এক্সট্রা Y-ফ্যাক্টর

পুরুষ দেহে উপস্থিত ক্রোমোজোমে রয়েছে লিঙ্গ নির্ধারণকারী দুটি X ও Y ক্রোমোজোম; এখন যদি একটি X কিংবা একটি Y ক্রোমোজোম অতিরিক্ত থাকে, তাহলে কী হবে— দ্বিতীয় পর্বে পুরুষ দেহে একটি অতিরিক্ত Y ক্রোমোজোমের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

দ্য XYY ম্যান
বিশাল চেহারা, বলিষ্ঠ পেশি, দেখলেই বোঝা যায় ষন্ডা গোছের, তার উপর সবসময় অসামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার মারাত্মক প্রবণতা। এমনটাই ছিলেন সাহিত্যিক কেনেথ রয়েসের “The XYY Man” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, স্পাইডার স্কট! ওটা ওঁর ডাকনাম, পুরো নাম উইলিয়াম স্কট। পেশায় ধূর্ত চোর, বিড়ালের মতো অতি সন্তর্পণে চুরি করতে বিশেষভাবে দক্ষ। জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেষ্টা করলেও অপরাধের জগৎ তাকে বারবার টেনে নিয়ে গিয়েছে। এর জন্য দায়ী নাকি, ওঁর শরীরে উপস্থিত অতিরিক্ত একটি Y ক্রোমোজোম!
তাঁর এই বিশেষ অপরাধ করার দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান ফেয়ারফ্যাক্সও। ফেয়ারফ্যাক্স কোড নেম, এই চরিত্রের আসল নাম স্যার স্টুয়ার্ট হ্যালিম্যান। তিনি স্কটের ওই বিশেষ চুরিবিদ্যা কাজে লাগিয়ে অনেক গোপন ‘কোভার্ট মিশন’ সিদ্ধ করেছেন। স্পাইডার স্কটের এই বিশেষ জেনেটিক অস্বাভাবিকতার গল্প তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নৈতিকতা, পরিচয়, শোষণ ও পরিত্রাণের লড়াইয়ের কথা ফুটিয়ে তুলেছে। তবে বাস্তবে এমনটা নয়, আধুনিক মানবিক সমাজ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও রোগীর প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল। তার উপর যাঁদের একটি Y ক্রোমোজোম অতিরিক্ত, তাঁদের সামান্য কিছু রোগ লক্ষণ দেখা দিলেও, তাঁরা স্বাভাবিক মাত্রার প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হন এবং অন্য সব দিক দিয়ে মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।

আরও পড়ুন-ভোটার তহবিল নয়, ট্রাম্পের দাবি খারিজে রিপোর্ট প্রকাশ

জেকবস সিনড্রোম
মানবদেহে, বিশেষ করে পুরুষ দেহে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বেশি একটি Y ক্রোমোজোমের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি অ্যানুপ্লয়েডিক জেনেটিক কন্ডিশন। এর ফলে পুরুষ দেহে দুটি Y ক্রোমোজোম-সহ মোট ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে। ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহরে অবস্থিত রসওয়েল পার্ক কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার সেন্টারে কোষীয় জিন বিদ্যার গবেষক ড. অ্যাভারী স্যান্ডবার্গ ও তাঁর টিম সর্বপ্রথম এক ব্যক্তির দেহে ৪৭, XYY ক্যারিওটাইপের খোঁজ পান। এই আমেরিকান সাইটোজেনেটিসিস্ট হেমাটোলজি এবং ক্যানসারের গবেষণায় অন্যতম পথিকৃৎ; তিনিই প্রকাশ্য প্রতিবেদনে এই ধরনের বিশেষ জেনেটিক অবস্থার কথা জানান।
এরপর ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নেচার পত্রিকায় এবং তার পরের বছর মার্চে ল্যান্সেট পত্রিকায় দুটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা এই বিশেষ Y ক্রোমোজোমের উপস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু অর্থবহ তথ্য সাধারণ মানুষ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজের সামনে তুলে ধরে। এডিনবার্গের ওয়েস্টার্ন জেনারেল হসপিটালের এমআরসি জেনেটিক্স ইউনিটে গবেষণারত ব্রিটিশ সাইটোজেনেটিসিস্ট ড. প্যাট্রিসিয়া জেকবস এবং তাঁর সহকর্মীরা এই রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তখন থেকেই চিকিৎসক মহল, এমনকী সাধারণ মানুষের মধ্যে এই রোগের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ড. প্যাট্রিসিয়া জেকবসের নামানুসারেই এই বিশেষ জেনেটিক অবস্থাকে ‘জেকবস সিনড্রোম’ও বলা হয়।

আরও পড়ুন-সাতসকালে কাঁপল তিলোত্তমা, উৎসস্থল কলকাতার অদূরেই

Y ক্রোমোজোমের পরিচিতি
প্রাণীদেহের XY লিঙ্গ নির্ধারণকারী তন্ত্রের অন্যতম উপাদান হল Y ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমটি পুত্রসন্তানের শরীরে উপস্থিত থাকে। বলা ভাল, এই ক্রোমোজোমটির উপস্থিতিই পুরুষত্বের জন্ম দেয়। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ জিন যা অপত্যের শরীরে পুং জননাঙ্গের বিকাশ ঘটায়। একমাত্র পিতার দেহ থেকেই এই ক্রোমোজোম পুত্রের দেহে সঞ্চারিত হয়। এর মধ্যে উপস্থিত জিনের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পেনসিলভেনিয়ার ব্রায়ান মাওবর কলেজে জেনেটিসিস্ট ড. নেট্টি মারিয়া স্টিভেন্স হলুদ রঙের মিল ওয়ার্ম নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখনই তিনি এই Y ক্রোমোজোমের হদিশ পান। মিল ওয়ার্ম হল গমপোকা বা ময়লাকীট। এটি সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পোকা-মাকড়ের লার্ভা অবস্থাকে বোঝায়, বিশেষ করে টেনেব্রিও মোলিটর প্রজাতির। এগুলো প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং প্রাণীদের খাবার বা পোষ্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রোগের স্বরূপ
সাধারণত আমরা একটি Y ক্রোমোজোমের উপস্থিতিকে রোগ বা ডিজিজ হিসেবে বিবেচনা করলেও মেডিক্যাল সায়েন্সের পরিভাষায় এটি একটি ডিসঅর্ডার। সেরকম ভাবে কোনও প্রকট রোগ লক্ষণ আক্রান্তের শরীরে ফুটে ওঠে না, যতক্ষণ না শেখার সময় অসুবিধার সম্মুখীন হন। প্রায় ছেলেবেলা থেকেই আক্রান্তের দেহের উচ্চতা বাড়তে থাকে, মা-বাবার চেয়ে অনেক বেশি লম্বা হয়, ফাইনাল হাইট মোটামুটিভাবে স্বাভাবিকের তুলনায় ৭ সেমি বেশি হয়। বুদ্ধ্যাঙ্ক নর্মাল হলেও কোনও কিছু শিখতে গেলে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়, মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অন্য মানুষের সঙ্গে, কিংবা অন্য পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হয়ে থাকে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির। অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মনোরোগেরও শিকার হন এঁরা। সাধারণত ওঁদের যৌনজীবন স্বাভাবিক হয়ে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ওঁদের হাঁপানি, দাঁতের সমস্যা, অন্ডকোষের বৃদ্ধি, অজ্ঞান হয়ে পড়া, কাঁপুনি প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

আরও পড়ুন-শিন্ডে বনাম ফড়নবিশ লড়াই তুঙ্গে

রোগী নয়, রোগের ব্যবস্থাপনা
পুরুষ দেহে একটি অতিরিক্ত Y ক্রোমোজোমের উপস্থিতি বংশানুক্রমিক নয়, বরঞ্চ বীর্য উৎপাদনের সময় ঘটে যাওয়া একটি এলোমেলো ঘটনা। অন্ডকোষের মধ্যে উপস্থিত নালিকায় জার্ম সেলের মাইটোসিস ও পরবর্তীতে মিওসিস বিভাজনের ফলে হ্যাপ্লয়েড স্পার্মেটোজোয়া সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলাকালীন ক্রোমোজোম বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় এই অতিরিক্ত Y ক্রোমোজোমের সৃষ্টি হয়। তার ফলেই যত বিপত্তি! সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ১০০০ পুত্রশিশু জন্মের মধ্যে ১ জনের এই সমস্যা থাকে, তবে সারাজীবনেও হয়তো এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না, আপাতভাবে কোনও প্রকট রোগ লক্ষণ দেখা যায় না বলেই। গর্ভাবস্থায় কোনও শিশুর জেনেটিক কন্ডিশন কিংবা ভ্রূণের ফুসফুসের বিকাশ দেখার জন্য যদি অ্যামনিওসিন্টেসিস বা কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং টেস্ট করা হয়, তাহলে এই ডিসঅর্ডার নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এই রোগ প্রতিরোধের কোনও ওষুধ নেই, তবে আক্রান্তের দেহে যেসব মানসিক ও শারীরিক বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো স্পিচ থেরাপি, টিউটোরিং, কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
ক্লাইনফেল্টার, জেকবস, ডাউন, এবং টার্নার সিনড্রোমের মতোই মানবদেহে একের বেশিও X কিংবা Y ক্রোমোজোমের হদিশ পাওয়া যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১৮-৫০ হাজার পুত্রশিশু জন্মের মধ্যে ১ জনের দেহে অতিরিক্ত দুটি X ক্রোমোজোমের উপস্থিতি, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ৪৮,XXXY সিনড্রোম। আরও দেখা গেছে, প্রতি ৮৫-১০০ হাজার পুত্রশিশু জন্মের মধ্যে ১ জনের শরীরে তিনটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের উপস্থিতি। যাকে বলে ৪৯, XXXXY সিনড্রোম। এইসব রোগের কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপ অনুভব করেন আক্রান্তরা, তাঁদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠা আমাদের সামাজিক কর্তব্য।

Latest article