালেন ধানবাদের কাছে বারারি বলে একটা জায়গায়।
সেখানে ছদ্মবেশী সুভাষকে দিনের বেলায় লুকিয়ে রাখা হল। ১৭ জানুয়ারি গাড়ি ছুটল গোমোর দিকে।
গোমো স্টেশন। নেমে গেলেন সুভাষ। শিশির দেখলেন গোমো স্টেশনের ওভারব্রিজ দিয়ে হেঁটে চলেছেন তাঁর রাঙা কাকাবাবু। দিল্লি কালকা মেল এল কলকাতার দিক থেকে। শিশির তখনও স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছেন।

আরও পড়ুন-ভোট পিছলেও চলবে প্রচার

ট্রেনটা ছাড়ল। শিশির দেখলেন, রাতের অন্ধকার ভেদ করে একটা আলোর মালা চলে যাচ্ছে দিল্লির দিকে।

প্রাচীন ভারতে গৌতম মহানিষ্ক্রমণের পর ইতিহাসপুরুষ বুদ্ধদেব হয়ে আজও অম্লান।

একইভাবে এই কলকাতা থেকে মহানিষ্ক্রমণের পর সুভাষচন্দ্র ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছেন নেতাজি হিসেবে।

Latest article