ব্যর্থতা সর্বস্তরে, এটাই বুঝি কৃতিত্ব!

নিজেকে, নিজের শাসনকালকে জাহির করার ব্যাপারে মোদিজির জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু তাঁর মতো সার্বিক ব্যর্থতায় ইতিপূর্বে বিদ্ধ হননি আর কোনও প্রধানমন্ত্রী। মিড-ডে মিল থেকে মণিপুর, মোদির ব্যর্থতা অন্তহীন। রোজ বিপন্নতর হচ্ছে আপনার আমার দেশ। লিখছেন শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক ড. অর্ণব সাহা

Must read

সাত মাস পেরিয়ে গেল তৃতীয় এনডিএ সরকারের। এই সরকারের নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। দুই বগলে দুই ক্রাচ, টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জেডিইউ-এর নীতীশ কুমারের মতো অবিশ্বাসযোগ্য দুই সঙ্গীকে যথাসম্ভব তুষ্ট করে এগোচ্ছে এই সরকার। কিন্তু তাতে বিজেপি-আরএসএসের নিজস্ব মতাদর্শগত ও তাত্ত্বিক অবস্থানে যে বিন্দুমাত্র রদবদল ঘটেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বারবার। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের চরম ব্যর্থতায় হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিজেপির ঝুলিতে যাবার পর এই সাম্প্রদায়িক, উগ্র দক্ষিণপন্থী দলটি নতুন করে দেশের মানুষের উপর শোষণের স্টিমরোলার চালাতে আরম্ভ করেছে। যে দেশে কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য অনুযায়ীই এখনও ২৮ থেকে ৩০ কোটি মানুষ রাত্রে না-খেয়ে ঘুমোতে যায়, সেই দেশে, জনকল্যাণমূলক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যাবতীয় ইতিকর্তব্য বিস্মৃত হয়ে দলের ঘনিষ্ঠ মুষ্টিমেয় ধনী কর্পোরেটদের তোষণ এবং আমজনতার দৈনন্দিন জীবনে কঠোর ব্যয়সংকোচ নামিয়ে আনতে চাইছেন। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি জমানায় একটা চালু সরকারি পলিসি ছিল— ‘জনগণকে রোজকার সমস্যায় এত বেশি ব্যস্ত রাখো, যাতে কোনওক্রমে বেঁচে থাকা ও ন্যূনতম জীবনধারণ করাটুকুকেই তারা প্রাপ্তির অতিরিক্ত বলে মনে করে’। ভারতের চরম কর্তৃত্ববাদী মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও যেন ঠিক একই রাস্তায় চলেছে।

আরও পড়ুন-ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে আসুন মমতাই সওয়াল লালুর

ধরা যাক, এই কয়েকদিন আগে প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারি স্কুলছাত্রদের জন্য মিড-ডে মিল বরাদ্দ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। স্কুলশিক্ষা দপ্তরের পিএম পোষণ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাথমিকে দৈনিক জনপ্রতি করা হয়েছে ৬ টাকা ১৯ পয়সা আর উচ্চ প্রাথমিকে করা হয়েছে ৯ টাকা ২৯ পয়সা। এর আগে ২০২২ সালের ১ অক্টোবর থেকে মিড-ডে মিল খাতে প্রাইমারিতে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা ও আপার প্রাইমারিতে ৮ টাকা ১৭ পয়সা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এইবার যে যৎসামান্য বরাদ্দ বাড়ানো হল, তাতে বাংলার গোটা প্রগতিশীল শিক্ষামহল চরম ক্ষুব্ধ। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু সরাসরি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষুদে পড়ুয়াদের শারীরিক পুষ্টি নিয়ে চরম উদাসীন। প্রাথমিকে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৭৪ পয়সা আর উচ্চ প্রাথমিকে বরাদ্দ বেড়েছে ১ টাকা ১২ পয়সা। অথচ আমরা রাজ্যের তরফে দাবি তুলেছিলাম, কমপক্ষে ৩ টাকা করে বরাদ্দ বাড়ানো হোক। পিএম পোষণ বিভাগের এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত আরেকবার বুঝিয়ে দিল, দেশের শিশুদের খাদ্যসুরক্ষার ব্যাপারে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কতখানি উদাসীন।

আরও পড়ুন-ধনকড়ের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ার অনাস্থা

প্রায় ২৬ মাস বাদে এই অতিসামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ক্ষুদে পড়ুয়াদের কোনও উপকারেই আসবে না। এইমুহূর্তে বাজারে একটা ডিমের দাম ৭ টাকা থেকে ৭ টাকা ৫০ পয়সা। বিভিন্ন জরুরি কাঁচা আনাজের দাম যে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, তাতে মাথাপিছু ওই যৎসামান্য বরাদ্দ পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা কার্যত অসম্ভব। দেশে প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার। কতখানি অমানবিক সরকার হলে দেশের বৃহত্তর আমনাগরিকদের পরবর্তী নতুন প্রজন্মের প্রতি এতখানি উদাসীন হতে পারে একটি কেন্দ্রীয় সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী। অথচ, এই বিজেপি সরকারই গত ৫ বছরে মোদি-ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট প্রভুদের ১০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দিয়েছে। ধস নেমেছে এলআইসি, শেয়ার বাজারে। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় ক্রমশ তলানিতে ঠেকছে। মোদি জমানায় দেউলিয়া ৪১ হাজার সংস্থা। এটাই যে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ মানুষের প্রতি, তারা শিশুপড়ুয়াদের প্রতি এরকম নিষ্ঠুর আচরণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ ১৯ মাস কেটে গেল, উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর জ্বলছে। হিন্দু বৈষ্ণব মেইতেই বনাম সংখ্যালঘু খ্রিস্টান কুকি-জো সম্প্রদায়ের ভিতর হিংস্র জাতিদাঙ্গায় এ অব্দি ছারখার হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। লক্ষাধিক মানুষ গৃহচ্যুত। ষাট হাজারের বেশি বাড়ি পুড়েছে। সমাজমাধ্যমে নগ্ন মহিলাকে বলপূর্বক প্যারেড করানোর ভয়াবহ ভিডিও ভাইরাল হবার পর প্রায় সত্তর দিনের মাথায় মৌনতা ভঙ্গ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদিজি। এই জাতিদাঙ্গায় প্রথম থেকেই নাম জড়িয়েছে মেইতেই গোষ্ঠীর নিজস্ব মিলিশিয়া ‘আরাম্বাই টোঙ্গল’-এর। শোনা যাচ্ছে, মণিপুর পুলিশ নাকি পাঁচ হাজার অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছে তাদের হাতে, কুকি-জোদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য। কিন্তু দেড়বছর পেরিয়ে পরিস্থিতি আজ এতটাই জটিল হয়েছে ও ক্রমাগত হাতের বাইরে চলে গেছে, যে বিবদমান দুটি গোষ্ঠীরই এখন প্রধান আক্রোশ মণিপুরের ডবল ইঞ্জিন বিজেপি সরকার। হিন্দু মেইতেই, যারা গোড়া থেকেই রাজ্যের বিজেপি সরকারের সমর্থন পেয়েছিল, তারাও আজ ক্ষিপ্ত। গত ১৬ নভেম্বর মেইতেই গোষ্ঠীর সশস্ত্র সদস্যেরা বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর বাড়ি আক্রমণ করে, আগুন লাগিয়ে দেয় অন্যান্য রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের বাড়িতেও। অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি এইবার ব্যাকফায়ার করছে মণিপুরে।

আরও পড়ুন-কাল দিঘা জগন্নাথ মন্দিরের কাজ দেখতে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী

নভেম্বরের গোড়ায় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে এ অব্দি শান্ত জিরিবাম গ্রামে। হ্‌মর গোষ্ঠীর নিজস্ব গ্রামরক্ষী বাহিনীর দশজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এর আগে এই হ্‌মর গোষ্ঠীর হাতেই মেইতেইদের হাতে আশ্রিত তিনজন লোককে মেরে ফেলে এবং মেইতেই গোষ্ঠীর তিন মহিলা ও তিন শিশুকে অপহরণ করে। এই অপহৃত শিশু ও মহিলাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয় কিছুদিন পর। তারপরেই মেইতেই গোষ্ঠী রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বের উপর রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এভাবেই হিংসার এক অন্তহীন জাঁতাকলে জড়িয়ে পড়েছে মণিপুর। ৬ নভেম্বরের পর থেকে এ অব্দি অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিতে। যে আগুন জ্বালিয়েছিল বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি, যা শেষ অব্দি আরও ভয়ানক চেহারায় পৌঁছে গেছে আজ।
৫৬-ইঞ্চির ‘বিশ্বগুরু’ প্রধানমন্ত্রী মোদিজি, আপনি গোটা পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরেছেন বিগত উনিশ মাসে। আপনার একবারও মণিপুরে যাবার সময় হয়নি। হিংসাদীর্ণ মানুষকে শান্ত করার জন্য উদ্যোগ নেবার মতো সময় হয়নি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আপনিই সম্ভবত সবচেয়ে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশের মানুষের স্বার্থ নিয়ে ন্যূনতম চিন্তিত নন।

Latest article